ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ট্রাম্প-পুতিন ফোনালাপের পর দুশ্চিন্তা বাড়ছে ইউরোপের
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/14/681b7590-ea09-11ef-965c-c7cc57a42430.jpg.jpg)
বৃহস্পতিবার সকালে ন্যাটো সদর দপ্তরে পৌঁছানোর পর, ইউরোপের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা একটি সাধারণ বার্তা দিয়েছিলেন– ইউক্রেন এবং ইউরোপের উপস্থিতি ছাড়া ইউক্রেন সম্পর্কে কোনো আলোচনা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র কতটুকু শুনছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বুধবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে এক "দীর্ঘ এবং অত্যন্ত ফলপ্রসূ" ফোনালাপে অংশ নিয়েছেন। উভয় নেতা ইউক্রেনের যুদ্ধের অবসান নিয়ে আলোচনা শুরু করার বিষয়ে সম্মত হন।
মার্কিন ঘোষণার জন্য ইউরোপের নেতারা প্রস্তুত ছিলেন না। তারা শঙ্কিত, ইউক্রেন নিয়ে কোনো চুক্তিতে তাদের অবজ্ঞা করা হতে পারে এবং ইউরোপীয় নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের কোনো মতামত নেওয়া হবে না।
জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেরবক বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপ "আচমকা" ছিল, যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কয়েক মাস ধরে যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তি চাচ্ছিলেন।
যুক্তরাজ্যের জন হিলি বলেছেন, "ইউক্রেন ছাড়া ইউক্রেন নিয়ে কোনো আলোচনা হতে পারে না।"
ডাচ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রুবেন ব্রেকেলম্যানস সতর্ক করে বলেছেন, "এটি ইউরোপের জন্যও প্রযোজ্য, কারণ যা কিছু আলোচনা হয় তা ইউরোপেও প্রভাব ফেলবে। তাই আমরা মনে করি, ইউরোপেরও আলোচনার টেবিলে বসা উচিত।"
পোলিশ প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড তুস্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক্স-এ এই বার্তার প্রতি আরো জোর দিয়ে বলেন, "আমাদের যা দরকার তা হলো শান্তি। একটি ন্যায্য শান্তি। ইউক্রেন, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রকে একসাথে এই বিষয়ে কাজ করতে হবে। একসাথে।"
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টতই তার ন্যাটো মিত্র এবং ইউক্রেনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ ন্যাটো সদর দপ্তরে দুই দিন সময় কাটাচ্ছেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
কিন্তু ইউরোপের সমস্যা, বিশেষ করে ইইউ-এর সমস্যা হলো, এটি একক কণ্ঠে কথা বলতে এবং একটি ঐক্যবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করতে সংগ্রাম করছে।
ইইউ-এর সবচেয়ে পরিচিত মুখ উর্সুলা ভন ডার লেন এই সপ্তাহে হেগসেথের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু তারপর থেকে তিনি খুব কমই প্রকাশ্যে এসেছেন।
ইউরোপের নেতাদের কাছে ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার পর্যাপ্ত সময় ছিল। কিন্তু এখন তারা ভাবছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের কথা শুনছে কি না কিংবা তাদের বার্তাগুলো পড়ছে কি না।
বুধবার রাতের দিকে যুক্তরাজ্য পোল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং স্পেনের সঙ্গে যোগ দিয়ে বলেছে, ইউরোপীয় মহাদেশের নিরাপত্তা "আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব" এবং ট্রান্সআটলান্টিক নিরাপত্তার জন্য ইউক্রেনে একটি ন্যায্য এবং স্থায়ী শান্তি প্রয়োজন।
বেরবক জার্মান রেডিওকে বলেছেন, স্পষ্টতই ইউক্রেনকে দেওয়া মার্কিন সামরিক ইউরোপের পোকশে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব না। তবে, মার্কিন স্বার্থের জন্য একটি শক্তিশালী ইউরোপ গুরুত্বপূর্ণ এবং এটা পরিষ্কার করতে হবে, "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও আমাদের প্রয়োজন"।
ফিনিশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর টাইনে কারজালাইনেন বলেছেন, ইউরোপ ট্রাম্পের উদ্যোগের জন্য অপেক্ষা করার পরিবর্তে আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন দাবি করতে পারত। তিনি বলেন, "এখন যে মন্তব্যগুলো দেখা যাচ্ছে... আমি ভয় পাচ্ছি, এগুলো শক্তির প্রতীক নয়, দুর্বলতার প্রতীক।"
