ফ্রান্সের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকা কে এই জর্দেন বারদেলা?
ফ্রান্সের কট্টর ডানপন্থি দল ন্যাশনাল র্যালির (আরএন) ২৮ বছর বয়সী সভাপতি জর্দেন বারদেলা সম্ভবত দেশটির ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।
মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ২০১২ সালে বারদেলা ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্টে (পরবর্তীতে দলটির নাম হয় ন্যাশনাল র্যালি) যোগ দিয়েছিলেন। একই বছরেই পার্টির নেত্রী মারিন লা পেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃতীয় স্থানে ছিলেন।
তবে সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচনে খারাপ ফলের জেরে পার্লামেন্ট ভেঙে দেন ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। একই সঙ্গে দেশটিতে আগাম নির্বাচনের ঘোষণাও দেন তিনি।
ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফার ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম জয় পেয়েছে কট্টর ডানপন্থিরা। ফলে ক্ষমতার একেবারে দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে তারা।
মারিন লা পেন-এর অভিবাসন-বিরোধী কট্টর ডানপন্থি দল ন্যাশনাল র্যালি (আরএন) প্রথম ধাপের নির্বাচনে ৩৩.২ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছে। অন্যদিকে ২৯ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বামপন্থি দলগুলোর জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট। আর প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর এনসেম্বল জোট ২১ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে।
নির্বাচনে ন্যাশনাল র্যালির বড় সাফল্যের অনেকটাই কৃতিত্ব পাবেন জর্দেন বারদেলা। তার জন্ম ১১৯৫ সালে উত্তর প্যারিসের শহরতলি সেইন-সেন্ট-ডেনিসে। তাঁর ইতালী অভিবাসী মা ১৯৬০-এর দশকে ইতালির তুরিন থেকে ফ্রান্সে এসেছিলেন। বারদেলার যখন এক বছর বয়স তখন তার ব্যবসায়ী বাবার সাথে মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে।
এক সাক্ষাৎকারে বারদেলা বলেছিলেন, ছোটবেলা থেকেই তিনি যে স্থানে থাকতেন সেখানকার পরিবেশ অত্যন্ত সংঘাতপূর্ণ ছিল। তা সত্ত্বেও তিনি তার বাবার সহায়তায় (তার বাবা তার পোড়াশোনার খরচ দিতেন) একটি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন।
১৬ বছর বয়সে তিনি একটি স্থানীয় থানায় ইন্টার্ন করার পর রাজনীতিতে চলে আসেন। এরপর তিনি ভূগোল বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেও রাজনীতির পেছনেই নিজের সম্পূর্ণ সময় দেয়ার উদ্দেশ্যে সেখান থেকে ড্রপ আউট হয়ে যান।
২০১৪ সালে বারডেলা সেইন-সেন্ট-ডেনিস থেকে আরএন-এর দলীয় প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন এবং প্রথম মনোযোগ আকর্ষণ করেন যখন তিনি তার প্রাক্তন বন্ধু ও স্থানীয় কাউন্সিলর ম্যাক্সন্স বুতে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেয়ার পর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন।
বারদেলা তারপরে মারিন লা পেনের আধিকারিক হয়ে ওঠেন এবং ২১ বছর বয়সে পার্টির মুখপাত্র নিযুক্ত হন।
২০১৯ সালে লা পেন তাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনের জন্য দলের তালিকা করার দায়িত্ব দেন। নির্বাচনে আরএন জয় লাভ করে এবং ব্রাসেলসে একটি সংসদীয় আসন পায়।
২০২২ সালে বারদেলাকে আরএন-এর সভাপতি নিযুক্ত করেন লা পেন। ধারণা করা হয়, লা পেন ২০২৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করায় বারদেলাকে দলের সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছেন।
মারিন লা পেন বারদেলাকে 'সিংহের বাচ্চা' বলে ডাকতেন। ফ্রান্সের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল আত্তাল ৩৪ বছর বয়সে দেশটির সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। বারদেলা ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী হলে আত্তালের রেকর্ডটি নিজের দখলে নিয়ে নিবেন।
বারদেলা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটক ব্যবহার করে ফ্রান্সের তরুণদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। টিকটকে তার ১৫ লাখের ওপর অনুসারী আছে। ন্যাশনাল র্যালির অনেক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মানুষের সাথে সেলফি তোলার জন্য পোজ দিতেও দেখা গেছে তাকে।
'ফ্রান্স অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে'—এই লাইনটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি প্রায়ই ব্যবহার করতেন, যেটি তার দলের অভিবাসন বিরোধী অবস্থানের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল।
একটি সমাবেশে বারদেলা বলেছিলেন, 'আমাদের সভ্যতা মরে যাবে... কারণ এটি অভিবাসীদের দিয়ে ভরে যাবে, যারা আমাদের রীতিনীতি, সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার অপূরণীয় পরিবর্তন ঘটাবে।'
তার নেতৃত্বে আরএন সামাজিক আবাসন এবং কল্যাণের জন্য অভিবাসীদের চেয়ে ফরাসি নাগরিকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। দলের ভেতর যাতে তার বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ না আসে সেজন্য তিনি নিজের অভিবাসী পটভূমিকে ব্যবহার করেন বলেও শোনা যায়।
ন্যাশনাল র্যালির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জিন-মারি লা পেন, যিনি গণহত্যা এবং ফ্রান্সের মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা সহ বর্ণবাদ এবং জাতিগত বিদ্বেষের জন্য একাধিকবার অভিযুক্ত হয়েছেন, তার নাতনি লা নলওয়েন অলিভিয়ারের সাথে ২০২০ সাল থেকেই প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে বারদেলার। গুঞ্জন রয়েছে, শীঘ্রই বিয়ে করবেন তারা দুজন।
ওয়েস্টমিনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ড. ইতায় লোটেম বলেছেন, মারিন লা পেনের প্রতি আনুগত্য থাকা সত্ত্বেও প্রাথমিকভাবে মারিন-এর বাবা জিন-মারি লা পেন-এর ভক্ত হিসেবেই বারদেলা দলের একজন কর্মী হয়ে ওঠেন।
বারদেলার বিরুদ্ধে বেনামি টুইটার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বর্ণবাদী মতামত পোস্ট করার অভিযোগ থাকলেও তিনি তা অস্বীকার করেছেন।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়