বিক্রির জন্য পান্না: তালেবানরা অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে মাটির নিচে নজর দিচ্ছে
পান্নার খনির জন্য বিখ্যাত পূর্ব আফগানিস্তানের পাঞ্জশির প্রদেশে প্রায়ই এই মূল্যবান রত্নগুলো বিক্রির জন্য সাপ্তাহিক নিলাম আয়োজন করা হয়। তালেবান সরকারের এই উদ্যোগ দেশটির বিশাল খনিজ এবং রত্ন ভান্ডারকে কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জনের এক নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে।
২০২১ সালের আগস্টে ক্ষমতা দখলের পর তালেবান দাবি করেছে, তারা রত্ন, সোনা, তামা, লোহা এবং অন্যান্য মূল্যবান খনিজ যেমন ক্রোমাইট উত্তোলন করতে বহু বিনিয়োগকারীর সাথে চুক্তি করেছে। এই মাটির নিচে লুকানো সম্পদগুলো দেশটির দুর্বল অর্থনীতির জন্য একটি সম্ভাব্য লাভজনক সঞ্চয়ের রাস্তা হতে পারে।
চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের অধীনে বিনিয়োগে নেতৃত্ব দিয়েছে। এটি চীনের প্রভাব বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার একটি আক্রমণাত্মক প্রচেষ্টা। ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর যেই বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিল, সেটির সমাধানে রাশিয়া এবং ইরানের বিনিয়োগকারীরা খনিজ উত্তোলনের লাইসেন্স সই করেছেন।
মার্কিন সরকার অনুমান অনুযায়ী, আফগানিস্তানের দুর্গম অঞ্চলে কমপক্ষে ১ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের খনিজ মজুদ রয়েছে। দেশটি তামা, সোনা, দস্তা (জিংক), ক্রোমাইট, কোবাল্ট, লিথিয়াম এবং শিল্প খনিজে সমৃদ্ধ। পাশাপাশি মূল্যবান এবং অর্ধমূল্যবান রত্ন যেমন পান্না, রুবি, স্যাফায়ার (নীলকান্তার), গারনেট এবং ল্যাপিস লাজুলির মজুদ রয়েছে।
একটি মার্কিন এজেন্সির মাধ্যমে পরিচালিত অফিস অব দ্য স্পেশাল ইনস্পেক্টর জেনারেল ফর আফগানিস্তান রিকনস্ট্রাকশন জানিয়েছে, আফগানিস্তানে একটি বিরল ভুমিজ উপাদানের ভান্ডারও রয়েছে, যার উত্তোলন এই বছর বন্ধ হয়ে যাবে। এই উপাদানগুলো আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্র যেমন মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
তালেবান সেই কাজটি করতে চেষ্টা করছে, যা ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে থাকার পরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করতে পারেনি। মার্কিন সরকার আফগানিস্তানে খনিজ প্রকল্পগুলো উন্নত করার জন্য প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছিল।
মার্কিন বিশেষ পরিদর্শক জেনারেল জানুয়ারি ২০২৩ সালে একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছিলেন, কিন্তু "প্রত্যক্ষ অগ্রগতি ছিল নগণ্য এবং সেটি স্থায়ী হয়নি।"
তৎকালীন অনেক বাধা এখনো বহাল থাকতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে– নিরাপত্তাহীনতা, অপ্রতুল অবকাঠামো, দুর্নীতি, অনিয়মিত সরকারি নীতি ও বিধি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের বারবার পরিবর্তন।
তবে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর সহায়তার মাত্রা ভয়াবহভাবে কমে আসায় এসব খনিজ সম্পদ থেকে লাভের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে তালেবান সরকার।
যুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন সমর্থিত সরকারকে টিকিয়ে রাখতে আফগানিস্তানে প্রায় ১৪৩ বিলিয়ন ডলার উন্নয়ন এবং মানবিক সহায়তা প্রদান করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ পরিদর্শক জেনারেলের মতে, ২০২১ সালের পর যুক্তরাষ্ট্র বেসরকারি ঠিকাদারের সহায়তায় কাবুলে বিমানের মাধ্যমে ২.৬ বিলিয়ন ডলার সহায়তা পাঠিয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ২০২৩ সালের এপ্রিলে জানিয়েছিল, আফগান অর্থনীতি গত দুই বছরে ২৬ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। তাদের মতে, আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়া আফগানিস্তানকে "কোনো অভ্যন্তরীণ উন্নয়নমূলক শক্তি ছাড়াই" ছেড়ে দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, তালেবানের আফিম উৎপাদন নিষেধাজ্ঞার কারণে কৃষকরা ১.৩ বিলিয়ন ডলার আয় হারিয়েছে, যা আফগানিস্তানের মোট দেশজ উৎপাদনের ৮ শতাংশ। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ সংক্রান্ত কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ৪ লাখ ৫০ হাজার চাকরি চলে গেছে এবং আফিম চাষের জন্য ব্যবহৃত জমির পরিমাণ ৯৫ শতাংশ কমে গেছে,
খনিজ সম্পদ উত্তোলন আফিমের বিকল্প হিসেবে একটি স্থিতিশীল আয়ের উৎস হতে পারে। তুরস্ক এবং কাতার, চীন এবং ইরানের সাথে মিলিয়ে লোহা, তামা, সোনা এবং সিমেন্ট খনিতে বিনিয়োগ করেছে। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উজবেক কোম্পানিগুলো আফগানিস্তানের উত্তরে তেল উত্তোলনের চুক্তি করেছে।
তালেবান ইতোমধ্যেই পান্না বিক্রির ওপর কর সংগ্রহ করছে। আগের সরকারের পান্না বাণিজ্য একটি দুর্নীতির ক্ষেত্র ছিল। যুদ্ধকর্তা এবং রাজনৈতিকভাবে যুক্ত ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যে আধিপত্য ছিল এবং কর সংগ্রহ ছিল খুবই এলোমেলো।
কিন্তু তালেবান সরকার সাপ্তাহিক পান্না নিলাম শুরু করার পর, সব বিক্রির ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং কর আরোপ করেছে। যারা নিলামে পান্না কেনেন, তারা ১০ শতাংশ কর পরিশোধ না করা পর্যন্ত রত্নগুলো পান না।তালেবান অন্যান্য মূল্যবান রত্নগুলোর ওপরও কর আরোপ করছে, যেমন রুবি এবং নীলকান্তার।
রত্ন ব্যবসায়ী রহমতুল্লাহ শরিফি বলেন, কর দিতে তার আপত্তি নেই। তিনি বলেন, "দেশের উন্নয়নের জন্য সরকারের টাকা প্রয়োজন। প্রশ্ন হলো, তারা কি এই টাকা আফগান জনগণের সাহায্যে ব্যবহার করবে?"
পাঞ্জশির প্রদেশে তালেবান সরকার বিদেশি ও আফগান বিনিয়োগকারীদের জন্য ৫৬০টি পান্না উত্তোলনের লাইসেন্স ইস্যু করেছে বলে জানিয়েছেন আফগানিস্তানের খনি ও পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুমায়ুন আফগান। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় পাঞ্জশির এবং কাবুল প্রদেশে রুবি (লাল মণি) উত্তোলনের লাইসেন্সও দিয়েছে। এবং আরও তিনটি প্রদেশে পান্না ও মূল্যবান রত্নের লাইসেন্স দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।
কিন্তু অনেক নতুন লাইসেন্স এমন সব খনির জন্য দেওয়া হয়েছে, যেগুলো এখনও চালু হয়নি। এবং অনেক বিদ্যমান খনি খারাপ অবকাঠামো ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলী এবং প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞের অভাবে অচল হয়ে পড়েছে।
হুমায়ুন আফগান স্বীকার করেছেন, দেশটির আরও প্রকৌশলী এবং প্রযুক্তিবিদ প্রয়োজন। তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসে এবং লাইসেন্সের অধীনে তাদের আফগানদের নিয়োগ দিতে ও তাদের প্রযুক্তিগত এবং প্রকৌশল দক্ষতা শেখাতে বাধ্য করা হয়।
পান্না ব্যবসায়ী হাজি গাজী জানান, তার বেশিরভাগ রত্ন সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, ইরান এবং থাইল্যান্ডের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। তিনি আফসোস করে বলেন, তালেবান শাসন আসার আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আগ্রহী ক্রেতারা আসতেন।
তিনি জানান, তার সবচেয়ে বড় পান্নার সেটটি মূল্য সম্ভবত ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার। তিনি হিসাব করে দেখেছেন, একটি ছোট সাইজের উজ্জ্বল রুবির মূল্য ২০ হাজার ডলার।
গাজীর পাশের দোকানের ব্যবসায়ী আজিজুল্লাহ নিয়াজি বলেন, বিক্রির পরিমাণ পূর্বের মতো শক্তিশালী নয়। তিনি এর আগে ১৩ বছর মার্কিন জোটের একটি সামরিক ঘাঁটিতে প্রতি সপ্তাহে এক দিন রত্ন বিক্রি করতে পারতেন। তখন তার লাভ বেড়ে গিয়েছিল কারণ সেনা ও বেসামরিক চুক্তিকারীরা প্রতি শুক্রবার রত্ন কিনতে আসতেন। তারা সাধারণত দাম নিয়ে তর্ক করতেন না, যা আফগান বা আরব ক্রেতাদের মধ্যে দেখা যেত।
নিয়াজি জানিয়েছেন, তিনি তার লাভে ৭ শতাংশ কর দিতেন।
এখন, নিয়াজি বিক্রির পরিমাণ বাড়ানোর জন্য ঘুরে বেড়ান। তিনি জানান, তিনি চীনে একটি দোকান খুলেছেন এবং সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করেন। কাবুলে তিনি দুবাই, পাকিস্তান, ইরান এবং আরও কিছু দেশের ক্রেতাদের কাছে রত্ন বিক্রি করেন। তার কাছে আফগান ক্রেতা কম আসে।
তিনি বলেন, "খুব কম আফগানই ১ হাজার বা ২ হাজার দিয়ে একটি পাথর কিনে আংটি তৈরি করতে পারেন।"
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়