এ পর্যন্ত ট্রাম্পের শান্তি প্রচেষ্টায় ইউরোপের জন্য কোনো স্পষ্ট স্থান নেই এবং সম্ভবত কিয়েভের জন্যও তা যথেষ্ট নয়। এখন পর্যন্ত একটি সাধারণ সমঝোতা ছিল, ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ইউক্রেন ছাড়া কোনো আলোচনা হওয়া উচিত নয়।
ট্রাম্প রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সশরীর সাক্ষাৎ করার পরিকল্পনা করছেন, সম্ভবত সৌদি আরবে। তবে তারা ইতোমধ্যেই একটি দীর্ঘ ফোন কলের মাধ্যমে পরিকল্পনা অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পরে ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও সংক্ষিপ্ত ফোনালাপ করেন।
জেলেনস্কি প্রথমে বলেছিলেন,"রাশিয়া এবং পুতিনকে শান্তির জন্য চাপ দিতে আমেরিকার শক্তি যথেষ্ট।"
কিন্তু বৃহস্পতিবার খেরসন শহরে একটি সফরে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেন দ্বিপাক্ষিক আলোচনা বা "আমাদের ছাড়া কোনো চুক্তি" মেনে নেবে না।
পোলিশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স-এর আলেক্সান্দ্রা কোজিওল বলেছেন, "পুতিন আশা করছেন, শুধু ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করে তিনি আরও সুবিধাজনক শর্তে আলোচনা করতে পারবেন।"
কোজিওল বলেন, "এভাবে তিনি নিজেকে এমন এক নেতা হিসেবে উপস্থাপন করবে, যিনি অন্য একটি সুপারপাওয়ারের সঙ্গে সমান ভিত্তিতে আলোচনা করেন।"
ইউরোপীয় নেতাদের উদ্বেগ হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ত ইতোমধ্যেই রাশিয়ার যুদ্ধ লক্ষ্য পূরণের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেছে এবং হয়ত আরও এগিয়ে যেতে পারে।
ইউক্রেনের ধারাবাহিক দাবি ছিল তার সার্বভৌম ভূখণ্ড থেকে রুশ সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং তার রাষ্ট্রীয় সীমান্তে ইউক্রেনীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
ট্রাম্প এবং হেগসেথের মন্তব্য দেখে মনে হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে রাশিয়ার ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ও ডোনবাসের পূর্বাঞ্চল দখলকে একটি অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা হিসেবে বিবেচনা করছে এবং ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেবে না।
ট্রাম্প আরও যোগ করেছেন, ইউক্রেনের "কোনো এক সময়" নতুন নির্বাচন দরকার। এটি পুনরায় পুতিনের একটি বিভ্রান্তিকর ধারণাকে সমর্থন করে– জেলেনস্কি আর বৈধ নেতা নন। তবে, বর্তমানে যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে সামরিক আইন চলমান রয়েছে।
হেগসেথ দৃঢ়ভাবে দাবি করেছেন, কিয়েভের প্রতি কোনো বিশ্বাসঘাতকতা হয়নি। তবে জার্মানির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বোরিস পিস্টোরিয়াস বলেছেন, "এটি দুঃখজনক যে... ট্রাম্প প্রশাসন আলোচনা শুরু হওয়ার আগেই পুতিনকে কিছু ছাড় দিয়েছে।"
তিনি বলেন, "ইউক্রেনের সম্ভাব্য ন্যাটো সদস্যপদ বা দেশের অঞ্চল হারানোর বিষয়টি কেবল আলোচনার টেবিলে আলাপ করা উচিত ছিল, আগে থেকে সেটি বাদ দেওয়া উচিত ছিল না।"
ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক রুত্তে বলেন, কোনো চুক্তি ভেঙে পড়া উচিত নয়, যেমনটি আগে রাশিয়ার সঙ্গে হয়েছিল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমিশনের মুখপাত্র অ্যানিটা হিপার সতর্ক করে বলেন, "রাশিয়া আক্রমণকারী, তাই তাকে পুরস্কৃত করা উচিত নয়। কোনো চুক্তি অবশ্যই টেকসই হতে হবে, না হলে আরও যুদ্ধ হবে। ইউরোপীয় সরকারগুলো ইউক্রেনের শহর পুনর্নির্মাণে সহায়তার জন্য প্রস্তুত। তবে ট্রাম্প ইউরোপীয় সেনাদেরও চেয়ে থাকতে পারেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য।"
পোল্যান্ড, বাল্টিক রাষ্ট্র এবং নর্ডিক দেশগুলো রাশিয়ার শক্তি বাড়ানো নিয়ে চিন্তিত। হেগসেথ ইউরোপীয়দের রাশিয়ার "যুদ্ধযন্ত্র"-এর বিরোধিতা করার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
তিনি ট্রাম্পের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, "ইউরোপকে ৫ শতাংশ জিডিপি প্রতিরক্ষা খাতে খরচ করতে হবে।"
অনেক ইউরোপীয় দেশ এমন খরচ করতে পারেনি। তবে পোল্যান্ড ৪.৭ শতাংশ এবং লাটভিয়া ৩.৪৫ শতাংশ খরচ করবে। অন্যদিকে, জার্মানি ২ শতাংশ খরচ করেছে এবং স্পেন ও পর্তুগাল ২০২৯ সালে ২ শতাংশে পৌঁছাতে চায়।
লুক্সেমবার্গের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউরিকো ব্যাকেস বলেন, সংখ্যার ওপর নয়, পরিকল্পনা এবং আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী বিনিয়োগ হওয়া উচিত।