ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী যেভাবে হলেন সফল উদ্যোক্তা
বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডিংরুমে নিরলস পরিশ্রমের পরও একজন ছাত্রের আজকাল একখানা পাকাপোক্ত চাকরির নিশ্চয়তা নেই। চাকরি যেন সোনার হরিণ! গ্রাম থেকে এক বুক স্বপ্নকে পুঁজি করে যে ছাত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন, তার পরিণতি খুব একটা সুখকর হয় না। প্রশ্নফাঁসের জালে মিলিয়ে যেতে দেরি হয় না চাকরির স্বপ্ন। দুর্মূল্যের এই চাকরির বাজারে ব্যবসা হতে পারে নিরাপদ ভরসা—উদ্যোক্তারা এমনই এক নতুন বার্তা বয়ে আনছেন। এ বার্তায় মিশে আছে কিছুটা স্বস্তি কিংবা বেকারত্ব ঘোচবার আশ্বাস। এমন একজন উদ্যোক্তার গল্পই শোনা যাক।
আমি যখন ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখি, তখন ক্যাম্পাসে কাউকেই বলতে গেলে চিনি না। হলে সিটটুকু পর্যন্ত জোটেনি। আজিমপুরের একটি মেসে মাথা রাখবার ঠাঁই জুটেছে। তোশক থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় থালা-বাসন কিংবা বটি বয়ে আনবার মতোন উপস্থিত বুদ্ধি তখনও তৈরি হয়নি। আমার নিজের জেলা থেকে ঢাকা তখন ঘণ্টা দশেকের রাস্তা। এত কিছু বয়ে আনাও দায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ওয়াহিদুল ইসলাম ওয়াহিদ নামের এক বড় ভাইয়ের সাথে পরিচয় ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সূত্রে। শহরে নতুন পা রাখা সেই প্রথম বর্ষের ছাত্রীকে নিউমার্কেট চিনিয়েছিলেন ওয়াহিদুল ভাই। নিত্যপ্রয়োজনীয় কেনাকাটার পর আন্তরিকভাবে ভারী তোশকটুকু পর্যন্ত বাসা অব্দি পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি। তখনও চাকরি পাওয়া, না পাওয়ার দোলাচলে দুলতে দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের আইন বিভাগের এই মেধাবী ছাত্রকে। চাকরি না পাওয়ার তীব্র হতাশা গ্রাস করে ফেলছিল হাসিখুশি মানুষটিকে। ২০২৩ সালের রমজান মাসে আমার সেই পরিচিত সিনিয়রের নতুন ব্যবসার খবর পেলাম। আজ সেই ব্যবসা নিয়ে, একজন সফল উদ্যোক্তাকে নিয়ে লিখতে বসলাম।
শুরুটা যেমন করে
ওয়াহিদুল ইসলাম ওয়াহিদ ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। এরপর আর পাঁচটা সাধারণ শিক্ষার্থীর মতো করে শুরু করেন চাকরির প্রস্তুতি। বছর দুই যেতে না যেতেই কোভিড-১৯-এর ধাক্কা। চাকরির বয়েস ফুরোনোর দিকে এগোতে থাকছিলেন ওয়াহিদ। কিন্তু চাকরি জুটছিল না।
এদিকে অভাব গ্রাস করে ফেলছে সমস্তকিছু। অভাবের তাড়নায় করোনা পরবর্তী সময়ে তিনি ঢুকলেন এক বেসরকারি চাকরিতে। সেখানে পরিশ্রমের তুলনায় টাকা সামান্য। পরিবেশটাও একেবারেই মনমতোন নয়। সুতরাং চাকরির স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। ছেড়ে দিলেন সেই বেসরকারি চাকরি। কিন্তু এই চাকরিছাড়াই হয়ে গেল শাপে বর।
বেসরকারি চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে ওয়াহিদ বুঝতে শুরু করলেন, এই ধরাবাঁধা চাকরি তার দ্বারা সম্ভব না। তিনি যে মুক্ত বিহঙ্গের মতো বাঁচতে চান। সুতরাং, তিনি নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন। ভাবলেন, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমদিকে যে ব্যবসার পোকাটা মাথায় ছিল, সেটাকেই নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখা যাক।
কিন্তু একটা ব্যবসা তো কম ঝক্কি নয়। ঝক্কির থেকেও মূলধনের ব্যাপারটা জরুরি। আর দরকার ঝুঁকি নেওয়ার সাহস। কিন্তু যাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তারা ঝুঁকি নেওয়ার ভয়ে মাথা নোয়ায় না। ওয়াহিদুল অপেক্ষা করতে থাকলেন একটা ঠিকঠাক সুযোগের জন্যে। সেই সুযোগ মিললো ২০২৩ সালের রমজান মাসে। ওয়াহিদুল হাজী মুহম্মদ মুহসিন হলের এক ছোটো ভাইয়ের সাথে অংশীদারিত্বে শুরু করলেন ইফতারের খাবারের ব্যবসা। কিন্তু প্রথম থেকেই নানান বাধা আসতে শুরু করলো। শেষ অব্দি এই ব্যবসা ধোপে টিকলো না।
এরপর ওয়াহিদুল ভাবতে শুরু করলেন অনলাইনভিত্তিক খাবারের ব্যবসার কথা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে যদি কিছু করা যায়! যেই কথা সেই কাজ। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ডিইউ ফুড পয়েন্ট নামে শুরু হলো নতুন খাবারের ব্যবসা। ডিইউ শুনে প্রথমেই মাথায় আসে ঢাকা ইউনিভার্সিটির কথা। কিন্তু এই ডিইউ ফুড পয়েন্টের ডিইউ হচ্ছে ডেলিসিয়াস অ্যান্ড আপডেটেড এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এই উদ্যোক্তা টার্গেট কাস্টমার হিসেবে বাছলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল, বুয়েট থেকে শুরু করে ইডেন, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের।
দিন সাতেকের মধ্যেই ভালো সাড়া পেতে শুরু করে ডিইউ ফুড পয়েন্ট। প্রথমদিকে হালকা খাবার দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও চাহিদামাফিক ভারি খাবার আনতে শুরু করেন উদ্যোক্তা ওয়াহিদ। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ভাবতে হয়নি চাকরির কথা।
কী কী খাবার পাবেন ডিইউ ফুড পয়েন্টে?
ডিইউ ফুড পয়েন্টে শাহী মোরগ পোলাও, গরুর রেজালা পোলাও, মুরগির তেহারি, গরুর তেহারি, ডিম খিচুড়ি, ডিম পোলাও, মুরগির মাংসের খিচুড়ি, গরুর মাংস খিচুড়ি আর বোরহানি রয়েছে প্রতিদিনের তালিকায়। যেমন স্বাদ, তেমনি গন্ধ। আর এই সমস্ত খাবারের দাম সর্বনিম্ন ৯০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৬০ টাকা পর্যন্ত। বলা যায়, বেশ বাজেট-বান্ধব দাম। ডেলিভারি খরচটা অবশ্য আলাদা। তা বাড়ি বসে খেলে এটুকু বিনিময়মূল্য তো চোকাতেই হয় আজকাল।
ওয়াহিদ জানালেন, চাকরি জোটাতে না পারায় একসময় আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি, গ্রামের মানুষের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। নিজেরও আর্থিক টানাটানি বেড়ে চলছিল।
"বাবা তখন অসুস্থ। তখন মনে হতো, আমার দ্বারা সত্যিই হয়তো কিছু সম্ভব না। ব্যবসা শুরু করবার সময়ও মনের মধ্যে একটা ভয় কাজ করত। কিন্তু আমি শেষ অব্দি সফল হয়েছি। প্রত্যেক ব্যবসাতেই নানান চড়াই-উৎরাই থাকে। আমার ব্যবসাতেও আছে। ঈদ থেকে বিভিন্ন ধরনের ছুটির সময় ক্যাম্পাস ফাঁকা হয়ে যায়। তখন কমে যায় বিক্রিবাট্টা। এরপরও আমি এই ব্যবসা করে ভালো আছি। অন্তত বেকারের জীবন কাটাতে হচ্ছে না।"
"ব্যক্তিভিত্তিক অর্ডার দিয়ে আমার ব্যবসা শুরু হয়েছিল। কিন্তু অনলাইনে আস্তে আস্তে নাম ছড়িয়ে পড়বার পর বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানে খাবারের অর্ডার পাওয়া শুরু করি। এভাবেই আমার ভাগ্য ঘুরে যেতে শুরু করে।"
"প্রথমদিকে শুধু রান্না করা খাবারের ব্যবসা শুরু করলেও এখন ব্যবসার আওতা বাড়াচ্ছি। অর্গানিক বিভিন্ন আইটেম বিক্রির কাজও আস্তে আস্তে শুরু হচ্ছে। আগে বাজারসহ রান্নার খুঁটিনাটি কাজ আমরা নিজেরাই করতাম, তবে বেশ কিছুদিন যাবৎ 'হায়দ্রাবাদ কাচ্চি' রেস্টুরেন্টের সাথে কোলাবোরেশনে সমস্ত কাজ চলছে। এই রেস্টুরেন্টে বসেও কাস্টমাররা ডিইউ ফুড পয়েন্টের খাবার খাচ্ছেন।"
ওয়াহিদ আরও বলেন, "আমরা প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে শুরু করে রাত ১০টা পর্যন্ত খাবার সরবরাহের কাজ করে থাকি। ডিইউ ফুড পয়েন্টের বিশেষত্ব হচ্ছে আমরা খাবারের মান ঠিক রেখে পরিমাণে খাবার কিছুটা হলেও বেশি দেওয়ার চেষ্টা করি। কেননা, আমাদের ৭০ ভাগ কাস্টমারই হচ্ছে শিক্ষার্থী। এছাড়াও, খাবারের সাথে কাস্টমারের ইচ্ছা অনুযায়ী চিরকুট পৌঁছে দিয়ে থাকি। রেগুলার কাস্টমারদের জন্যে টুকটাক ডিসকাউন্ট তো থাকেই।"
বর্তমানে ডিইউ ফুড পয়েন্টের অধীনে ডেলিভারি বয়, বাবুর্চি, ফেসবুক পেইজের পরিচালকসহ সবমিলিয়ে ১০-১২ জন কাজ করেন। এই উদ্যোক্তা মনোবল আর সামান্য পুঁজিকে সামনে রেখে যে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, তা থেকে আজ ১০ থেকে ১২ জন মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলগুলোতে ডিইউ ফুড পয়েন্ট বেশ পরিচিত নাম। হলের শিক্ষার্থীরা ডাইনিংয়ের খাবারের একঘেয়েমি কাটাতে ডিইউ ফুড পয়েন্ট থেকে খাবার কেনেন। এমনই একজন রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী শাহানুর আক্তার মুন্নি।
তিনি বলেন, "আমি হলের খাবার একদমই খেতে পারি না। তাই প্রতিদিন রান্না করে খাই। একেকদিন আর রান্না করতে ইচ্ছে করে না। সেদিন ডিইউ ফুড পয়েন্ট থেকে খাবার অর্ডার করি। এদের খাবারের মান বেশ ভালো। তৃপ্তি করে খেতে পারি।"
দিন এগোচ্ছে। সেই সাথে এগোচ্ছে মানুষের চিন্তাভাবনা। তথাকথিত সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে চাকরির পেছনে ছোটার সেইসব দিন ফুরোলো বলে। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে একজন শিক্ষিত মানুষ যদি ব্যবসার মাধ্যমে সাবলম্বী হয়ে ওঠেন, এর থেকে ভালো কিছু হয় না। এভাবে একজন উদ্যোক্তা শুধু নিজেরই ভাগ্য ফেরান না। ভাগ্য ফেরান তার অধীনে কাজ করা অনেক মানুষের।