ধারণার চেয়েও মানুষের প্রতি বেশি মনোযোগী বিড়াল, শিশুর চেয়ে দ্রুত বোঝে শব্দ-ছবির সম্পর্ক
মানুষ আর বিড়ালের সহাবস্থান শুরু হয়েছে ১০ হাজার বছর আগে। এই সময়ে বিড়ালের আকার ছোট হয়েছে। তাদের গায়ের লোমের রং বদলেছে। আগের তুলনায় বিড়াল অনেক মিশুক স্বভাবের হয়েছে। তবে এগুলোই বিড়ালের পরিবর্তন নয়। নতুন একটি গবেষণায় জানা গেছে, বিড়াল মানুষকে অনেক বেশি মনোযোগ দেয়, যা আমরা ভাবতেও পারি না।
সাইন্টিফিক রিপোর্টস-এ প্রকাশিত এই গবেষণাটি পরিচালনা করেছেন জাপানি বিজ্ঞানীরা। তারা দেখেছেন, বিড়াল দ্রুত ছবি আর শব্দের সম্পর্ক বুঝতে পারে। এই প্রক্রিয়া ভাষা শেখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
গবেষণার জন্য ৩১টি বিড়ালের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। তাদের সামনে একটি কম্পিউটারের স্ক্রিনে সূর্য আর ইউনিকর্নের ছবি দেখানো হয়। নয় সেকেন্ড ধরে ছবিগুলো স্ক্রিনে বড় আর ছোট হচ্ছিল। একই সময়ে বিড়ালের মালিকদের রেকর্ড করা দুটি শব্দ বাজানো হয়। ইউনিকর্নের জন্য বলা হয় "কেরারু", আর সূর্যের জন্য "পারুমো"।
যতক্ষণ তাদের নতুন কিছু মনে হয়েছে, ততক্ষণ বিড়ালগুলো স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিল । যখন তারা স্ক্রিনের দিকে আর না তাকিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে তখন বোঝা গেছে, তারা ছবি ও শব্দের প্রাথমিক সম্পর্ক বুঝতে পেরেছে।
এরপর বিরতির পরে একই ছবি চারবার দেখানো হয়। তবে শব্দগুলো বদলে দেওয়া হয়। "কেরারু" তখন সূর্যের সঙ্গে আর "পারুমো" ইউনিকর্নের সঙ্গে দেওয়া হয়। বিড়ালগুলো স্ক্রিনের দিকে আগের চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেশি সময় তাকিয়ে ছিল। তাদের আচরণ থেকে বোঝা গেছে, শব্দ ও ছবির নতুন সম্পর্ক তাদের জন্য বেমানান ছিল।
গবেষণার প্রধান শাও তাকাগি আজাবু ইউনিভার্সিটির একজন কগনিটিভ সায়েন্টিস্ট। তিনি বলেন, "মানব শিশুর মতো বিড়ালও খুব অল্প সময়ে শব্দ আর ছবির সম্পর্ক বুঝতে পারে।" তিনি আরও বলেন, "আমাদের দৈনন্দিন কথাগুলোতে বিড়াল মনোযোগ দেয়। আমাদের বোঝার চেষ্টা করে।"
গবেষণায় দেখা গেছে, বিড়াল এই সম্পর্ক তৈরি করতে মানব শিশুর তুলনায় কম সময় নেয়। বিড়াল যেখানে দুইটি নয় সেকেন্ডের সেশনে এসব শিখতে পারে, সেখানে ১৪ মাস বয়সী শিশুকে শেখাতে চারটি ১৫ সেকেন্ডের সেশন লাগে।
তবে তাকাগি বলেন, "মানুষের শিশু ধীরগতিতে শেখে, তা নয়। বিড়াল দ্রুত আগ্রহ হারায়। তাই তারা দ্রুত শিখেছে বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে শেখার গতির পার্থক্য নেই।"
গৃহপালিত হওয়ার পর জিনগত পরিবর্তন
এই আচরণের কয়েকটি ব্যাখ্যা রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো, বিড়াল শব্দের প্রতি অনেক বেশি সংবেদনশীল। মাদ্রিদের গ্যাটোস হাসপাতালের ফিলাইন (বিড়াল প্রজাতি) বিশেষজ্ঞ এলিওনোরা তোরেসি বলেন, এই গবেষণার ফলাফল তাকে অবাক করেনি। কারণ বিড়ালের শ্রবণশক্তি মানুষ, কুকুর বা অন্য প্রাণীর চেয়ে অনেক বেশি।
তিনি বলেন, গবেষণায় ব্যবহৃত সংক্ষিপ্ত ও তীব্র শব্দের প্রতি বিড়ালের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। তোরেসি বলেন, "গবেষণা করা কঠিন, কারণ বোঝা যায় না বিড়াল শব্দ আর ছবি মিলাতে পারেনি, নাকি তারা বিরক্ত হয়ে গেছে।"
তবে এই আবিষ্কার অবহেলা করার মতো নয়। তোরেসি বলেন, "বিড়াল আমাদের দিকে মনোযোগ দেয় এবং বোঝার চেষ্টা করে। এটা আমরা যতটা ভাবি, তার চেয়ে বেশি।" তিনি আরও বলেন, "বিড়াল স্বতন্ত্র আর উদাসীন, এই ধারণা ভুল। মানুষের প্রতি তাদের কৌতূহলী আচরণ সবসময় ছিল। শুধু এখন আমরা তাদের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি।"
