খালকে টাকার মেশিনে পরিণত করেছে পানামা, ট্রাম্পের হুমকি একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়
আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযুক্তকারী প্রকৌশল বিস্ময় পানামা খাল এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ইতিহাসের অংশ। এটি ২৫ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পানামার কাছে হস্তান্তর করা হয়। তবে এখন আবার জলপথটি নতুন হুমকির মুখে।
গত সোমবার (২০ জানুয়ারি) শপথ গ্রহণের ভাষণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পানামা খাল পুনরায় মার্কিন নিয়ন্ত্রণে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেন, "এটি কখনোই [পানামাকে] দেওয়া উচিত হয়নি। পানামা তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে এবং আমাদের নৌবাহিনীর ওপর বাড়তি চার্জ আরোপ করছে।"
ট্রাম্প আরও অভিযোগ করেন, "চীন এখন পানামা খাল পরিচালনা করছে।" যদিও এই দাবির পক্ষে তিনি কোনো প্রমাণ দেননি। বরং তিনি জোর দিয়ে বলেন, "আমরা এটি চীনকে দিইনি, দিয়েছিলাম পানামাকে। আর এখন এটি আমরা ফেরত নিতে যাচ্ছি।"
পানামার কর্মকর্তারা এ অভিযোগগুলোকে ভিত্তিহীন এবং হাস্যকর বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তারা দাবি করেছেন, পানামা খালের ব্যবস্থাপনায় চীনের কোনো প্রভাব নেই এবং বাড়তি চার্জ আরোপের অভিযোগও সত্য নয়।
পানামার সাধারণ জনগণের কাছে খালটি শুধু একটি জলপথ নয়; এটি তাদের জাতীয় গর্বের প্রতীক এবং দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। ২০২৪ সালে খালটি প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার মুনাফা করেছে। আইডিবি ইনভেস্টের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, পানামার বার্ষিক আয়ের প্রায় ২৩.৬% খাল এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত পরিষেবা থেকে আসে।
"তিনি [ট্রাম্প] শুধু দশ হাজার সৈন্য নামালেই হবে, আর কিছু করতে হবে না," মন্তব্য করেন পানামায় জন্মগ্রহণকারী লেখক ওভিদিও ডিয়াজ-এসপিনো। তিনি আরও বলেন, "কারণ, আমাদের কোনো সেনাবাহিনী নেই।"
১৯০৩ সালে পানামা ছিল কলম্বিয়ার একটি প্রদেশ, যা দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলার শিকার ছিল। তবে ইস্থমাস অঞ্চলটি একটি আন্তঃমহাসাগরীয় খাল তৈরির জন্য আদর্শ বলে বিবেচনা করা হয়।
১৮৮০-এর দশকে ফ্রান্স প্রথমে খাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ফার্ডিনান্ড ডি লেসেপসের নেতৃত্বাধীন ওই প্রকল্প আর্থিক দুর্নীতি এবং হলুদ জ্বর ও ম্যালেরিয়ার মতো রোগে শ্রমিক মৃত্যুর কারণে ব্যর্থ হয়।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র এ প্রকল্পের দায়িত্ব গ্রহণ করে। কলম্বিয়ার সঙ্গে চুক্তি করতে ব্যর্থ হওয়ার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট পানামার স্বাধীনতা আন্দোলনে সমর্থন দেন। মার্কিন নৌবাহিনী আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের দুই উপকূলে অবস্থান নেয়। পানামা স্বাধীনতা অর্জন করে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি তাদের অসন্তুষ্ট করে। এ চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র খাল পরিচালনার বিনিময়ে বার্ষিক একটি নামমাত্র অর্থ প্রদান করত।
পানামার জনগণের অভিযোগ ছিল, ফরাসি রাষ্ট্রদূত ফিলিপ-জিন বুনাউ-ভারিলা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে তাদের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছিলেন। তবে মার্কিন সমর্থন ছাড়া স্বাধীনতা বজায় রাখা সম্ভব হতো না, তাই পানামার পক্ষে কিছু করার ছিল না।
খাল নির্মাণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবীয় অঞ্চল থেকে শ্রমিক আমদানি করে। ১৯১৩ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন হোয়াইট হাউস থেকে টেলিগ্রাফের মাধ্যমে পানামা খালের চূড়ান্ত বিস্ফোরণের নির্দেশ দেন।
মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন পানামা খাল দ্রুতই যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও নৌবাহিনীর জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। খালের বিনিময়ে পানামা প্রথমে ১০ মিলিয়ন ডলার পায় এবং পরে প্রতি বছর আড়াই লাখ ডলার করে পেতে থাকে। তবে অনেক পানামাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করেন, কারণ খালটি তাদের দেশকে দুই ভাগে বিভক্ত করার পাশাপাশি তাদের ব্যবহারের জন্যও নিষিদ্ধ ছিল।
লেখক ওভিদিও ডিয়াজ-এসপিনো বলেন, "এটি ছিল এক ধরনের উপনিবেশবাদ। দেশটি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল, আর পানামাবাসীরা খালের এলাকায় প্রবেশ করতে পারত না। সেখানে গল্ফ কোর্স ও বিনোদন কেন্দ্র ছিল, অথচ অন্য পাশে ছিল পানামার বাস্তব চিত্র।"
১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে উত্তেজনা চরমে ওঠে। খালের নিষিদ্ধ ক্যানাল জোনে বিক্ষোভকারীরা পানামার পতাকা উত্তোলনের চেষ্টা করলে দাঙ্গা শুরু হয়। এতে ২২ জন পানামিয়ান ছাত্র এবং চারজন মার্কিন মেরিন নিহত হন।
১৩ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও পানামার মধ্যে খাল হস্তান্তর নিয়ে আলোচনা চলার পর ১৯৭৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও পানামার নেতা ওমর টোরিজোস একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে খালটি সম্পূর্ণরূপে পানামার হাতে হস্তান্তরিত হয়।
চুক্তি স্বাক্ষরের সময় প্রেসিডেন্ট কার্টার বলেছিলেন, "বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বলপ্রয়োগের ওপর নয়, ন্যায্যতার ওপর ভিত্তি করেই হওয়া উচিত।"
তবে চুক্তিতে একটি শর্ত রাখা হয়েছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রকে খাল খোলা রাখার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপের অধিকার দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই শর্তটি খাল পুনরুদ্ধারের হুমকিতে ব্যবহার করতে পারেন।
২০০৭ সালে পানামা খালের সম্প্রসারণ প্রকল্প শুরু হয়, যা ছিল এর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উন্নয়ন। নতুন লক সিস্টেম নির্মাণের ফলে বড় জাহাজগুলো খালের মধ্য দিয়ে চলাচলের সুযোগ পায়। এই প্রকল্পে ব্যয় হয় ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি এবং ২০১৬ সালে এটি কার্যকর হয়। এর ফলে খালের পরিবহন সক্ষমতা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায়।
পানামা খালের প্রাক্তন প্রশাসক জর্জ লুইস কুইজানো বলেন, "এটি আমরা নির্মাণ করেছি, এর জন্য আমরাই অর্থ দিয়েছি। বর্তমানে খালের ৫৫ শতাংশের বেশি আয় আমাদের বিনিয়োগ থেকে আসে, যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ থেকে নয়, যা বহু আগেই শেষ হয়েছে।"
বর্ধিত পানামা খাল এখন পানামার জন্য একটি বিশাল আয়ের উৎস। এটি দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রেখেছে, যেখানে মধ্য আমেরিকার অন্যান্য অনেক দেশ দারিদ্র্য ও মাদক পাচারের সমস্যায় জর্জরিত।
পানামা খাল বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, যেখানে ৫ শতাংশ সামুদ্রিক যান চলাচল করে। ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, "পানামা ওই খাল দিয়ে প্রচুর অর্থ কামিয়ে নিচ্ছে। এটির ফলে অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এটি বিনামূল্যে দিয়ে একটি বড় ভুল করেছে।"
পানামার কর্মকর্তারা ট্রাম্পের মন্তব্যকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো বলেন, "পানামা খাল আমাদেরই ছিল এবং থাকবে। এর প্রশাসন আমাদের হাতেই থাকবে।"
তবু মার্কিন হস্তক্ষেপের শঙ্কা পুরোপুরি দূর হয়নি। লেখক ওভিদিও ডিয়াজ-এসপিনো বলেন, "পানামা খাল আমাদের কাছে তেলের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। এটি দখলের হুমকি সৌদি আরবের তেলের কূপ কেড়ে নেওয়ার মতোই মনে হবে। এর ফলে আমরা ঋণে ডুবে যাব এবং আয়ের প্রধান উৎস হারাব।"