‘মিত্র না কি শত্রু’: ইউরোপের সঙ্গে ট্রাম্পের এবারের সম্পর্ক হতে পারে খুবই আলাদা
"এটা পাগলামি! আমরা সাধারণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। দেশটা ভেঙে পড়েছে। আমাদের অর্থনীতি স্থবির... কিন্তু বেশিরভাগ জার্মান সংবাদমাধ্যম যেন শুধু ট্রাম্প, ট্রাম্প, ট্রাম্প নিয়েই অতিরিক্ত আগ্রহী!"
উত্তর-পূর্ব জার্মানির একটি ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষিকা আইরিস মুলার জার্মানির ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে এই মতামত দিয়েছিলেন। তবে তিনি একাই এ ধারণা পোষণ করেন না।
ইউরোপের প্রধান দেশ জার্মানি ও ফ্রান্স থেকে শুরু করে অন্যান্য দেশ নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকা স্বত্বেও, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয় লাভের পর তার প্রতি অনেক বেশি মনোযোগী হয়েছে।
গতবার যখন ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে ছিলেন, তখন ইউরোপের পরিস্থিতি ছিল বেশ নাজুক। অনেকেই এবার ভয় পাচ্ছেন, ট্রাম্প ২.০ ইউরোপের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর হতে পারে।
ইউরোপের ঐতিহ্যবাহী শক্তি ইতোমধ্যেই তাদের নিজস্ব সমস্যায় জর্জরিত। ফ্রান্স এবং জার্মানি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় প্রতিযোগিতার দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে এবং যুক্তরাজ্যে জনসেবা অত্যন্ত খারাপ অবস্থায় রয়েছে।
তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, ইউরোপ কি ট্রাম্পের জন্য প্রস্তুত?
একজন ব্যবসায়ী, যিনি জোটকে উপেক্ষা করেন
বাণিজ্য এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আচরণ করেন। তিনি বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইউরোপের সঙ্গে গড়ে ওঠা ট্রান্সআটলান্টিক জোটগুলোর তুলনায় লেনদেনের ভিত্তিতে কাজ করেন।
সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছিলেন, "সে (ট্রাম্প) সহজভাবে বিশ্বাস করে না, সকল পক্ষের লাভ হবে এমন সহযোগিতা হতে পারে।" তিনি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তাকে দেখেছেন এবং বলেছেন, ট্রাম্প পৃথিবীকে বিজয়ী এবং পরাজিতদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন।
ট্রাম্প দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ইউরোপ বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রকে শোষণ করেছে এবং সেটি বন্ধ করা দরকার।
গত কিছু সপ্তাহ ধরে যখন ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, ইউরোপের নেতারা হতবাক হয়ে দেখেছেন। তিনি ইউরোপ এবং কানাডার মিত্রদের বিরুদ্ধে খোলামেলা সমালোচনা করেছেন। আর তিনি যাদেরকে কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন, তাদের ওপর আক্রমণ করে থাকেন, যেমন চীন।
ট্রাম্প ন্যাটো (ট্রান্সআটলান্টিক সামরিক জোট) ত্যাগ করার সম্ভাবনার কথা শোনাচ্ছেন। ইউরোপের ন্যাটো জোটভুক্ত দেশগুলো কয়েক দশক ধরে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য এর ওপর নির্ভর করে এসেছে।
ট্রাম্প বলেছেন, যদি ইউরোপীয় মিত্ররা আরও অর্থ না দেয় এবং তাদের প্রতিরক্ষা ব্যয় না বাড়ায়, তাহলে তিনি রাশিয়াকে "যেকোনো কিছু করতে" উৎসাহিত করবেন, এমনকি ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গেও।
বাণিজ্য নিয়ে ট্রাম্প এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আগের মতোই ক্ষুব্ধ, যেমন তিনি তার প্রথম দফায় ছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বেশি পণ্য রপ্তানি করে, তবে কম পণ্য আমদানি করে। ২০২২-এর জানুয়ারিতে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ১৫.৪ বিলিয়ন ইউরো।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি সব বিদেশি পণ্যের ওপর ১০ থেকে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন এবং কিছু পণ্য, যেমন গাড়ির ওপর আরও বেশি শুল্ক আরোপ করবেন।