বিজ্ঞান এ ধারণাকে সমর্থন করে। ২০১৪ সালে পিএনএএস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বিভিন্ন অঞ্চলের ২২টি গৃহপালিত বিড়ালের জিনোম বিশ্লেষণ করা হয়। এরপর এগুলোকে ইউরোপের বন্য বিড়ালের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
গবেষকরা দেখতে পান, অন্তত ১৩টি জিন পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তন বিড়ালের মানসিক গঠনে ভূমিকা রেখেছে। এতে তারা মানুষের প্রতি মনোযোগী হতে শিখেছে। কারণ মানুষের মনোযোগ থেকে খাবার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে বিড়াল কুকুরের মতো বিশ্বস্ত নয়। তারা বেশি বুনো ও অপ্রত্যাশিত। কারণ তাদের জিন কম বিবর্তনীয় চাপে ছিল। কুকুর ৩০ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের সঙ্গে মিশছে।
কুকুরের মতো বিড়ালকে কোনো নির্দিষ্ট কাজে গৃহপালিত করা হয়নি। ধারণা করা হয়, বিড়ালের গৃহ পালন শুরু হয় মধ্যপ্রাচ্যে কৃষিকাজের সময়। তখন বুনো বিড়াল শস্যের দোকানে ইঁদুর শিকার করতে গিয়ে শহর-গ্রামে আসে। সময়ের সঙ্গে বিড়াল আর মানুষের মধ্যে সহনশীল সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
বুঝতে পারা নয়, শুধু সম্পর্ক তৈরি
জাপানি পরীক্ষায় বিড়ালদের এমন প্রতিক্রিয়ার আরেকটি কারণ আছে। বার্সেলোনার অটোনোমাস ইউনিভার্সিটির সাইকোবায়োলজির অধ্যাপক ইগনাসিও মরগাদো ব্যাখ্যা করেন, সব স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতো বিড়ালেরও শর্তাধীন আচরণ শিখবার ক্ষমতা আছে।
তিনি বলেন, "বিড়াল বা কুকুরের চেয়েও কম বিকশিত ল্যাবরেটরি ইঁদুরও এই ধরনের শর্তাধীন আচরণ শিখতে পারে।" পরীক্ষাগারে দেখা গেছে, ইঁদুর ছবি ও শব্দ বা ছবি ও গন্ধের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করতে পারে। মরগাদো বলেন, "কোনো শব্দ ও ছবি বা শব্দ ও গন্ধ বা স্থানের মধ্যে যোগসূত্র তৈরির এই ক্ষমতা প্রায় সব স্তন্যপায়ী প্রাণীরই থাকে।"
তবে, এই আচরণকে ভাষাগত ক্ষমতা ভাবা ভুল হবে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, "পরীক্ষায় বিড়ালরা শব্দ ও ছবি আলাদা করতে পেরেছে। কিন্তু তা শব্দের অর্থ বুঝে নয়। তারা শুধু ছবি ও শব্দ শনাক্ত করে এবং তাদের মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করতে পারে।"
এই ক্ষমতা আসলে টিকে থাকার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। পোষা প্রাণী তাদের মালিকের প্রতি মনোযোগী হয়, কারণ তারা পুরস্কার প্রত্যাশা করে।
নিউরোসায়েন্টিস্ট রদ্রিগো কিয়ান কুইরোগা বলেন, "যদি কোনো বিড়াল মানুষের সাথে বড় হয় এবং শব্দ শুনে ডাক পায়, তবে সেই শব্দের পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা তার তৈরি হয়। কিন্তু বিড়াল শব্দের অর্থ বোঝে না। তারা অভিজ্ঞতা থেকে সেই শব্দের সাথে পরবর্তী কাজের সম্পর্ক তৈরি করে।" তিনি জোর দিয়ে বলেন, "এই প্রতিক্রিয়া বোঝার সমান নয়।"
মরগাদো এ বিষয়ে একমত। তিনি বলেন, প্রাণী আচরণবিদরা তাদের পোষা প্রাণীর প্রতি অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। ফলে, তারা প্রাণীদের মানবীয় ক্ষমতা দেয়ার ভুল করেন।
ভেটেরিনারি বিশেষজ্ঞ তোরেসি বলেন, "প্রাণীদের মানুষ ভাবার ভুল করাটা স্বাভাবিক। আমার বিড়ালরা আমার সন্তানের মতো। কিন্তু আমি জানি তারা বিড়াল। তাই আমি তাদের সাথে সন্তানের মতো আচরণ করব না। তাদের প্রকৃতি বোঝাই আসল কথা।"
তিনি বলেন, "বিড়াল ও তাদের আচরণ নিয়ে এখনও অনেক কিছু অজানা। পোষা প্রাণীরা আমাদের কীভাবে বোঝে, তা জানতে এই গবেষণা আমাদের সাহায্য করবে। এর মাধ্যমে আমরা তাদের সাথে আরও ভালো যোগাযোগ করতে পারব, তাদের সম্মান করতে শিখব এবং তাদের জীবনমান উন্নত করতে পারব।"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়