ক্যাসিনো কাণ্ড: সম্রাটের জামিন কি বাকিদেরও পথ দেখাচ্ছে?
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের চারটি মামলায় জামিনের পর, ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া বাকি রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীরাও জামিন পেতে যাচ্ছেন- রাজনৈতিক অঙ্গন ও আদালতপাড়ায় এমন জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
ক্যাসিনোবিরোধী র্যাবের অভিযানে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে সম্রাট ও তার সহযোগী এনামুল হক ওরফে আরমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই অভিযানে যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে শামীমসহ আরো অন্তত ১৩ জন গ্রেপ্তার হন। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে সম্রাট, আরমান, খালেদ মাহমুদ, জি কে শামীম ছাড়াও অনলাইন ক্যাসিনো কারবারি সেলিম প্রধান, বিসিবির পরিচালক ও মোহামেডান ক্লাবের তৎকালীন ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান ওরফে মিজান, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর ময়নুল হক ওরফে মনজু, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৎকালীন কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান ওরফে রাজীব, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের কর্মকর্তা ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা কাজী শফিকুল আলম ওরফে ফিরোজ এবং পরের বছর জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার করা হয় গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা দুই ভাই এনামুল হক ওরফে এনু ও রুপন ভূঁইয়া।
এদিকে, আদালত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর থেকে পাওয়া তথ্যমতে, মোহামেডান ক্লাবের সে সময়কার পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ও কৃষক লীগ নেতা কাজী শফিকুল আলম ছাড়া বাকি সবাই কারাগারে আছেন। লোকমান হোসেন ভূঁইয়া জামিনের পর কিছুটা আড়ালে থাকলেও, কাজী শফিকুল আলম ফিরোজ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং অ্যাজেন্সিস (বায়রা)-এর নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসায় নিয়মিত হয়েছেন। বাকি কারাগারে থাকা আসামিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শারীরিক অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে কারা হাসপাতালে থাকছেন।
লোকমান হোসেন ভূঁইয়া ও কাজী শফিকুল আলম ফিরোজের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে, তারা কথা বলতে রাজি হননি। এদিকে সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীবের শ্যালক ইমতি টিবিএসকে বলেন, গত দুই বছর ধরে তারা এমন কোন জায়গা নেই যে জামিনের জন্য ধর্না দেননি। উচ্চ আদালত থেকে কারাগার, সবখানে চেষ্টা তদবির করেছেন।
"দুলাভাই এখন কেরাণীগঞ্জের কারাগারে আছেন, তার জামিনের জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে আমার বোন ও তার সন্তানেরাও অসুস্থ হয়ে পড়েছে," ইমতি জানান।
এদিকে ঢাকা মহানগর প্রধান পিপি আব্দুল্লাহ আবু টিবিএসকে বলেন, "যে ক'জন আসামি জামিন নিয়েছেন তাদের অনেকে শারীরিক অসুস্থতা বিবেচনায় জামিন পেয়েছেন, কেউ কেউ উচ্চ আদালত পর্যন্তও গেছেন। একজন জামিন পেলেই যে সবাই জামিন পাবেন বিষয়টা এমন কিছু নয়। তবে, জামিন পাওয়া যে কোন অভিযুক্তের অধিকার, আবার জামিন পাওয়া মানেই বিচারের প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে গেছেন এমনও নয়। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে অর্থপাচারকারীসহ বড় আসামিদের সব সময় জামিনের বিরোধিতা করি।"
এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সরকার ক্যাসিনো, জুয়া, মাদক ব্যবসাসহ জঘন্য অপরাধে জড়িত অপরাধীদের ছেড়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা। তারা বলেন, "সরকার গুন্ডা, মাস্তানদের দিয়ে জনগণকে ভয় দেখিয়ে দমন–পীড়ন করে রাখতে চায়।"
রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শনিবার দুপুরে গণতন্ত্র মঞ্চের বিক্ষোভ সমাবেশ ও পদযাত্রা কর্মসূচিতে এসব অভিযোগ করেন সাত দলীয় এ জোট নেতারা। সমাবেশে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, "যারা বাংলাদেশে ক্যাসিনো চালু করেছেন, জুয়া খেলা চালু করেছেন, তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কোর্টকাচারি কোথায়?"
যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের চারটি মামলার বিচারকাজ শুরু হয়নি বলে আদালত সূত্র জানা গেছে। তবে অস্ত্র, মাদক ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের তিনটি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। দুই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও অর্থপাচার মামলার তদন্ত এখনো শেষ করতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।
সম্রাটসহ গ্রেপ্তার এই ১৩ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ, র্যাব ও দুদক মোট ৫৭টি মামলা করে। এর মধ্যে অস্ত্র, মাদক, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ, বিশেষ ক্ষমতা ও মানি লন্ডারিং আইনে ৩৪টি মামলা করে পুলিশ ও র্যাব। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক বাদে বাকি ১২ জনের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা করে দুদক।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), র্যাব ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তদন্ত শেষে ৫২টি মামলার অভিযোগপত্র দেয়।
দুদকের সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, সম্রাট, জি কে শামীম, খালেদ, এনু, রুপন ভূঁইয়াসহ তাদের ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের ২৩ মামলার মধ্যে ২০টির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি তিন মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে।
৫৭ মামলার মধ্যে ৫২টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে ধীরগতিতে। বেশিরভাগ মামলার অভিযোগই গঠন হয়নি।
অভিযোগ গঠন দেরি হচ্ছে কেন, এমন প্রশ্নে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু বলেন, অভিযোগপত্র দাখিলের পর বিচারের জন্য মামলা বিভিন্ন আদালতে স্থানান্তর করা হয়। খোঁজখবর নিয়ে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।