এটি জার্মানির জন্য একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতি হতে পারে, যেহেতু দেশটি রপ্তানি এবং বিশেষ করে গাড়ি শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। গত বছর দেশটির অর্থনীতি ০.২ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে।
ইউরোজোনের বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে জার্মানির আর্থিক সংকট পুরো মুদ্রা ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
ট্রাম্পের 'হিট লিস্টে' শীর্ষে জার্মানি
সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল বলেছেন, আগের প্রেসিডেন্সিতে ট্রাম্পের জার্মানির প্রতি কোনো বিশেষ ক্ষোভ ছিল বলে তার মনে হয়েছে।
ইউরোপীয় সংস্কার কেন্দ্রের (সিইআর) ডেপুটি পরিচালক ইয়ান বন্ড মনে করেন, জার্মানি এখনও "ট্রাম্পের (ইউরোপীয়) হিট লিস্টের শীর্ষে থাকবে।"
তিনি বলেন, "ট্রাম্প আগে বলেছিলেন, তিনি নিউ ইয়র্কের রাস্তায় কোনো মার্সিডিজ-বেঞ্জ দেখতে চান না। এটা একটু অদ্ভুত, কারণ বাস্তবে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় যে বেশিরভাগ মার্সিডিজ-বেঞ্জ দেখা যায়, তা আলাবামাতে তৈরি। সেখানে মার্সিডিজের একটি বড় কারখানা রয়েছে।"
বন্ড আরও বলেন, "তিনি প্রায়ই জার্মানির প্রতি অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর চেয়ে বেশি শত্রুতা দেখিয়েছেন। এটি নতুন এবং আরও রক্ষণশীল সরকারের অধীনে জার্মানির জন্য কিছুটা সহজ হতে পারে (আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের পর)। তবে আমি আশা করছি না।"
যুক্তরাজ্য ট্রাম্পের শুল্ক থেকে বাঁচতে চায়, কারণ তাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ভারসাম্যহীন নয়। তবে, ইউরোপ-আমেরিকা বাণিজ্যযুদ্ধে দেশটির ওপর বাজে প্রভাব পড়তে পারে।
ইউরোপ আসলে কতটা প্রস্তুত?
ট্রাম্পের আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি তার প্রথম প্রেসিডেন্সি থেকেই মিত্রদের কাছে পরিচিত। তবে ইউরোপের জন্য এখন আসল সমস্যা হলো তার অনিশ্চয়তা: কোথায় শুধুই হুমকি এবং কোথায় কার্যকর পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি?
জার্মান মার্শাল ফান্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইয়ান লেসার মনে করেন, ট্রাম্পের শুল্কের হুমকি বাস্তব এবং ইউরোপ সেটির জন্য প্রস্তুত নয়।
তিনি বলেন, "তারা প্রস্তুত নয়, আসলে কেউই প্রস্তুত নয়। বৈশ্বিক বাণিজ্যে এই ভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি আন্তর্জাতিক অর্থনীতির বহু মৌলিক ভিত্তি নষ্ট করে দিয়েছে, যা দশক ধরে তৈরি হয়েছে।"
ইউরোপীয় কমিশন দাবি করছে, ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে ফিরে আসলে যে কোনো ধরনের পদক্ষেপের জন্য তারা প্রস্তুত। এটি বিশ্ব মঞ্চে একটি বৃহৎ বাণিজ্য শক্তি।
তবে লেসার বলেন, ইউরোপে সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে যদি ট্রাম্প চীন বিরোধী এক আক্রমণাত্মক বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেন। এতে ইউরোপে সরবরাহ চেইন ব্যাহত হতে পারে এবং বেইজিং আরও সস্তা পণ্য ইউরোপীয় বাজারে ছাড়তে পারে, যা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ক্ষতি করবে।
লেসার বলেন, "ইউরোপের জন্য এটি দুই ধরনের ঝুঁকি: একদিকে আমেরিকা যা করতে পারে এবং অন্যদিকে চীন তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যা করবে।"
বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা এবং ইলন মাস্কের প্রভাব
বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠেছে কারণ ট্রাম্প এবং তার প্রশাসনের জন্য বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা আলাদা বিষয় নয়। সম্প্রতি তিনি ডেনমার্ককে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, যদি তারা গ্রিনল্যান্ড [যা একটি স্বায়ত্তশাসিত এলাকা] যুক্তরাষ্ট্রকে না দেয়, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং ন্যাটো সদস্য ডেনমার্কের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক এবং/অথবা সামরিক ব্যবস্থা নিতে তিনি সংকোচ করবেন না।
এছাড়া, ট্রাম্পের নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এই শরতের দিকে শর্তসাপেক্ষে ইউরোপের সাথে প্রতিরক্ষা বিষয়ক সহায়তা চুক্তি করেছেন। তিনি বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম "এক্স"-এর বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে চলমান তদন্ত বন্ধ না করে, তবে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে। "এক্স" ট্রাম্পের প্রিয় ব্যক্তি ইলন মাস্কের মালিকানাধীন।
সম্প্রতি মাস্ক ইউরোপীয় রাজনীতিতে পক্ষ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তিনি বার বার বামকেন্দ্রিক ইউরোপীয় নেতাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক পোস্ট করেছেন, যেমন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এবং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ-এর বিরুদ্ধে। "এক্স"-এ তিনি বলেছেন, জার্মানির একমাত্র আশা হচ্ছে কঠোর অভিবাসন বিরোধী "এএফডি" পার্টি।
এটি ইউরোপে অনেককে চমকে দিয়েছিল। তবে জরিপকারীরা বলছেন, মাস্কের বিতর্কিত পোস্টগুলো ইউরোপীয় জনমতের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলে না।
ট্রাম্প এবং মাস্ককে ইউরোপে ব্যাপকভাবে অবিশ্বাস করা হয়, যা ইউরোপীয় কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্স পরিচালিত একটি নতুন জরিপে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এই জরিপের শিরোনাম ছিল "ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইউএস নির্বাচনের পর বিশ্ব জনমত"।
অহংকারী প্রশংসা থেকে শুরু করে টাকা খরচের কৌশল
শেষ পর্যন্ত, ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে "ট্রাম্পকে সামাল দেওয়া" নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পন্থা রয়েছে, যেমনটা অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানাচ্ছে। কিছু নেতা তার বিশাল অহংকারকে প্রশংসা দিয়ে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করেন।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এখানে বিশেষজ্ঞ। তিনি বিশ্ব নেতাদের মধ্যে অন্যতম প্রথম ব্যক্তি যিনি নভেম্বর মাসে ট্রাম্প পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পর তাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিনন্দন জানান এবং তাকে দ্রুত প্যারিসের নটর ডেম ক্যাথেড্রাল আবারও খুলে দেওয়ার ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান।
ট্রাম্প যখন প্রথমবার হোয়াইট হাউজে ছিলেন, মাখোঁ তাকে প্যারিসে বাস্তিল ডে-এর বার্ষিক প্যারেডে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে মুগ্ধ করেছিলেন।
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্য জানে ট্রাম্পের স্কটল্যান্ডের প্রতি বিশেষ ভালবাসা রয়েছে। সেখানে তার মা জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রতি তার আগ্রহও রয়েছে। তিনি ২০১৯ সালে (এখন মৃত) রানি এলিজাবেথের সাথে রাষ্ট্রীয় ভোজে যোগ দেওয়ার সময় বিশেষভাবে আনন্দিত হয়েছিলেন। এই শরতে তিনি প্রিন্স উইলিয়ামের সাথে সাক্ষাৎ করার পর তার প্রশংসা করেছেন।
ইউরোপের অন্য নেতা-নেত্রীরা বেশি বেশি টাকা খরচ করার কৌশল গ্রহণ করেছেন।
ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (ইসিবি) প্রধান ক্রিস্টিন লেগার্ড ইউরোপীয় নেতাদের পরামর্শ দিয়েছেন, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শুল্কের বিরুদ্ধে পালটা ব্যবস্থা নেওয়ার চেয়ে তার সাথে "চেক-বুক কৌশল" গ্রহণ করে আলোচনা করা উচিত।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন ইউরোপের শক্তির সরবরাহ বৈচিত্র্যকরণের অংশ হিসেবে আরও (মূল্যবান) মার্কিন তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার কথা বলছেন। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আক্রমণ শুরুর পর ইউরোপ সস্তা রাশিয়ান গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে কাজ করছে।
কমিশনের সূত্রগুলো আরও বলছে, ইউরোপ সম্ভবত আরও মার্কিন কৃষি পণ্য এবং অস্ত্রও কিনতে পারে।
ইউরোপের কি আরও স্বাবলম্বী হওয়া উচিত?
