ডিজনির প্রিন্সেসরাও অসুস্থ হয়: ‘হ্যাপিলি এভার আফটার’ থাকার যত স্বাস্থ্য ঝুঁকি
'অবশেষে তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল' কথাটি প্রতিটি রূপকথার গল্পের শেষ কথা। তবে কোথাও বলা হয়না, এ সুখী সমাপ্তির সঙ্গে সুস্থ থাকাও জরুরি। এক গবেষক বলেছেন, ডিজনির রূপকথার গল্পের যে প্রিন্সেস বা রাজকন্যারা আছেন তারাও কিন্তু বিভিন্ন কারণে গুরতর অসুস্থ হতে পারেন।
সম্প্রতি দ্য বিএমজে পত্রিকার ক্যারিকেচার ক্রিসমাস সংখ্যায় একটি মতামত প্রবন্ধে আইকনিক ডিজনি প্রিন্সেসদের সম্ভাব্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে সতর্ক করা হয়েছে, কিংবদন্তি এ গল্পগুলোর প্রিন্সেসদের অভ্যাস এবং আচরণগুলো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, বেল, বিফের সান্নিধ্যে থাকার কারণে রেবিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকতে পারেন। একইভাবে, সিন্ডারেলা প্রায়ই ঝাড়ু দিতে থাকেন এবং প্রচুর ধুলোর সংস্পর্শে থাকেন, যার কারণে তার ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। লেখকরা এসব প্রতীকী খারাপ অভ্যাসের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন এবং ডিজনিকে এই স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলেছেন।
সর্বাধিক জনপ্রিয় এসব শিশুতোষ গল্পগুলো দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের ক্ষতিকর স্টেরিওটাইপ গল্প প্রচার করার কারণে সমালোচনার মুখে পড়েছে। যেমন- গল্পগুলোতে সৌন্দর্যের মানদণ্ড ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। এটি তরুণ মেয়েদের আত্মমর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করছে। অনেক অল্প বয়সী মেয়েরাই এসব কল্পকাহিনি দেখে তাদের পছন্দের প্রিন্সেসদের মতো হতে চায়।
সম্প্রতি কয়েকজন ডাচ গবেষক এসব গল্পগুলোকে নতুন আঙ্গিকে ও হাস্যরসাত্মকভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। প্রকাশিত মতামতে তারা বলেছেন, "ডিজনির রাজকুমারীরা বাস্তব দুনিয়ায় গুরুতরভাবে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে, এইসব ঝুঁকি সত্ত্বেও তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করছে!"
নেদারল্যান্ডের টুইন্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক ও এই স্যাটায়ার প্রবন্ধটির লেখক মাইকেল বুই বলেন, "এ প্রবন্ধটি লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো ২০২৪ সালের শেষদিকে পাঠকদের একটু হাসি উপহার দেওয়া।" যদিও প্রবন্ধটিতে লেখকরা বিজ্ঞানভিত্তিক সবচেয়ে সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর কথাই লিখেছেন।
লেখকের সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগ করা হলে মাইকেল বুই বলেন, তিনি পাঠকদের কোনো কিছু শেখানোর চেষ্টা করছেন না। তিনি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, "রূপকথার রাজকন্যাদের জীবনাচরণ অত্যন্ত অতিরঞ্জিত। আমি সেগুলোই বিজ্ঞানের ভিত্তিতে একটু ব্যঙ্গাত্মকভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। তাই বিষয়টিকে এতো গুরুত্ব দেওয়া কিংবা গবেষণা নিয়ে এতোটা উদ্বেগ হওয়ারও কিছু নাই।
