ঘাস স্পর্শ করলে আমাদের দেহ যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়
সম্প্রতি অক্সফোর্ডের বোটানিক গার্ডেনে হাঁটতে গিয়ে নিজেকে দেখে বিস্মিত হলাম বলছিলেন লেখক। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সুন্দর ও ঐতিহাসিক এ স্থানটি তার স্নিগ্ধ পথ ও মনোরম দৃশ্যের জন্য বিখ্যাত। প্রায় প্রতি বছর এখানে এ সৌন্দর্যের মায়ায় পড়ে দুই লাখেরও বেশি দর্শনার্থী এখানে আসেন।
কিন্তু লেখককে এখানের গাছপালা কিন্তু আকর্ষণ করেনি। তাকে আকর্ষণ করেছিল একটি ছোট শিশু। সেই ছোট্ট শিশুটি একটি গোলাপ গাছের পাতা স্পর্শ করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সঙ্গে থাকা তার দাদি তাকে পাতা স্পর্শ করতে বারণ করেনি, বরং গোলাপ ফুলের কোমল পাপড়ি শিশুটির গালে ছুঁয়ে দিচ্ছিলেন। আর তাতেই শিশুটি মুগ্ধ হচ্ছিল এবং মজা পাচ্ছিল।
আমরা প্রায় সময় বিভিন্ন সাইনবোর্ডে বিভিন্ন সতর্কবার্তা দেখি যেমন- 'স্পর্শ করবেন না' বা 'ঘাসে পা দেবেন না'। হয়ত সময় এসেছে এসব পুরোনো দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করার। হয়ত তখন পাতা, গাছের বাকল ও পাপড়ি স্পর্শ করার মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়া মানুষের জন্য ভালো বলা হবে। হয়ত শিশুটির দাদিই সঠিক ছিলেন।
শৈশব থেকেই কোনো বস্তু স্পর্শ করার প্রবণতা মানুষের জন্য স্বাভাবিক। একটি ছোট্ট শিশুকে দোকানে নিয়ে যান দেখবেন সে তার আশেপাশের সবকিছুই স্পর্শ করছে। এর কারণ হলো, আমরা স্পর্শের মাধ্যমে শিখি। কিন্তু প্রকৃতির স্পর্শ কি দেখার, শোনার ও গন্ধ নেওয়ার বাইরে আর কোনো তাৎপর্য বহন করে?
কয়েক বছর আগেও হাসপাতালে দেখা যেত, সেখানে প্রাণীদের প্রবেশ নিষেধ। প্রাণী দেহ থেকে সংক্রমণ ছড়াতে পারে এ সন্দেহ থেকে সেখানে প্রাণীদের প্রবেশ নিষেধ ছিল। তবে সময় বদলেছে। সম্প্রতি লেখক তার এক প্রবীণ আত্মীয়কে কেয়ারহোমে দেখতে যান। সেখানে দেখলেনমান, কক্ষটি কুকুরে পরিপূর্ণ এবং প্রবীণরা সেগুলোকে আদর করছেন। তখন প্রবীণদের মুখে ছিল আনন্দের অভিব্যক্তি এবং কুকুরগুলোও খুশি ছিল তা তাদের লেজ নাড়া দেখে বোঝা যাচ্ছিল।
এ কুকুরগুলোকে আদর ও স্পর্শ করার কারণে কেয়ারহোমের বাসিন্দাদের মনে এক প্রকার মানসিক প্রশান্তি মিলছিল। এটি এখন থেরাপিতে পরিণত হয়েছে। আর এটি কেন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তা আমি কেয়ারহোমের বাসিন্দা ও কুকুরগুলোর মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি। এসব কুকুরগুলোকে স্পর্শ করার ফলে মনে ইতিবাচক অনুভূতি হয়, ভয় কমে যায় ও মানসিক চাপ দূর হয়। আর এসব প্রবীণদের সম্ভাব্য বায়ো-হ্যাজার্ড ঝুঁকির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
মজার ব্যাপার হলো, এই গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে যে যারা এই ধরনের মিথস্ক্রিয়ার সময় কুকুরের সঙ্গে বেশি শারীরিক সংস্পর্শে আসেন, তাদের পরবর্তী সময়ে মানসিক চাপের মাত্রা কমে যায়। এতে বোঝা যায় যে, প্রাণীর সংস্পর্শে থাকার উপকারিতাগুলো আসলে স্পর্শজনিত উদ্দীপনার (ট্যাকটাইল স্টিমুলেশন) মাধ্যমেই বেশি কার্যকর হয়।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় প্রাকৃতিক জড় বস্তু থেকেও একই উপকার পাওয়া সম্ভব কিনা?
