ট্রাম্পের উদ্বোধনী ভাষণের সেরা ও সবচেয়ে খারাপ মুহূর্ত
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে গতকাল সোমবার অভিষেক হয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের। ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন তিনি। যেখানে তুলে ধরেন তার প্রশাসনের নীতি ও পরিকল্পনার দিকনির্দেশনা। তার দ্বিতীয় মেয়াদে আমেরিকাকে স্বর্ণ যুগে ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়াসহ ট্রাম্প তাঁর ভাষণে উল্লেখযোগ্য কিছু মন্তব্য করেছেন। যারমধ্যে সদ্য বিদায় নেওয়া বাইডেন প্রশাসনের প্রতি 'ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতার' অভিযোগও করেন। একইসঙ্গে আমেরিকাকে আবারো 'মুক্ত, সমৃদ্ধ ও গর্বিত' দেশ হিসেবে গড়ার অঙ্গীকার করে বলেন, 'আমেরিকা হবে বিশ্বের সব জাতির জন্য ঈর্ষণীয়'। ট্রাম্পের এই উদ্বোধনী ভাষণের বিশ্লেষণ করেছেন প্রভাবশালী মার্কিন গণমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতামত কলাম লেখকরা। নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে এই ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ নানান দিক নিয়ে মন্তব্য করেন তাঁরা।
সেরা মুহূর্তগুলো
ক্রিস্টেন সলটিস অ্যান্ডারসন: তাঁর ভাষণের সমাপণী অংশ আমার সবচেয়ে ভালো লেখেছে। যেখানে তার সেরা উক্তি মনে হয়েছে, 'উচ্চাকাঙ্ক্ষাই একটি মহান জাতির প্রাণশক্তি' – এই কথাটি। এভাবে জাতিকে এক সাহসী অভিযাত্রা ও উচ্চতার শীর্ষে পৌঁছানোর আহ্বান শক্তিশালী আবেদন সৃষ্টি করে। ট্রাম্প বলেছেন, জাতি হিসেবে আমেরিকা পতনের মুখে, তবে তার কথার মূল প্রতিপাদ্য পতন ছিল না। বরং ছিল উচ্চতার নতুন শিখরে পৌঁছানোর ডাক। এজন্যই তিনি বলেছেন, 'আত্মবিশ্বাসী ও আশাবাদী হয়ে আমি প্রেসিডেন্ট পদে ফিরেছি।'
জশ ব্যারো: অভিষেক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প সারাবিশ্বে আমেরিকান জ্বালানি রপ্তানির অঙ্গীকার করেছেন। আমার মতে, এটি অত্যন্ত চতুর একটি পদক্ষেপ, যা দেশের অর্থনীতিকে বেগবান করবে, ভোক্তাপর্যায়ে মূল্য কমাবে। একইসঙ্গে ইউরোপও রাশিয়ান জ্বালানির একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প পাবে। ফলে ওপেক এর ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমবে।
রস ডোথেট: এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মঙ্গলগ্রহে আমেরিকার পতাকা স্থাপনের কথা বলে ট্রাম্প নিঃসন্দেহে দারুণ উচ্চাকাঙ্ক্ষা্র প্রকাশ করেছেন। কিন্তু, মাউন্ট ম্যাককিনলির নাম পরিবর্তন করবেন এটাও বলেছেন, যেটি বিতর্কিত। এই দুটি বিষয় মিলিয়ে তাঁর কাছে অভিষেক ভাষণকে মোটামুটি লেগেছে।
মারা গে: মার্কিন জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে— ট্রাম্পের এই স্বীকারোক্তিটি আমার ভালো লেগেছে, কারণ এটা সত্য। তাছাড়া, হলভর্তি বিলিয়নেয়ারদের সামনে ট্রাম্প দৃঢ়ভাবেই শুল্ক আরোপের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এটা শুনেও তাঁদের তালি দিতে হয়েছে। এই বিষয়টি আমি বেশ উপভোগ করেছি।
মিশেল গোল্ডবার্গ: ঠাট্টার কোনো বিষয় না। আমার মনে হয়েছে, সরকার পরিচালনায় সবচেয়ে অযোগ্যদের নিয়ে গঠিত এই প্রশাসনের প্রধান ব্যক্তির ভাষণের সেরা কোনো মুহূর্ত নেই। কারণ, ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরাই এক সময় নিন্দনীয় অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছেন।
ম্যাট লাবাশ: অভিষেক অনুষ্ঠান হয় ক্যাপিটল রোটুন্ডায়। সেখানে আসন সংখ্যা সীমিত, ফলে ট্রাম্প তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানে বিশাল জনসমাগম হয়েছে বলে মিথ্যাচার করতে পারেননি, যেমনটা এর আগের বার করেছিলেন। তবে আমার মনে হয় না, এতে তিনি দমে যাবেন। এবিষয়ে তিনি রীতিমতো দক্ষ।
