বিধ্বস্ত হওয়ার আগে মৃত্যু আসন্ন টের পেয়েছিলেন সাবমার্সিবল টাইটানের যাত্রীরা
২০২৩ সালের জুনে টাইটান সাবমার্সিবল দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ফরাসি অভিযাত্রী পল-হেনরি নারজিওলের পরিবার সাবমেরিনটির মালিকানাধীন সংস্থা ওশানগেটের বিরুদ্ধে ৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি মামলা দায়ের করেছে।
পরিবারটির দাবি, যাত্রীরা দুর্ঘটনা ঘটার আগেই টের পেয়েছিলেন যে তারা বিপদে পড়তে যাচ্ছেন, যা তাদের মধ্যে প্রচুর ভয়ের সঞ্চার করেছিল। মামলায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে গাফিলতি, অসতর্কতা এবং বিপর্যয় রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগও আনা হয়েছে।
২২ ফুট লম্বা টাইটান-এর যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন ৫৮ বছর বয়সী ব্রিটিশ বিলিয়নিয়ার হ্যামিশ হার্ডিং, পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ব্যবসায়ী শাহজাদা দাউদ (৪৮) এবং তার ১৯ বছর বয়সী ছেলে সুলেমান, ফরাসি ওশেনোগ্রাফার ও টাইটানিক বিশেষজ্ঞ পল-অঁরি নারজিওলে (৭৭), এবং ওশানগেট-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী স্টকটন রাশ। সাবমার্সিবলটি পরিচালনা করছিলেন স্টকটন রাশ।
এর মধ্যে 'মিস্টার টাইটানিক' নামে পরিচিত অভিজ্ঞ নারজিওলে টাইটানে করে ৩৭ বার ডুব দিয়েছিলেন। তাকে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষের অন্যতম শীর্ষ বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচনা করা হত। তার পরিবারের আইনজীবীরা বলেছেন, তিনি যে সাবমেরিনটিতে ছিলেন তাতে দুর্ঘটনার ইতিহাস রয়েছে এবং ওশেনগেট কোম্পানি সাবমেরিনটির নিরাপত্তা ও সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেনি।
মামলায় আরও বলা হয়েছে, ডুব দেয়ার প্রায় ৯০ মিনিটের মাথায় টাইটান সাবমেরিনটি তার ওজন ছেড়ে দেয়, যার অর্থ তারা ডাইভ থামিয়ে পৃষ্ঠে ফিরে আসার চেষ্টা করেছিল।
দুর্ঘটনার সঠিক কারণ কখনও না জানা গেলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে— ক্রুরা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন যে সাবমেরিনটিতে সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং তারা মারা যেতে যাচ্ছেন।
মামলায় বলা হয়েছে— ক্রুরা পানির প্রচণ্ড চাপে টাইটানের অন্তর্মুখী সংকোচনে সাবমেরিনের কার্বন ফাইবার কাঠামোর মুচড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে সাবমেরিনটি যোগাযোগব্যবস্থা এবং প্রপালশন শক্তি হারিয়ে ফেলে, ধীরে ধীরে সমুদ্রের আরও গভীরে যেতে থাকেন তারা। ভেতরে থাকা সকল সদস্য বুঝতে পারছিলেন সাবমেরিনটি বিস্ফোরিত হবে, তাই মনে প্রচণ্ড ভয় নিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন সবাই।
সাবমেরিনটির মালিকানাধীন কোম্পানি ওশেনগেট ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে দায়ের করা মামলার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। কোম্পানি এবং মামলায় নাম থাকা অন্যান্য ব্যক্তিদের শীঘ্রই প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে। মামলায় বলা হয়েছে, নারজিওলে ছিলেন ওশেনগেটের কর্মী এবং টাইটানের ক্রুদের অংশ।
মামলায় টাইটান সাবমেরিনটির আধুনিক ওয়্যারলেস ইলেকট্রনিক্স ব্যবহারের সমালোচনা করে বলা হয়, ধারাবাহিক বিদ্যুৎ ও বেতার সংকেত হারিয়ে গেলে সাবমেরিনটি আর নিয়ন্ত্রণ করা যেত না।
মামলায় দাবি করা হয়েছে যে সংস্থাটি সাবমেরিনের সমস্যা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেনি এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে সেগুলো লুকিয়ে রেখেছিল। আইনজীবীদের একজন টনি বুজবি বলেন, ঠিক কী ঘটেছিল, কারা জড়িত ছিল এবং কেন তারা এটি ঘটতে দিয়েছিল তা খুঁজে বের করাই এই মামলার লক্ষ্য।
সাবমেরিনের বিস্ফোরণ গভীর সমুদ্রে বেসরকারি অনুসন্ধানের ভবিষ্যৎ নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
মার্কিন কোস্ট গার্ড একটি বড় তদন্ত শুরু করেছে, যা এখনও চলছে। সেপ্টেম্বরে একটি গুরুত্বপূর্ণ গণশুনানির পরিকল্পনা করা হয়েছে।
২০২৩ সালে ১৮ জুন, টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখার উদ্দেশ্যে ৫ যাত্রী সমুদ্রে ডুব দেয় সাবমার্সিবল টাইটান। দুই ঘণ্টা পরে উপরে থাকা মূল জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এটির।
নিখোঁজ হওয়ার পরপরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সমুদ্রে অনুসন্ধানে নেমে পড়ে। জাহাজ ও বিমান ব্যবহার করে সমুদ্র চষে ফেলা হয় এটির খোঁজ পাওয়ার জন্য।
পরে, নিউফাউন্ডল্যান্ডের সেন্ট জনস থেকে প্রায় ৪৩৫ মাইল (৭০০ কি.মি) দক্ষিণে টাইটানিক জাহাজ থেকে ৯৮৪ ফুট (৩০০ মিটার) দূরে সাবমার্সিবলটির ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়।
টাইটানিক থেকে জিনিসপত্র উদ্ধারের স্বত্বাধিকারী সংস্থা আরএমএস টাইটানিক ইনকর্পোরেটেড সম্প্রতি ২০১০ সালের পর প্রথমবারের মতো টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ সাইটে ভ্রমণ শুরু করেছে। টাইটান বিস্ফোরণে মারা যাওয়া পল-হেনরি নারজিওলে এই সংস্থার আন্ডারওয়াটার গবেষণার পরিচালক ছিলেন। তিনি ১৯৮৭ সাল থেকে টাইটানিক সাইট অন্বেষণ করছিলেন এবং অনেক নিদর্শন পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করেছিলেন।
মামলায় বলা হয়েছে, নারজিওলে ছিলেন একজন অভিজ্ঞ আন্ডারওয়াটার এক্সপ্লোরার, যিনি সাবমেরিনটির খুঁটিনাটি সত্য জানলে টাইটান অভিযানে যোগ দিতেন না।মামলায় ওশানগেট-এর সিইও স্টকটন রাশ এবং অন্যান্যদের অসতর্ক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হওয়ার জন্য দোষারোপ করা হয়েছে, যা সাবমেরিনটির বিস্ফোরণের দিকে পরিচালিত করেছিল।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন