আগামী বছরের অর্থনীতি বিশ্বকে আরও বেশি সংকটময় করে তুলবে
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর, প্রথম টেলিফোন আলাপে ইউরোপের চলমান যুদ্ধকে সমর্থন জানিয়েছেন ঋষি সুনাক। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনেস্কির সাথে ফোনালাপে দেশটির প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। যদিও বৃটেনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির করুণ দশার মূল কারণ- এই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ।
আজ বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর, সুনাক সাংবাদিকদের কাছে যে বক্তব্য রেখেছেন সেখানে তিনি স্বীকার করেছেন, বিশ্বের জ্বালানিখাত এক দীর্ঘ সংকটের মুখে পড়েছে। এবং এই সংকটের কারণ ইউক্রেন-রাশিয়ার চলমান যুদ্ধ।
ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি দেশ প্রথমদিকে রাশিয়ার পক্ষ অবলম্বন করে আসছিল। এজন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে। অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত, দেউলিয়া রাষ্ট্রের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো পাকিস্তানকে 'শিক্ষা' দেওয়াটা সহজ হয়েছে বলা যায়।
জাতিসংঘে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়ের ভোটাভুটিতে বাংলাদেশ ও ভারতকে বেশ কৌশলী অবস্থান নিতে দেখা যায়। কখনো এই দেশ দুটি ভোটদানে বিরত থাকছে, আবার কখনো রাশিয়ার বিপক্ষে ভোট দিচ্ছে। আবার এই ভোটদানের প্রশ্নে ভারত ও বাংলাদেশকে দুই রকম অবস্থান নিতেও দেখা যায়। ঋষি সুনাকের প্রথম টেলিফোন কল কিংবা তার বক্তব্য দু-ই প্রমাণ করে, মার্কিন রণনীতির প্রতি বৃটেনের আনুগত্য। মার্কিনীদের প্রতি বৃটেনের এই আনুগত্যের ইতিহাস বেশ পুরোনো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যপর্যায়ে জার্মানি যখন ইউরোপের আটটি দেশ দখল করে নেয়- তখন চার্চিল প্রায় নতজানু হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই যুদ্ধে সহায়তা চেয়েছিলেন। মার্কিন সহায়তার অংশ হিসেবে চার্চিল ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছিল। সেসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর উপনিবেশিক শাসন শেষ করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের সমঝোতার বিষয়বস্তু ছিল, পৃথিবীতে কোনও নতুন উপনিবেশ সৃষ্টি করা যাবে না এবং সকল উপনিবেশের পরিসমাপ্তি করতে হবে। সেই থেকেই দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে কোনও যুদ্ধনীতি ব্রিটিশরা সমর্থন করে আসছে। ২০০৩ সালেও তারা ইরাক যুদ্ধে মার্কিনিদের সঙ্গে অংশ নিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। বর্তমান ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে বৃটেন একই কায়দায় মার্কিনীদের সমর্থন দিয়ে আসছে।
ঋষি সুনাক ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের এই ফোনকলের মাধ্যমে বিশ্বকে কী বার্তা দিলেন- তা স্পষ্ট নয়। সুনাক একদিকে স্বীকার করছেন, বৃটেনের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য ইউক্রেন- রাশিয়ার এই যুদ্ধ দায়ী; অন্যদিকে আবার যুদ্ধের পক্ষে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে সমর্থন দিচ্ছেন।
রাজার কাছ থেকে দায়িত্বগ্রহণের অনুমোদন নেওয়ার পরে প্রথম যে সংবাদ মাধ্যমের সামনে বক্তব্য রাখেন, তাতে তিনি তার উত্তরসূরী দুজন প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। একজন বরিস জনসন এবং অন্যজন লিজ ট্রস। রাজনীতির মহানুভবতা অনুসারে, এটি তাদের প্রচলিত নিয়ম। কিন্তু, সন্দেহ করা যায়, আগামী দিনগুলোতে তার ক্ষমতা টিকে থাকবে এই দুই নেতা-নেত্রীর সরাসরি সমর্থনে ওপরে। লিজকে নিয়ে তার বক্তব্য এটুকুই, 'তিনি একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন'।
ব্রিটিশ জাতি ও পৃথিবীকে অপেক্ষা করতে হবে অর্থনৈতিকভাবে এই ডুবন্ত তরীকে ঋষি সুনাক কীভাবে পুনরুদ্ধার করেন তা দেখার জন্য।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিকে সংকটপূর্ণ করার প্রধান কারণ হলো- এই যুদ্ধ। ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকট দীর্ঘদিনের। কেন রাশিয়া কোভিড-১৯ এর পর পরই সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা যুদ্ধ করেই ইউক্রেনের সংকট মোকাবেলা করবে- তাও অস্পষ্ট। একথা ধারণা করা যেতেই পারে, সারা বিশ্ব করোনার কারণে যখন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, ঠিক তার পরেই রাশিয়ার এই যুদ্ধ ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে বিশ্বকে নতুন সংকটে পড়তে হবে, তা রাশিয়ার নেতৃত্ব নিশ্চয়ই জানত। তাহলে এই সময়েই কেন এই যুদ্ধ!