ক্যাথেরিন মাংগু ওয়ার্ড: ট্রাম্প তাঁর ভাষণের বাকস্বাধীনতা অংশে বলেছেন, 'ফেডারেল সরকার বছরের পর বছর ধরে অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর সেন্সর আরোপ করেছে, এবার আমি একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করে সব ধরনের সরকারি সেন্সরশিপ বন্ধ করব। আমেরিকায় বাকস্বাধীনতা ফিরিয়ে আনব।'
ট্রাম্প তাঁর প্রথম মেয়াদের বক্তৃতাগুলোতে প্রতিপক্ষকে আক্রমণের ক্ষেত্রে ভাষাগত ত্রুটির ধার ধারতেন না এবং বিস্ময়করভাবে আত্ম-সচেতন ছিল না। সেখানে থেকে অনেকটা পরিবর্তন চোখে পড়েছে। তাছাড়া, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে প্রেসিডেন্টের অগ্রাধিকার দেওয়া অন্তত দিকনির্দেশকভাবে সঠিক।
ড্যানিয়েল ম্যাককার্থি: কূটনীতি এবং (সামরিক) শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন ট্রাম্প। আমার কাছে তাঁর (ভাষণের) সেরা মুহূর্তটি হচ্ছে, যখন তিনি বললেন, 'যেসব লড়াইয়ে আমরা জিতব— শুধু তাদের মানদণ্ডেই নিজেদের সফলতাকে মাপব না। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো— যেসব লড়াইয়ে আমরা কখনোই জড়াব না— সেগুলোকেও হিসাবে ধরা।'
বেন রোডস: ট্রাম্প কী করতে যাচ্ছেন—- সে সম্পর্কে যথেষ্ট স্পষ্টভাবে বলেছেন, যা তিনি সচরাচর করেন না। যেমন তিনি তাঁর মনমতো সরকার গঠন থেকে শুরু করে সীমান্ত দিয়ে অভিবাসন বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া এবং তেল,গ্যাস ও বাণিজ্য নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তাঁর এজেন্ডা আপনি যাই মনে করুন না কেন, সামনে কী কী আসছে— আমরা তা স্পষ্টভাবে আন্দাজ করতে পারছি।
চাক রোচা: ট্রাম্পের বক্তব্য দেখিয়েছে কেন তিনি নির্বাচনে জিতেছেন। তিনি আমেরিকার শ্রমজীবী শ্রেণির ক্ষোভ- আক্ষেপকে-বুঝতে পারেন। এজন্য আমেরিকার উৎপাদন শিল্পগুলোকে পুনর্গঠন থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মানুষ ক্ষুদ্ধ হয়ে আছে, তাঁরা মনে করেন, কোনো সরকার তাঁদের কথা শোনে না। কিন্তু ট্রাম্প বলেছেন, আমি তোমাদের কথা শুনি।
ম্যাথু স্কিমিৎজ: 'উগ্র ও দুর্নীতিপরায়ণ প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির' কঠোর নিন্দা করেছেন ট্রাম্প। এটাই ছিল তাঁর উদ্বোধনী ভাষণের সেরা মুহূর্ত। এসব কথার মাধ্যমে তিনি স্পষ্টভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, যে কেন অনেক মামলা-মোকদ্দমার সম্মুখীন হওয়ার পরেও— আমেরিকানরা তাঁকে ভোট দিয়ে হোয়াইট হাউসে ফিরিয়ে এনেছে। মামলাগুলো ট্রাম্পের মানহানি করেনি, বরং যেসব ব্যক্তি এসব মামলা করেন— তাঁদেরই করেছে।
মেগ্যান কে. স্ট্যাক: অন্তহীন যুদ্ধের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের জোগান দিতে দিতে এখন ক্লান্ত আমেরিকার মানুষ। এসব যুদ্ধের ফলে আমাদের বৈশ্বিক অবস্থানের – কোনো অগ্রগতি তো হয়ই না – হয় শুধু ক্ষতি। এজন্য যুদ্ধ অবসানের মাধ্যমেও আমেরিকাকে তাঁর সাফল্য মাপতে হবে— একজন রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে এ বক্তব্য শোনাটা বহুল কাঙ্ক্ষিত ছিল।
খারাপ মুহূর্তগুলো
ক্রিস্টেন সলটিস অ্যান্ডারসন: আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, মেক্সিকো উপসাগরকে 'গালফ অব আমেরিকা' নামকরণ করাটা ট্রাম্পের উদ্বোধনী ভাষণের চূড়ান্ত খসড়াতেও থাকবে। এটি হতাশাজনক। এত বড় উপলক্ষের দিন — এই ধরনের মামুলি কথাবার্তার জন্য নয়।
জশ ব্যারো: শুল্কের বিষয়ে ট্রাম্পের আজগুবি বিশ্বাস হতাশ করেছে। যেমন তিনি বলেছেন, 'আমরা অন্য দেশগুলোর ওপর শুল্ক ও কর বসিয়ে আমাদের নাগরিকদের সমৃদ্ধ করব।' কিন্তু, বাণিজ্য শুল্ক তো এভাবে কাজ করে না। বাণিজ্যে শুল্ক আরোপ— হয় মার্কিন ক্রেতাদের জন্য পণ্যমূল্য বাড়াবে, নাহলে ডলারের দরকে শক্তিশালী করবে। আর ডলার শক্তিশালী হলে— আমেরিকায় উৎপাদনমুখী শিল্পকে পুনর্জীবিত করার যে লক্ষ্য ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন— সেটি ব্যাহত হবে।