এবার তাহলে আরও বিস্তারিতভাবে বলা যাক। ডিজনির অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র 'স্নো হোয়াইট'। এ চলচ্চিত্রের রাজকন্যা তার সৎমায়ের সেবিকা হিসেবে কাজ করে। যার দরুন অত্যাচারী সৎমা রাজকন্যাকে দিয়ে অনেক কাজ করায় এবং সমাজে তাকে মিশতে দেয় না। গবেষকদের মতে এ কারণে মূল চরিত্র স্নো হোয়াইট একাকিত্বের প্রতি সংবেদনশীল। তাই লেখক স্মরণ করে করি দেন যে, সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার অভাবের সাথে হৃদ্রোগ, বিষণ্নতা, উদ্বেগ জড়িত। আর এ সব কিন্তু মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। সৌভাগ্যক্রমে, স্নো হোয়াইটের সাত বামনের সঙ্গে দেখা হয়। আর এ সাক্ষাৎ স্নো হোয়াইটকে একাকিত্বের বিপদ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে।
স্নো হোয়াইটের মতো একই সমস্যা আলাদিনের প্রিন্সেস জেসমিনের। রাজপ্রাসাদে বন্দী অবস্থায় থাকেন। সেখানে তিনি কেবল রাজপরিবারের কর্মচারী, প্রহরী এবং তাকে বিয়ে করতে আসা রাজপুত্রদের সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারেন। গবেষকরা সতর্ক করেছেন জ্যাসমিন সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তারা বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, একাকিত্ব ডিমেনশিয়া, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা (যেমন হতাশা এবং উদ্বেগ) এবং ইমিউন সিস্টেমের ক্ষতি করতে পারে।
তারা আরও বলেন, আলাদিনের পোষা বাঘ রাজাও কিন্তু জেসমিনের জন্য বিপজ্জনক। কারণ রাজার কাছ থেকে জুনোটিক (প্রাণী থেকে সংক্রমিত) রোগের ঝুঁকি রয়েছে, এমনকি ক্র্যানিওফেসিয়াল ও সার্ভিকাল স্পাইন ইনজুরির ঝুঁকিও থাকতে পারে। এছাড়া প্রাণীটি যদিও পোষা, এর প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি বিপজ্জনক এবং সম্ভাব্য প্রাণঘাতী পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে জানান লেখক।
স্নো হোয়াইট ও জেসমিনের মতো আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র হলো সিন্ডারেলা। গল্পটিতে সিন্ডারেলার আপন মা মারা যায়। সে তার সৎমায়ের সংসারে সর্বক্ষণ ধূলা-বালি পরিষ্কার করে বেড়ায়। লেখক মনে করেন, এতে সিন্ডারেলা ফুসফুসের রোগ এমনকি ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন। আবার সিন্ডারেলা যখন রাজপুত্রের সঙ্গে দেখা করতে যেতে চান, তখন জাদুকরী গডমাদার এসে অনেক গুলো গ্লিটার ছড়িয়ে দিয়ে জাদু দিয়ে রাজকন্যাকে সাজিয়ে দেন। গবেষকের দাবি, এসব গ্লিটার পাউডারগুলো হলো অ্যালুমিনিয়াম-কোটেড মাইক্রোপ্লাস্টিকস। এগুলো শ্বাসপ্রস্যাসের সঙ্গে ফুসফুসের টিস্যুতে প্রবেশ করতে পারে এবং ফুসফুসের অনেক ক্ষতি করতে পারে। তাই এ গবেষক মজা করে বলেন, "রাজপুত্রের সঙ্গে 'সুখে শান্তিতে' বাস করতে চাইলে আগে ফুসফুস ঠিক করতে তার থেরাপি প্রয়োজন।"
লেখকরা পোকাহন্টাসের সাহসী ঝাঁপ দেওয়ার প্রবণতাকেও ঝুঁকিপূর্ণ বলেছেন। তার মতে, তিনি পোকাহন্টাস যে পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়েছে তার উচ্চতা হিসেব করে দেখেছেন, এমন উচ্চতা থেকে ঝাঁপ দিলে ক্ল্যাভিকুলার কমপ্রেশন ও অন্যান্য আঘাতের ঝুঁকি অত্যধিক। এ গবেষক সতর্ক করে বলেছেন, সে যদি এভাবে বারবার পাহাড় থেকে লাফ দিতে থাকে তাহলে তাকে 'কলার্স অব দ্য উইন্ড'-এর পরিবর্তে তার এক্সরে করাতে হবে এবং প্রকৃতির সুমধুর সঙ্গীতের পরিবর্তে ভাঙা হাড়ের সিমফোনি শুনতে হবে।