অনেকেরই মনে হয় কাঠের আসবাবপত্রের মসৃণ পৃষ্ঠে হাত বুলানোর মতো সহজাত প্রবৃত্তি আছে। এ বিষয়ে অক্সফোর্ডশায়ারের স্থানীয় ফার্নিচার নির্মাতা ও ওয়েউডের কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা বার্নাবি স্কটের সঙ্গে এক কথোপকথনে বিষয়টি দারুণভাবে ফুটে ওঠে।
বার্নাবি স্কট বলেন, "যখন মানুষ আমার আসবাবপত্র দেখতে আসে প্রথমেই তারা জিজ্ঞেস করে তারা সেটি স্পর্শ করতে পারবে কিনা। তারা হয়ত কিছুটা দ্বিধান্বিত থাকে। কিন্তু সবার মধ্যেই কাঠ স্পর্শ করার এক ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আশ্চর্যজনকভাবে কাঠ মানুষকে এক ধরনের উষ্ণ অনুভূতি দেয়।"
তার কথা থেকে এটা বুঝা যায় যে, কাঠ এমন একটি উষ্ণ, স্বস্তিদায়ক পরিবেশ তৈরি করে, যা জীবন্ত জগতের সুন্দর স্মৃতি জাগিয়ে তোলে, যা অন্য কোনো উপাদান করতে পারে না। যখন আমাদের ওয়ার্কশপে কিছু প্লাস্টিকের ফেন্স রেল কাটার অনুরোধ করা হয়েছিল, আমরা সেগুলো যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে আবার কাঠের কাজে ফিরে যেতে চেয়েছিলাম। সেই পরিবর্তন সবার জন্যই স্পষ্ট ছিল।"
কিন্তু গাছের পাতা বা কোনো গাছপালা ছোঁয়ার কারণে মানুষের মধ্যে আসলে কী ঘটে?
এটি কি সেই শরীরবৃত্তীয় ও মনকে প্রশান্তকরণের প্রক্রিয়াকে সক্রিয় করে তোলে, যা নির্দিষ্ট প্রাণীদের আদর করার সময় ঘটে।
দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে, বাগান করলে বিভিন্ন বয়সের মানুষের স্বাস্থ্যের ইতিবাচক অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসে। যারা মানসিক বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন, তাদের বিষণ্নতা বা স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া প্রবীণদের জন্য এ উদ্ভিদ থেরাপি অনেক কাজে দেয়। এটি স্কিজোফ্রেনিয়ার দীর্ঘমেয়াদি কিছু লক্ষণ হ্রাসে, এবং অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি) এবং অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের মানসিক চাপ ও অস্থিরতা কমাতে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু স্পর্শের নির্দিষ্ট ভূমিকা কী? মানুষ কি এটি তাদের অন্যান্য অনুভূতি থেকে এর প্রভাব আলাদা করতে পারে? সাধারণত একটি ঘরের ভেতর প্রাণী পোষার থেরাপি দেওয়া হয়। সেখানে প্রকৃতির গন্ধ ও শব্দের পরিবেশগত উদ্দীপনা বা অতিরিক্ত ব্যায়ামের সুযোগ থাকে না। তাহলে উদ্ভিদ স্পর্শ করার সময় মানুষের শরীরে কি নির্দিষ্ট কোনো পরিবর্তন ঘটে?
