মিশরীয় তেলাপিয়া জ্বর কেন দরকারি যেভাবে জানায়!
৬০ কোটিরও বেশি বছর আগে পৃথিবীতে যখন প্রথম প্রাণের বিকাশ ঘটছিল, তখনই জ্বরেরও সৃষ্টি হয়। সেসময় কিছু জীবন্ত সত্তা প্রথম অনুভব করেছিল, অসুস্থ বোধ করলে উষ্ণ স্থানে কিছুক্ষণ সময় কাটালে আরাম পাওয়া যায়।
এখন আমরা জানি, জ্বর হলে বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে আমাদের শরীরের বিপাকক্রিয়া উন্নত হয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং জীবাণু বিস্তার দমন হয়।
কৌশলটি এতটাই কার্যকর যে মাছ বা টিকটিকির মতো ঠান্ডা রক্তের প্রাণীরাও লাখ লাখ বছর ধরে এই পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে। এজন্য কোনো কোনো প্রাণী উষ্ণ পানিতে সময় কাটিয়ে আবার কোনো কোনো প্রাণী দীর্ঘ সময় রোদে থেকে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ায়।
তবে মানুষের মতো উষ্ণ রক্তের প্রাণীর আবির্ভাবের পর, এটি রোগ প্রতিরোধে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হয়ে গেছে। তবে এজন্য উষ্ণ রক্তের প্রাণীর বাইরে থেকে তাপ গ্রহণের প্রয়োজন হয় না। কারণ এসব প্রাণী নিজেদের দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করতে সক্ষম।
সম্প্রতি পিএনএএস জার্নালে সাংহাইয়ের ইস্ট চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটি এবং কিংডাওয়ের মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সেন্টারের একদল গবেষকের কাজের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে।
এই গবেষকদল নীল নদের তেলাপিয়ার ওপর গবেষণা করে বুঝতে পেরেছেন, আমরা যখন সংক্রমণে ভুগি, তখন কেন জ্বর আমাদের সাহায্য করে।
তারা নিশ্চিত করেছেন, বেঁচে থাকার এই কৌশলটি উষ্ণ রক্তের প্রাণীর আবির্ভাবের বহু মিলিয়ন বছর আগে উদ্ভূত হয়েছিল।
ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় গবেষকরা লক্ষ্য করেন, এডওয়ার্ডিয়েলা পিসিসিডা ব্যাকটিরিয়া সংক্রামিত তেলাপিয়া মাছ পাঁচ দিন ট্যাংকের একটি উষ্ণ অঞ্চলে চলে গেছে। ঠান্ডা রক্তের প্রাণী মাছ শরীরে জ্বর উৎপন্ন করতে এই কাজ করেছে। তাপমাত্রা বাড়ার ফলে তাদের দেহে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটে, যা তাদের সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে।
মূলত জ্বরের মাধ্যমে শরীরকে সংকেত দেওয়া হয়, এর ফলে দেহ টি-কোষগুলো ধ্বংস করা এনজাইম উত্পাদন ধীর করে দেয়। টি-কোষ ইমিউন সিস্টেমের অভিযোজিত প্রতিক্রিয়া সমন্বয় করে। এইভাবে তারা দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারে।
তেলাপিয়া মাছ যখন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং উষ্ণ পানি খুঁজতে থাকে, তখন তাদের ক্ষুধা কমে যায় এবং অলস হয়ে পড়ে। ঠিক যেমন জ্বর হলে মানুষের ক্ষেত্রে হয়, তেমনি।
এরা তখন মাছ খাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং মাঝে মাঝে উপবাসের মতোই এর দেহ সেলুলার অটোফ্যাজি সক্রিয় করে।
তেলাপিয়ার ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, অসংখ্য প্রজাতির বিলুপ্তি থেকে বেঁচে থেকে এবং অন্যান্য উদ্ভাবনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর পরেও কীভাবে সফল জীবের সত্তায় প্রবেশ করা নতুন কোনো সংকেত শত শত মিলিয়ন বছর ধরে সংরক্ষিত থাকে।
প্রথম যখন জ্বর সৃষ্টি হয়, তখন কোনো জীবন্ত সত্তারই অভিযোজনমূলক ইমিউনিটি ছিল না। তাই ক্রমে রপ্ত করা উন্নত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আজকের মেরুদণ্ডী প্রাণীরা নিজেদের রক্ষা করেছে।
জ্বরের বৃদ্ধি সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কাজ করে। এটি টি-কোষের মতো বিশেষভাবে ক্ষতিকারক জীবাণুকে আক্রমণ না করলেও, শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করে।
তেলাপিয়া মাছের মধ্যে মানুষের ইমিউন সিস্টেমের এই অংশের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মাছ উষ্ণ পানিতে থাকলে নাইট্রিক অক্সাইডের ট্রান্সক্রিপশন ত্বরান্বিত হয়, যা একটি শক্তিশালী অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ও প্রোটিন উৎপন্ন করে এবং প্রদাহের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া শুরু করে।
তাছাড়া, উচ্চ তাপমাত্রা কিছু ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার পুনরুৎপাদনকে কঠিন করে তোলে।
প্রায় সাড়ে চারশ' মিলিয়ন বছর আগে প্রথম অভিযোজনমূলক ইমিউনিটি থাকা প্রাণীর আবির্ভাব হয়েছিল। এদের মধ্যে একাধিক শারীরবৃত্তিয়প্রক্রিয়া ছিল, যা নির্দিষ্ট আক্রমণকারীদের চিহ্নিত করতে সাহায্য করত।
সেসময় এই প্রতিক্রিয়া ছিল অনেক ধীর, ক্রমে এটি আরও কার্যকর হয় এবং একটি স্মৃতি তৈরি করে, যা পরবর্তী সময়ে একই জীবাণু দ্বারা আক্রমণ হলে প্রতিরোধে সাহায্য করে।
পিএনএএস-এ প্রকাশিত গবেষণায় দেখা যায়, কীভাবে অভিযোজনমূলক ইমিউনিটির উপাদানগুলো; যেমন টি-কোষ তাপমাত্রার বৃদ্ধির সংকেত গ্রহণ করে, যাতে সংক্রমণের সময় তারা আরও ভালোভাবে তাদের কাজ করতে পারে। যদিও এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জ্বরের উদ্ভবের দেড়শ' মিলিয়ন বছর পরে উদ্ভূত হয়,
গবেষণাপত্রের লেখকরা স্মরণ করিয়ে দেন, শরীরের তাপমাত্রা বাড়ানোর ক্ষমতা — যা উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট প্রাণীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে করে বা ঠান্ডা রক্তবিশিষ্ট প্রাণীরা উষ্ণ স্থানে গিয়ে করে — ইমিউনিটি বাড়াতে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি প্রাণীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়ায়।
ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় দেখা গেছে, ফার্মাকোলজিক্যাল পদ্ধতিতে বা চলাফেরা প্রতিরোধ করে জ্বর কমালে সংক্রামিত প্রাণীর মৃত্যু হার বেড়ে যায়।