অন্যদিকে, রাশিয়ার এই পদক্ষেপ যে অবশ্যম্ভাবী ছিল তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো জানত। ১৯৯১ সনে সোভিয়েত পতনের পর গর্বাচেভ ও বুশের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছিল তার প্রথমেই ছিল, ন্যাটো আর কোনো সম্প্রসারণে যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই সমঝোতা রক্ষা করেনি। ন্যাটোর অব্যাহত পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রাশিয়ার নিরাপত্তাকে নাজুক করে তোলে। ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার চেষ্টা রাশিয়ার যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে।
এখানে মার্কিন মদতেরও কোনো রাখঢাক নেই। পৃথিবীর শক্তিধর এই দেশগুলো অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ কেবল তারা নিজেদের কাছেই রাখতে চায়। যে কারণে তারা ইরানের ওপর অব্যাহত নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে। শুধু ইরান নয়, উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেও তারা একই ঘটনা ঘটিয়েছে। কিন্তু, বাদবাকি পৃথিবীর দেশগুলোতে কোথাও গোপনে, কোথাও প্রকাশ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ বা অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে। তাতে এই মহান(!) শক্তিধর দেশগুলো কখনো তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নাই।
পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের নামে কেবল নিজেদের মজুদ বাড়িয়েছে। এই মুহূর্তে পারমাণবিক অস্ত্র ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে, কিনা সেটিও একটি আশঙ্কা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষক আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিশ্বাস করেন, সে সম্ভাবনা আছে।
যে জনগোষ্ঠী ও ভূমি নিয়ে ইউক্রেন-রাশিয়ার এই দ্বন্দ্ব, তা সারা বিশ্বকে আজ যে ব্যাপক সংকটে ফেলেছে- তাতে আমাদের মতন দেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। আমাদের দেশের জ্বালানি খাতের আজকের অবস্থার জন্য প্রধানত এই যুদ্ধই দায়ী। তবে আমাদের জ্বালানি পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও কিছু ত্রুটি ছিল। আমাদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা এমন পর্যায়ে যায়নি, যে আমরা শতভাগ আমদানি-নির্ভর জ্বালানির ওপর নির্ভর করব। আমাদের আয়ব্যয়ের ব্যবধান সামান্য। ওই সামান্য উদ্বৃত্তের উপর দাঁড়িয়ে আমরা আমদানি-নির্ভর জ্বালানির পথে হেঁটেছি।
ঋষি সুনাক যে রাস্তায় হাঁটছেন, যেভাবে জেলেনস্কিকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিলেন এবং এটি যদি তার মনের কথা হয়, তাহলে আগামী বছরের অর্থনীতি বিশ্বেকে আরও বেশি সংকটময় করে তুলবে। আমরাও তা থেকে মুক্তি পাব না।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক