ঘাসের লন কার্পেট: রাব্বির নিজ উদ্যমে নতুন এক যাত্রা
ইট-পাথরের শহরে প্রকৃতির সবুজে মোড়া একটুকরো প্রশান্তি কার না ভালো লাগে! চারিদিকে যখন গাছ কেটে জায়গা বর্ধিত করার হিড়িক চলছে, সেসময় একদল শৌখিন লোক নিজেদের বাড়ির আঙিনা, বারান্দা সাজিয়ে তুলছে প্রাকৃতিক ঘাস কার্পেটে। এমনকি রেস্টুরেন্ট, খেলার মাঠ, রিসোর্ট, পার্কসহ যে কোনো আউটডোরে এখন প্রকৃতির ছোঁয়া আনতে বিছানো হচ্ছে মোলায়েম সবুজ ঘাসের কার্পেট। কৃত্রিম (আর্টিফিসিয়াল) লন কার্পেট নয়, প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে মাটিসহ প্রাকৃতিক ঘাস কার্পেটের চাহিদা বাড়ছে। সবুজ পরিবেশ সারাদিনের ক্লান্তি ভরা চোখে প্রশান্তির ছায়া এনে দেয়। তাইতো এখন শহর থেকে উপজেলাগুলোতে প্রায়ই চোখে পড়ে এ ধরনের লন কার্পেটের ব্যবহার।
দু'বছর আগেও প্রাকৃতিক লন কার্পেটের ব্যবহার খুব বেশি ছিল না। আমরা যেমন গাছ কেটে প্রকৃতি ধ্বংস করছি, তেমনি আমাদের মধ্যে প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার টান প্রবল মাত্রায় বাড়ছে। তাইতো ঘর হোক বা অফিস-সাজ্জসজ্জার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সবুজের কথা মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করা হয়। চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশেই চাষ করা হচ্ছে লন ঘাস কার্পেট।
চাঁদপুরের বাসিন্দা গোলাম রাব্বি দুই বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে মেক্সিকান বাড়মুন্ডা ঘাস চাষ করছেন। নিজের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দাঁড়ানোর পাশাপাশি নিজ এলাকার অনেক বেকার ও অসচ্ছল মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন।
গোলাম রাব্বি জানান, 'চাঁদপুরে ঘাস চাষ করার আগে দীর্ঘ ৭ বছর আমি বাহরাইনে ছিলাম। সেখান থেকেই আমি লন কার্পেট ঘাস চাষাবাদ সম্পর্কে জানতে পারি এবং হাতেকলমে এই কাজ শিখি। করোনাকালীন দেশে এসে কী ধরনের ব্যবসা শুরু করা যায় ভাবছিলাম। দেশের বাইরে থাকাকালীন চিন্তা করতাম দেশে ফিরে গিয়ে প্রাকৃতিক লন কার্পেট ঘাস চাষ করবো। তাই নিজের ভাবনা ও এতো বছরের পারদর্শিতা বাস্তবায়নের চূড়ান্ত উদ্যোগ নেই। ৪০ শতাংশ জমি বর্গা নিয়ে সেখানে পরীক্ষামূলক চাষাবাদ শুরু করলাম। আশেপাশের লোকজন ও পরিচিতরা তখন আমার এটা নিয়ে হাসাহাসি করতো। বলতো বিদেশ থেকে এসে পাগল হয়ে গেছি, নাহলে জমি বর্গা নিয়ে ঘাস কে চাষ করে! ঘাস-আগাছা তো জমির আইল ও খোলা জায়গায় এমনিতেই জন্মায়'।
নিজ উদ্যমে নতুন এক যাত্রা
গোলাম রাব্বি ভারত থেকে মেক্সিকান বারমুন্ডা ঘাসের চারা এনে সেগুলো জমিতে রোপণ করেন। প্রথমদিকে তার পরীক্ষামূলক চাষাবাদ বেশ সফলতার মুখ দেখে। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ে জমির বিস্তৃতি ও লোকবল। ৪০ শতাংশ জমি এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ একর জায়গায়। হাসিঠাট্টা করা গ্রামের লোকজন যখন দেখলো তার চাষ করা লন ঘাস কার্পেটের চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে ও এই ব্যবসা বেশ লাভজনক-তাদের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টে গেল। তাকে দেখে উৎসাহী হয়ে তার বড় ভাই প্রাকৃতিক লন কার্পেট চাষাবাদ শুরু করেছেন। এলাকার আরও ৩/৪ জন তরুণ আগ্রহ প্রকাশ করেছে এই ব্যবসা শুরু করার।
গোলাম রাব্বির বাড়ি চাঁদপুর শহরের পুরানবাজার লোহারপুল এলাকায়। চাঁদপুর জেলায় তিনিই প্রথম পরিবেশবান্ধব ঘাস চাষ শুরু করেন। শুরুর দিকে একার পক্ষে সম্ভব ছিলো না, তাই ২ জন কর্মচারী নিয়োগ করেন। বর্তমানে তার এই ঘাস চাষ প্রকল্পে ৪০-৫০ জন লোক কাজ করছেন। নিজ এলাকার এতো লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ায়-এলাকাবাসীর চোখে তিনি এখন একজন সফল ব্যবসায়ীর পাশাপাশি সম্মানের ব্যক্তি। 'Landscaping.com' নামে গোলাম রাব্বির ফেসবুকে একটি পেজ রয়েছে। পেজে দেওয়া নাম্বারে যোগাযোগ করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রেতারা প্রাকৃতিক লন কার্পেটের অর্ডার দিয়ে থাকেন। ইতিমধ্যে নরসিংদী, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ দেশের নানা জেলার সরকারি-বেসরকারি অফিস, আবাসিক ভবন, রেস্টুরেন্ট ও কবরস্থানের জন্য চাঁদপুর থেকে লন কার্পেট ঘাস অর্ডার করেছেন ক্রেতারা। প্রাকৃতিক ঘাসের কার্পেট বিক্রি করে প্রতি মাসে তরুণ এই উদ্যোক্তার আয় প্রায় ২ লাখ টাকার অধিক।
যেভাবে চাষ করা হয় এই কার্পেট ঘাস
মেক্সিকান বারমুন্ডা ঘাস দেখতে অনেকটা কৃত্রিম ঘাসের মতো। কিন্তু কৃত্রিম ঘাসের তুলনায় এটি অনেক মোলায়েম হয়ে থাকে। যথাযথ পরিচর্যায় এই ঘাস দীর্ঘকাল সতেজ ও বেঁচে থাকে। লন কার্পেট চাষের আদ্যোপান্ত জানালেন গোলাম রাব্বি। তিনি বলেন, 'জমিকে প্রথমে ভালোভাবে সমান করে নিতে হবে। কোথাও উঁচুনিচু হয়ে থাকলে কার্পেট সমান্তরাল হবে না। তারপর জমির ওপর বড়-মোটা পলিথিন বিছানো হয়। ভালো মানের পলিথিন না হলে কার্পেট গুটিয়ে ভাঁজ করার সময় ঐটা ছিঁড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পরবর্তী ধাপে পলিথিনের ওপর ১.৫ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি ঢালা হয়। এই মাটির ওপর ৭ ইঞ্চি পরিমাণ ফাঁক রেখে ঘাস রোপণ করা হয়। তারপর পানি ও সঠিক পরিচর্যায় ধীরে ধীরে ঘাস বড় ও সতেজ হয়ে বেড়ে উঠে।'
'শুধু চারা লাগিয়ে দিলেই হয় না, প্রতি সপ্তাহে মাটিতে সার ব্যবহার করতে হয়। এছাড়াও ১৫ দিন পরপর ঘাসের মাথা কেটে সমান করে দিতে হয়। গরমকালে ঘাস চাষাবাদ তুলনামূলক কম সময়সাপেক্ষ ও কম ব্যয়বহুল। গরমের সময় ঘাসের চারা লাগানো থেকে কার্পেট হিসেবে ব্যবহার উপযোগী হতে সময় লাগে ৩ মাস। আর শীতকালে সেটা গিয়ে দাঁড়ায় ৬/৭ মাসে। তাই সেসময় আমাদের দীর্ঘদিন ঘাসের পরিচর্যা ও মজুরি মিলিয়ে বেশি খরচ গুনতে হয়। তাই শীতকালে অন্য সময়ের তুলনায় কার্পেটের দাম কিছুটা বেড়ে যায়। গরমের সময় প্রতি স্কয়ার লন কার্পেটের দাম রাখা হয় ৭০/৮০ টাকা। যা শীতকালে বেড়ে দাঁড়ায় ৯০/১০০ টাকাতে। শুরুর দিকে ভারত থেকে চারা আমদানি করে আনা হলেও; এখন আমি নিজেই চারা উৎপাদন করছি। বার্ষিক উৎপাদন বাড়ায় পূর্বের তুলনায় কার্পেটের দাম কিছুটা কমেছে।'
প্রাকৃতিক সবুজায়নে দরকার বাড়তি পরিচর্যা
কৃত্রিম লন কার্পেট বিছিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকার অবকাশ থাকলেও-প্রাকৃতিক লন কার্পেটের বেলায় সে সুযোগ কম। দীর্ঘদিন সতেজ মোলায়েম ঘাস বাঁচিয়ে রাখতে হলে দরকার বাড়তি কিছু পরিচর্যা। প্রকৃতিপ্রেমীদের নিকট এটা অবশ্য তেমন কিছুই না।
কৃত্রিম লন কার্পেট ইনডোরে ব্যবহার উপযোগী হলেও প্রাকৃতিক লন কার্পেট কেবল আউটডোরেই ব্যবহার উপযোগী। সরাসরি জমি থেকে মাটিসহ তুলে এই ঘাস কার্পেট প্রতিস্থাপন করা হয়। আলো বাতাসের চলাচল রয়েছে এমন স্থানে প্রাকৃতিক লন কার্পেট প্রতিস্থাপন করতে হবে।
গাছের পরিচর্যায় যেমন নিয়মিত পানি দিতে হয়, তেমনি ঘাস সতেজ রাখতে ২ দিন অন্তর পানি দিতে হবে। কমপক্ষে সপ্তাহে ১ বার কার্পেটের ঘাসে পানি দিতে হবে। ঘাসের সাথে মাটি লেগে থাকে বিধায় পানি ছিটালে তা কাদা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বহু অংশে থাকে। তাই ইনডোরে এই কার্পেট ব্যবহার না করাই ভালো। অনেকে শখ করে নিজেদের বারান্দায় প্রাকৃতিক লন কার্পেট বিছিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে সূর্যের আলো পড়ছে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
প্রাকৃতিক লন কার্পেট ব্যবসায়ী রাব্বির পরিকল্পনা বছরে তার উৎপাদিত ২ লক্ষ স্কয়ার ফিট ঘাস বেড়ে একসময় ১৫/২০ লক্ষ স্কয়ার ফিটে দাঁড়াবে। কিন্তু জমির সঙ্কটের কারণে তিনি বিস্তরভাবে চাষাবাদ শুরু করতে পারছেন না। তাই তার অনুরোধ, সরকারি খাস জমি লিজ পাওয়া গেলে-সেখানে লন কার্পেট ঘাসের চাষাবাদ বাড়াতে পারতেন। তিনি জানান, উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে প্রতি স্কয়ার লন কার্পেটের দাম কমে ৫০ টাকার মধ্যে চলে আসবে।
বাড়ছে লন ঘাস কার্পেট চাষ
Baganbilash.com.bd নামের আরেকটি অনলাইন পেইজের স্বত্বাধিকারী আবু হোসাইন ২০২০ সাল থেকে প্রাকৃতিক লন কার্পেট চাষ শুরু করেন। তার দাবি ঢাকার হাজারিবাগে তিনিই প্রথম বাংলাদেশে প্রাকৃতিক লন কার্পেট চাষাবাদ শুরু করেছেন। কিন্তু তিনি মেক্সিকান বারমুন্ডা ঘাস নয়, অস্ট্রেলিয়ান ঘাস চাষ করেন। ম্যাক্সিকান ঘাস থেকে অস্ট্রেলিয়ান ঘাসের পার্থক্য হলো- এই ঘাসের পাতা মোটা ও পুরুত্ব বেশি হয়। এই ঘাসগুলো এতটাই মজবুত হয় যে, এর ওপর দিয়ে গাড়ি চলাচল করলেও চাপা পড়ে মরে যায় না। বারমুন্ডা ঘাসের দামের তুলনায় এই ঘাসের দাম কিছুটা বেশি। প্রতি স্কয়ার ফিট ঘাসের দাম ১২০ টাকা। এই ঘাস জন্মাতে ৪/৪.৫ মাস সময় লাগে। পাতা কিছুটা মোটা হওয়ায় অস্ট্রেলিয়ান লন কার্পেট ঘাসের চাহিদা কম। ক্রেতাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে উদ্যোক্তা আবু হোসাইন মেক্সিকান বারমুন্ডা ঘাস চাষ শুরু করেছেন। ঢাকার দিয়াবাড়ি এলাকা, হাজারীবাগ ও চাঁদপুরে তার কয়েকটি প্রজেক্টে চলছে প্রাকৃতিক লন কার্পেট ঘাসের চাষ।
আবু হোসাইন জানান, 'দেশে কয়েকটি ডেলিভারি প্রতিষ্ঠান চালু হলেও গাছ বা লন ঘাস কার্পেট ডেলিভারি দেওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট কোনো সার্ভিস এখনো চালু হয়নি। অন্যান্য পণ্য যেমন প্যাকেটজাত করে সহজে একস্থান থেকে অন্যস্থানে আনয়ন করা যায়-গাছের বেলায় তা সম্ভব না। এক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা রেখে ডেলিভারি দিতে হয়, যা ডেলিভারি খরচা বাড়িয়ে দেয়। যার জন্যে ঢাকার বাইরে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক সময় লন ঘাস কার্পেট পৌঁছে দিতে পারি না। এটা আমাদের বড় একটা প্রতিবন্ধকতা।'
সৌখিন জীবনের অংশ হিসেবে অনেকেই নিজেদের কাজের ক্ষেত্র থেকে আবাসস্থল সাজিয়ে তুলছেন সবুজায়নে। তাই তাদের প্রথম পছন্দ হিসেবে জায়গা করে নিচ্ছে প্রাকৃতিক লন কার্পেট। এই ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় তরুণ উদ্যোক্তারা দিনদিন আগ্রহী হয়ে উঠছেন। চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে প্রাকৃতিক লন কার্পেটের উৎপাদন।