এই প্রশ্নের অনুসন্ধান শুরু হয় একটি পরীক্ষার মাধ্যমে। এখানে অংশগ্রহণকারীদের একটি ক্লিনিক্যাল পরিবেশে চোখ বন্ধ করে চার ধরনের বস্তু স্পর্শ করতে দেওয়া হয়। বস্তুগুলো ছিল-একটি জীবন্ত পাথোস গাছের পাতা, যাকে আমরা ডেভিল'স আইভি' নামেও চিনি, রেজিন দিয়ে তৈরি একটি কৃত্রিম পাথোস পাতা, নরম কাপড়ের একটি টুকরা এবং একটি ধাতব প্লেট। এ সময়ে তাদের মস্তিষ্কে ইনফ্রারেড স্পেকট্রোস্কপি ব্যবহার করে মস্তিষ্কের রক্ত প্রবাহ এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সক্রিয়তার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল।
এই পরীক্ষার ফলাফল পরিষ্কারভাবে বোঝা গিয়েছিল: জীবন্ত পাথোস পাতায় স্পর্শ করলে একটি উল্লেখযোগ্য প্রশান্তি সৃষ্টিকারী প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যা অন্য উপকরণগুলোর তুলনায় ছিল অনেক বেশি। যদিও এটি ছিল একটি সাধারণ পরীক্ষা, যেখানে মাত্র ১৪ জন অংশগ্রহণকারী ছিল, তবু এটি মনে আরও অনেক প্রশ্ন জাগায়। উদাহরণস্বরূপ, উদ্ভিদ উপাদান, যেমন বিভিন্ন ধরনের কাঠ বা জীবন্ত গাছের পাতা স্পর্শ করার সময় এই ধরনের প্রতিক্রিয়া কতটা সাধারণ?
আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, মানুষের শরীরের কোন অংশ দিয়ে স্পর্শ করলে এই প্রতিক্রিয়া হয়? শুধু হাত দিয়েই কি স্পর্শ করতে হবে, নাকি উদাহরণস্বরূপ ঘাসের ওপর খালি পায়ে হাঁটার সময়ও একই প্রতিক্রিয়া দেখা যায়? কাঠের মেঝেতে হাঁটলে কি এই ধরনের প্রভাব অনুভূত হয়?
এমন অভিজ্ঞতা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। কিন্তু এগুলো কি আসলেই মানুষের উপকার করে? যদি করে, তবে এগুলো কি সচেতনভাবে অনুসরণ করা উচিত?
মানৃুষের শরীরে লক্ষাধিক রিসেপ্টর আছে, যা বিভিন্ন স্পর্শ উদ্দীপনার প্রতি সাড়া দেয় এবং এগুলো ত্বকে বিস্তৃত। তবে শরীরের নির্দিষ্ট অংশ, যেমন মুখমণ্ডল এবং হাত এসব রিসেপ্টরের ঘনত্ব অনেক বেশি। এ কারণেই এই অংশগুলো বাহ্যিক শারীরিক উদ্দীপনা, বিশেষ করে স্পর্শের প্রতি অনেক বেশি সংবেদনশীল।
ত্বকে বিভিন্ন ধরনের রিসেপ্টর থাকে, যা ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় উদ্দীপিত হয়। যেমন, যান্ত্রিক স্পর্শ (স্ট্রোকিং, প্রসারণ, কম্পন), তাপমাত্রা (থার্মোরিসেপ্টর), এবং রাসায়নিক উপাদান (কেমোরিসেপ্টর)। মানুষের ত্বক, পেশি, সংযোগস্থল (জয়েন্টস), এমনকি অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোতেও ব্যথার রিসেপ্টর (নোসিসেপ্টর) থাকে, যা টিস্যু ক্ষতির সম্ভাবনাযুক্ত কার্যকলাপের কারণে সক্রিয় হয়।
কিছু স্পর্শ করার সময়, এসব রিসেপ্টর সক্রিয় হয়ে সিগন্যাল তৈরি করে, যা সেন্সরি নার্ভের মাধ্যমে মস্তিষ্কের স্পাইনাল কর্ড হয়ে থ্যালামাস অঞ্চলে পৌঁছায়। থ্যালামাস অঞ্চলের নিউরনগুলো এই সিগন্যালকে মস্তিষ্কের অন্যান্য অংশে প্রেরণ করে, যা বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এর মধ্যে রয়েছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নড়াচড়া, হৃদস্পন্দনের পরিবর্তন, শ্বাসপ্রশ্বাসের হার, মনোযোগ ও সচেতনতার পরিবর্তন।
এটি স্পর্শের উদ্দীপনার প্রতি শরীরের বাস্তব এবং বায়োলজিকাল প্রতিক্রিয়া।