কেন পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন ট্রাম্প?
নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রোববার (২২ ডিসেম্বর) বলেছেন, তার নতুন প্রশাসন পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবে।
তার এই মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো।
কি বলেছেন ট্রাম্প?
যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল গ্রুপ টার্নিং পয়েন্ট আয়োজিত আমেরিকাফেস্ট অনুষ্ঠানে পানামা খালের বিষয়ে কথা বলেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, "পানামা খালে আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে, যেমনটা অন্য সব জায়গায় হচ্ছে।"
তিনি আরও যোগ করেন, "আমরা বোকামি করে এটি দিয়ে দিয়েছি।"
অনুষ্ঠানের পর ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে একটি ছবি পোস্ট করেন। ছবিতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা একটি সরু জলপথের উপর উড়ছে। তিনি ক্যাপশনে লেখেন, "যুক্তরাষ্ট্রের খালে স্বাগতম!"
ট্রাম্পের বক্তব্যের পর, তিনি এবং পানামার প্রেসিডেন্ট রিকার্ডো মুলিনো বাকবিতণ্ডায় জড়ান।
মুলিনো এক ভিডিও বার্তায় বলেন, "পানামা খাল এবং তার আশেপাশের প্রতিটি স্কয়ার মিটার পানামার এবং ভবিষ্যতেও পানামারই থাকবে।" এই বার্তাটি তিনি তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স অ্যাকাউন্টে প্রকাশ করেন।
এর জবাবে ট্রাম্প মুলিনোর বক্তব্য নিয়ে একটি সংবাদ প্রতিবেদন তার ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে পুনরায় পোস্ট করেন এবং ক্যাপশনে লেখেন, "এটা নিয়ে দেখা যাবে।"
শনিবার ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া আরেক পোস্টে ট্রাম্প বলেন, "পানামা খাল পরিচালনার দায়িত্ব শুধুই পানামার, চীনের বা অন্য কারও নয়। আমরা কখনোই এটাকে ভুল হাতে যেতে দেব না।"
তবে চীন পানামা খাল নিয়ন্ত্রণ করে না। ১৯৯৭ সাল থেকে হংকং-ভিত্তিক সি কে হাচিসন হোল্ডিংস নামের একটি কোম্পানি খালের ক্যারিবীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রবেশপথের দুটি বন্দর পরিচালনা করছে।
রবিবার এক্স-এ দেওয়া বার্তায় মুলিনো আবার বলেন, "পানামা খালে চীনের কোনো প্রভাব নেই।"
পানামা খাল নিয়ে কীসের বিরোধ?
পানামা খাল পানামা প্রণালীর ওপর তৈরি একটি কৃত্রিম জলপথ। এটি প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে।
প্রতি বছর প্রায় ১৪ হাজার জাহাজ এই খাল দিয়ে চলাচল করে। এটি বিশ্বের সমুদ্রপথের প্রায় ২.৫ শতাংশ বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মোট কনটেইনার পরিবহনের ৪০ শতাংশ এ পথ দিয়ে হয়।
এই খাল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা এ পথ ব্যবহার করে এশিয়া থেকে পণ্য আমদানি করে। একইসঙ্গে তারা তরল প্রাকৃতিক গ্যাসসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে।
১৯০৪ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত এই খাল তৈরি করে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন থিওডোর রুজভেল্ট। তবে, বর্তমানে পানামা সরকার খালটির মালিক।
১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র খালটির মালিকানা পানামাকে হস্তান্তর করে।
ট্রাম্প বলেছেন, "এই মহানুভব কাজের নৈতিক এবং আইনি নীতিগুলো যদি মানা না হয়, তাহলে আমরা দাবি করব, পানামা খাল দ্রুত ও সম্পূর্ণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।"
তবে তিনি এ বিষয়ে আর কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি।
পানাম খাল কি শুকিয়ে যাচ্ছে?
২০২৩ সালে মধ্য আমেরিকায় খরার কারণে পানামা খালের কার্যক্রমে প্রভাব পড়েছিল।
এই খাল পরিচালনার জন্য পাশের কৃত্রিম গাতুন হ্রদের পানি প্রয়োজন হয়। কিন্তু হ্রদের পানি কমে যাওয়ায় কর্তৃপক্ষ জাহাজ চলাচলে সীমা আরোপ করে এবং খাল ব্যবহারের ফি বাড়ায়।
গত আর্থিক বছরে পানামা খালের মাধ্যমে জাহাজ চলাচল ২৯ শতাংশ কমে যায়। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খালটি দিয়ে ৯ হাজার ৯৪৪টি জাহাজ চলেছে। যেখানে আগের বছর সংখ্যাটি ছিল ১৪ হাজার ৮০।
এখন খালের ট্র্যাফিক খরার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। তবে আগামী বছরে খাল ব্যবহারের ফি আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মুলিনো এক বিবৃতিতে বলেন, "ট্যারিফ ইচ্ছেমতো নির্ধারণ করা হয়নি।" তিনি জানান, বাড়তি ফি পানাম সরকারের খাল উন্নয়নে ব্যয় হবে। এটি আরও বেশি জাহাজ চলাচলের সুযোগ তৈরি করবে।
ট্রাম্প কী সুপারিশ করেছেন?
নভেম্বরের নির্বাচনের আগে, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীতা ছিল "আমেরিকা ফার্স্ট" নীতির উপর। তবে, প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি "এলাকা সম্প্রসারণ" সম্পর্কে বেশ কিছু কথা বলেছেন। সম্প্রতি পানামা খালকে একটি সম্ভাব্য এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
ট্রাম্প কানাডার কথাও তুলেছেন। ১৮ ডিসেম্বর তিনি ট্রুথ সোশ্যালে পোস্ট করেন, "অনেক কানাডিয়ান চান, কানাডা ৫১তম রাজ্য হোক। তারা কর এবং সামরিক সুরক্ষায় বিশাল সাশ্রয় করবে। আমি মনে করি এটি একটি দারুণ ধারণা। ৫১তম রাজ্য!!!"
এটা স্পষ্ট নয়, ট্রাম্প এ বিষয়টি আসলেই গুরুত্বে সাথে বলেছেন কি না। তার মন্তব্যগুলো যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে পারে।
ট্রাম্প সম্প্রতি কানাডার পণ্যগুলোর ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছিলেন। এর ফলে কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড পদত্যাগ করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগের চাপ বাড়ছে।
ট্রাম্প ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ড নিয়েও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প পোস্ট করেন, তিনি কেন হাওয়েরিকে ডেনমার্কে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি এর সঙ্গে উল্লেখ করেন, "যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, গ্রিনল্যান্ডের মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি।"
এই মন্তব্যটি তিনি তার প্রথম মেয়াদেও করেছিলেন। কিন্তু ডেনমার্কের কর্তৃপক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, গ্রিনল্যান্ড বিক্রি হবে না।