এদিকে অতিরিক্ত ঘুমের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে আছেন স্লিপিং বিউটি। গবেষকরা জানান, অতিরিক্ত ঘুম হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, স্থূলতা এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘ সময় বিছানায় শুয়ে থাকা আলসার এবং পেশির অ্যাল্যাট্রফির ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। যদিও চলচ্চিত্রটিতে রাজপুত্র এসে চুম্বন দিয়ে রাজকন্যার ঘুম ভাঙান, এটিও কিন্তু বর্তমান সমাজের নিয়ম বিরুদ্ধ কাজ বলে মত দিয়েছেন লেখক। তিনি বলেন, "কারও সম্মতি ছাড়া তো তাকে চুম্বন দেওয়া যাবে না।"
উপরের চরিত্রগুলো থেকে একেবারে ভিন্ন চরিত্র হলো মুলান। সে রাজকন্যা হলেও, সে নিজেকে একজন যোদ্ধা হিসেবে পরিণত করেছে। তবে চলচ্চিত্রটির শুরুতে তার উপর পরিবার ও সামাজিক চাপ ছিল, বিশেষ করে বিয়ে করে তার নিজের সম্মান রক্ষা করার একটি নিয়ম ছিল। কিন্তু সেখান থেকে তিনি বের হয়ে আসেন এবং যুদ্ধ করে চীনের সাম্রাজ্যকে বাঁচান। প্রবন্ধটির লেখক বলেন, "যেসব নারীরা সামাজিক ও পারিবারিকভাবে সম্মানভিত্তিক বিভিন্ন সহিংসতার সম্মুখীন হন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য খুব একটা ভালো থাকে না। কারণ তাদের এমন একটি জীবন যাপন করতে হয় যা তিনি কখনও চাননি।"
ডিজনির আরেক রাজকন্যা রাপুনজেলের চুল ছিল অনেক লম্বা। তার চুলের বেণি কখনোই শেষ হতো না। তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছিল একটি দরজা বিহীন টাওয়ারের ওপর। ডাইনি গথেল তাকে সেখানে আটকে রেখেছে। গথেল সবসময় রাপুনজেলের চুল বেয়ে টাওয়ারের ওপর উঠতো। গবেষকদের মতে, চুল বেয়ে ওঠার কারণে রাপুনজেলের চুলে অতিরিক্ত টান পড়ে, এতে চুলের ফলিকল নষ্ট হতে পারে। এমনকি এ সমস্যা ট্র্যাকশন আলোপেসিয়ার মতো চুল পড়া সমস্যা তৈরি করতে পারে।
বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্টের নায়িকা বেলও স্বাস্থ্যঝুঁকির বাইরে নেই। তিনি একটি দুর্গে বাস করেন যেখানে তার সঙ্গী এমন একটি জীব যার মাথা জলহস্তীর, ভ্রু গরিলার মতো, শুঁড় শুকরের, কেশর সিংহের, বাহু এবং দেহ ভাল্লুকের, আর পা এবং লেজ নেকড়ের মতো। লেখক বলছেন, "বিস্ট আসলে একজন কিমেরা, যার দেহ বিভিন্ন ধরণের সত্তা অর্থাৎ বিভিন্ন জীবের কোষ থেকে তৈরি। বিস্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে ব্রুসেলোসিস (এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া ঘটিত সংক্রমণ যা প্রায়শই কাঁচা ও নষ্ট দুধ খেয়ে হয়) অথবা রেবিসের মতো জীবন সংকটে ফেলতে পারে এমন সংক্রমক রোগে আক্রান্ত হতে পারে বেল। তবে লেখকের মতে, বিস্টের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাস্টন বিস্টের চেয়েও খারাপ। বেল যদি গ্যাস্টনকে বেছে নিতো তাহলে তার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব সম্ভবত আরও খারাপ হতো। তাই গবেষকের মতে, "স্পষ্ট ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও পরামর্শ হলো- তুমি যাকে জানো তাকে নিয়েই ভালো থাকো।"
রূপকথার এ গল্পগুলোর প্রিন্সেসদের সম্ভাব্য কী কী রোগ হতে পারে লেখক সে বিষয়েই সচেতন করেছেন। আর এ সম্ভাব্য বিপদগুলো দ্রুত মোকাবেলা করতে চলচ্চিত্র স্টুডিও ডিজনে পদক্ষেপ নিতেও বলেছেন তিনি। তার পরামর্শ হলো- প্রিন্সেসদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিভিন্ন থেরাপির ব্যবস্থা, প্রাণীদের সঙ্গে সহাবস্থানের বিষয়ে সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণ এবং বিভিন্ন সংক্রমক রোগ থেকে বাঁচতে টিকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাহলেই প্রিন্সেসরা 'হ্যাপিলি এভার আফটার' জীবন কাটাতে পারবে।