এদিকে, মাখোঁ দীর্ঘদিন ধরে "কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন"-এর পক্ষে কথা বলেছেন, যা মূলত ইউরোপকে আরও স্বাবলম্বী হতে শেখার পরামর্শ দেয় এবং যাতে তারা টিকে থাকতে পারে।
তিনি এ বছরের বসন্তে বলেছিলেন, "ইউরোপ... মরে যেতে পারে এবং এটি পুরোপুরি আমাদের পছন্দের ওপর নির্ভর করে।"
কোভিড-১৯ ইউরোপকে দেখিয়েছে, তারা চীনা আমদানি যেমন ওষুধের ওপর কতটা নির্ভরশীল। ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আক্রমণ ইউরোপের রাশিয়ান শক্তির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা ফুটিয়ে তুলেছে।
মাখোঁ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে সতর্কবার্তা দিচ্ছেন: "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি অগ্রাধিকার রয়েছে। প্রথমটি, ইউএসএ, যা বৈধ এবং দ্বিতীয়টি চীন সমস্যা। এবং ইউরোপীয় সমস্যা আগামী বছর এবং দশকগুলোতে ভূরাজনৈতিক অগ্রাধিকার নয়।"
ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে ফিরে আসা ইউরোপীয় নেতাদেরকে মহাদেশীয় দুর্বলতা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করছে।
সুরক্ষা নিয়ে বড় প্রশ্ন
সুরক্ষা নিয়ে ট্রাম্পের ইউরোপকে আরও বেশি খরচ করতে বলার ব্যাপারে সাধারণভাবে সম্মতি রয়েছে (যদিও কতটা বেশি খরচ করতে হবে, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে)। তবে ট্রাম্প যেখানে জিডিপির ভিত্তিতে খরচ বাড়ানোর কথা বলেন, ইউরোপীয়রা মহাদেশীয় নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে সেসব খরচ কীভাবে আরও কার্যকরভাবে এবং একত্রে পরিচালনা করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করছেন।
ইমানুয়েল মাখোঁ ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য একটি শিল্পকৌশলগত প্রতিরক্ষা নীতি চান। তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়েছে "আমাদের বিভাজন একটি দুর্বলতা... আমরা কখনও কখনও ইউরোপীয়রা আবিষ্কার করেছি যে আমাদের বন্দুকে একই ক্যালিবার ছিল না, আমাদের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো একে অপরের সাথে মেলেনি।"
ইউরোপ চিন্তা করছে, ট্রাম্প হয়ত ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার প্রধান স্পন্সর হিসেবে তার ভূমিকা চালিয়ে যেতে চান না, যেটি বাইডেন প্রশাসনের অধীনে ছিল।
আগামী মাসে, ইইউ নেতারা যুক্তরাজ্যকে [ ইউরোপের দুইটি বড় সামরিক শক্তির একটি] একটি অনানুষ্ঠানিক সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, যাতে তারা নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা নিয়ে একসাথে আরও ভালোভাবে কাজ করার বিষয়টি আলোচনা করতে পারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিরক্ষা প্রধান এবং প্রাক্তন এস্তোনীয় প্রধানমন্ত্রী কায়া কালাস বিশ্বাস করেন, ইউরোপীয় ঐক্য প্রয়োজন। তিনি বলেন, "আমাদের একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। তখন আমরা শক্তিশালী। তারপর, আমরা বিশ্বমঞ্চে আরও গুরুত্বপূর্ণ।"
এখনকার ইউরোপ: দুর্বল এবং আরও বিভক্ত?
বিশ্লেষকরা বলেন, ২০১৬ সালে ট্রাম্প প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার সময়ের তুলনায় ইউরোপ এখন অনেক দুর্বল এবং আরও বিভক্ত অবস্থায় রয়েছে। কারণ, ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং রাজনীতি অস্থিরতা।
পপুলিস্ট ন্যাশনালিস্ট ইউরোসেপ্টিক দলগুলো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শক্তি অর্জন করছে। কিছু দল, যেমন জার্মানির এফডি মস্কোর প্রতি সহনশীল; আবার অন্যরা, যেমন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ট্রাম্পের সাথে আটলান্টিক সম্পর্ককে ইউরোপীয় ঐক্যের চেয়ে গুরুত্ব দিতে পারেন।
অর্থনৈতিকভাবে উত্তর ইউরোপ ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ভালো অবস্থায় ছিল। তবে ঐক্যগতভাবে ২০১৫ সালের অভিবাসন সংকটের পর মহাদেশটি গভীরভাবে বিভক্ত ছিল। তখনও পপুলিস্ট ইউরোসেপ্টিক দলগুলো শক্তি পাচ্ছিল এবং ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট ভোটের পর ব্যাপকভাবে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন শীঘ্রই আরও সদস্য দেশ হারিয়ে ফেলবে এবং পুরোপুরি ভেঙে যাবে।
এখন ২০২৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্রেক্সিট, কোভিড মহামারি, অভিবাসন সংকট এবং ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদ কাটিয়ে উঠেছে এবং রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আক্রমণের পর দেশগুলো একত্রিত হয়েছে।
এটা ছিল এক ধরনের হোঁচট খাওয়া, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনও দাঁড়িয়ে আছে এবং উদাহরণস্বরূপ, ব্রেক্সিটের ক্ষতগুলো সময়ের সাথে সেরে উঠেছে।
ব্রেক্সিট পরবর্তী যুক্তরাজ্য এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে এমন একটি ঘনিষ্ঠ মিত্র, যেটি একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী চীন, সম্প্রসারণবাদী রাশিয়া এবং অপ্রত্যাশিত ইউএস প্রেসিডেন্টের বিপরীতে একসাথে কাজ করতে চায়।
এদিকে, ন্যাটো যদিও ট্রাম্পের অঙ্গীকার নিয়ে উদ্বিগ্ন, তবুও সুইডেন এবং রাশিয়ার প্রতিবেশী ফিনল্যান্ডের সদস্যপদ পাওয়ার পর সামরিক এবং ভূরাজনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী হয়েছে।
হয়ত, ট্রাম্প এবার ইউরোপের সম্পর্কে কম বিরক্ত এবং হতাশ হবেন।
এটা এমন ইউরোপ যা তার (ট্রাম্প) চাহিদা অনুযায়ী প্রতিরক্ষা ব্যয়ে বাড়তি খরচ করার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছে, যেটা চীন সম্পর্কে তার প্রত্যাশা পূরণ করছে এবং যেখানে তার পছন্দ মতো আরও ডানপন্থি রাজনীতি গতি পাচ্ছে।
তবে, প্রশ্ন থেকেই যায়: এই ইউরোপের নেতারা কি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, যদি তিনি মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা বা স্বৈরশাসকদের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করেন?
ট্রান্সআটলান্টিক মিত্র-শত্রুদের মধ্যে সম্পর্কের পরবর্তী অধ্যায় লেখা বাকি।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়