পাতালঘরে ১০ হাজার মস্তিষ্ক: মানব মস্তিষ্কের রহস্যময় সংগ্রহশালা
ডেনমার্কের এক মানসিক হাসপাতালের বেজমেন্টে পড়ে থাকা ৯,৪৭৯টি মস্তিষ্কের সংগ্রহ ২০১৮ সালের একদিন এসে পৌঁছাল দেশটির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে ভোগা ব্যক্তিদের মস্তিষ্ক সেগুলো। তাদের সম্মতি ছাড়াই দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে চিকিৎসকেরা খুলে নিয়েছিলেন সেগুলো। তবে কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে নয়।
এদিকে আজ থেকে প্রায় সাত দশক আগে কিশোরীকালে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেওয়া কিয়েস্টেনের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল তা জানতে চেষ্টা করছে লিস সোগ। ডেনমার্কের মানসিক রোগীদের মস্তিষ্ক সংগ্রহের এ গল্প জানিয়েছেন সিএনএন-এর সামান্থা ব্রেসনাহান, ডা. সঞ্জয় গুপ্ত, সুসান গার্গিলো ও স্যান্ডি থিন।
কিয়েস্টেনের রহস্যময় অতীত
দাদী ইঙ্গারের বাড়িতে কেবল একটি ছবিতেই কিয়েস্টেনের উপস্থিতি দেখেছিল ডেনমার্কের লিস সোগ। কিয়েস্টেন তাদের পরিবারের এক রহস্যময় চরিত্র।
কিয়েস্টেনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সোগ পরিবারের একটি বেদনাদায়ক অধ্যায়। ইঙ্গারের ছোটবোন ছিল কিয়েস্টেন।
লিসের দাদী ইঙ্গারের বয়স এখন ৯০'র ঘরে। তাও বোন কিয়েস্টেনের কথা দিব্যি মনে আছে তার। ২০২০ সালের কোনো একদিন সব ইতস্ততবোধ দূরে সরিয়ে দাদীকে কিয়েস্টেনের কথা জিজ্ঞেস করে বসল লিস।
১৯২৭ সালের ২৪ মে কিয়েস্টেন অ্যাবিল্ডট্রাপের জন্ম হয়। কিয়েস্টেন আর ইঙ্গার ছোটবেলায় একে অপরের খুব ন্যাওটা ছিলেন।
কিয়েস্টেনের ১৪ বছর বয়সে তার মধ্যে মানসিক পরিবর্তন দেখা যায়। প্রায়ই কাঁদত সে। এরপর এক ক্রিসমাসে কেবল কিয়েস্টেন ছাড়া বাড়ির সব ছেলেমেয়ে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যায়।
ফিরে এসে তারা আর কিয়েস্টেনকে দেখতে পায়নি। সেদিনই প্রথমবারের মতো ইঙ্গারের বাবা ও দাদা কিয়েস্টেনকে হাসপাতালে পাঠান।
কিয়েস্টেনকে এরপর অনেক মানসিক হাসপাতালেই ভর্তি করা হয়েছিল। এক ক্রিসমাসের দিন কিশোরীর চিকিৎসার যে বেদনাপূর্ণ যাত্রা শুরু হয়েছিল, তার সমাপ্তি ঘটে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছিল কিয়েস্টেন।
ডেনমার্কের ব্রেইন সংগ্রাহকেরা
কিয়েস্টেনকে প্রথমবারের মতো যখন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের দিকে।
বিশ্বের অনেক দেশের মতো ডেনমার্কেও তখন প্রচুর মানুষ মানসিক সমস্যায় ভুগছিল।
এ রোগীদের জন্য দেশটিতে অনেকগুলো মানসিক হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান তখনো মস্তিষ্কের ভেতরে ঘটা সব ক্রিয়াকলাপের পুরোটা বুঝে উঠতে পারেনি।
ওই সময়টাতেই দুই ড্যানিশ ডাক্তারের মাথায় এক আইডিয়া এল।
হাসপাতালগুলোতে মানসিক রোগীরা মারা যাওয়ার পর তাদের ময়নাতদন্ত করা হতো। এ দুই ডাক্তার ভাবলেন, এ রোগীদের মস্তিষ্ক সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করে রাখলে কেমন হয়।
ডেনমার্কের অহুস বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ কনসালটেন্ট ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসবেত্তা থমাস আরস্লেভের অনুমান, ১৯৪৫ থেকে ১৯৮২ সালে মারা যাওয়া ডেনমার্কের মানসিক রোগীদের অর্ধেক নিজেদের অজান্তে বা সম্মতি ছাড়া তাদের মস্তিষ্ক দান করেছেন।
ডেনমার্কের অহুস শহরের রিসকভ সাইকিয়াট্রিক হসপিটালের ইনস্টিটিউট অব ব্রেইন প্যাথলজিতে এ মস্তিষ্কগুলো সংগ্রহ করা হয়।
এ কাজের পেছনে উল্লেখিত দুই ড্যানিশ ডাক্তার ছিলেন এরিক স্ট্রমগ্রেন ও লরাস আইনারসন। বছর পাঁচেক পরে ইনস্টিটিউটের দায়িত্ব নেন প্যাথলজিস্ট নদ ও' লরেন্টজেন। পরবর্তী তিন দশক মস্তিষ্কের সংগ্রহ গড়ে তুলেছিলেন তিনি।
সবমিলিয়ে এ সংগ্রহশালায় আছে ৯,৪৭৯টি মানব মস্তিষ্ক। মনে করা হয়, এ ধরনের সংগ্রহের ক্ষেত্রে এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা।
একদিন স্থান পরিবর্তন
২০১৮ সাল। প্যাথলজিস্ট ডা. মার্টিন ভিরেনফেলড নিয়েলসেনের কাছে একটি ফোন আসে।
তহবিলের অভাবে অহুসে আর ব্রেইন কালেকশন রাখা যাচ্ছে না। তবে ওডেন্স শহরের ইউনিভার্সিটি অভ সাউদার্ন ডেনমার্ক কালেকশনের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়। ডা. মার্টিনের কাঁধে দায়িত্ব পড়ে এগুলো দেখভালের।
শুরু থেকেই বালতির ভেতরে ফরমালডিহাইডে ডুবিয়ে মগজগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছিল। অহুস থেকে স্থানান্তরের জন্য হলদেটে-সবুজ আস্তরণ পরা বালতিগুলোর বদলে আরও শক্ত বালতির ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিটা বালতিতে নতুন করে নাম্বার দেওয়া হয়। এরপর সেগুলোর নতুন জায়গা হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির বেজমেন্টে।
নৈতিকতার হিসাবনিকাশ
প্রায় ১০ হাজার মস্তিষ্কের আনুমানিক ৫,৫০০টি ডিমেনশিয়া (স্মৃতিভ্রংশ), ১,৪০০টি সিজোফ্রেনিয়া, ৪০০টি বাই-পোলার ডিসঅর্ডার ও ৩০০টি বিষণ্ণতায় ভোগা রোগীদের। এর বাইরে অন্য মানসিক রোগে ভোগা ব্যক্তির মস্তিষ্কও রয়েছে এখানে।
স্বাভাবিকভাবেই, এ সংগ্রহশালাকে সমালোচনার শিকার হতে হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে এটির অস্তিত্ব সম্পর্কে সজাগ হয়ে ওঠে সাধারণ ড্যানিশেরা।
১৯৮২ সালে সাবেক পরিচালক লরেন্টজেনের অবসরের পর এমনিই পড়েছিল মস্তিষ্কগুলো। ডেনমার্কের প্রথম বড় কোনো বৈজ্ঞানিক নৈতিক বিতর্ক শুরু হয় মস্তিষ্কের এ সংগ্রহ থেকেই।
'একদলের দাবি ছিল এগুলো কবর দিয়ে বা অন্য কোনো নৈতিক উপায়ে ধ্বংস করা হোক। অন্যপক্ষের মত, একবার যেহেতু যা ভুল করার করে ফেলা হয়েছে। এখন এ রোগী ও তাদের আত্মীয়স্বজনদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে হলেও আমাদের এটা নিশ্চিত করা উচিত যে এ মস্তিষ্কগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে লাগবে,' বলেন ডেনমার্কের মানসিক স্বাস্থ্যের জাতীয় সংগঠন এসআইএনডি-এর পরিচালক নদ ক্রিস্টেনসেন।
শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কগুলো গবেষণার কাজে ব্যবহারের সিদ্ধান্তই গ্রহণ করা হয়। তারই অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে ভিরেনফেলড নিয়েলসেনের তত্ত্বাবধানে আসে সংগ্রহশালাটি।
এর কয়েক বছর পর লিস সোগ-এর কাছ থেকে একটি বার্তা পান নিয়েলসেন। সোগ জানতে চাচ্ছিলেন, কিয়েস্টেন নামক কোনো নারীর মস্তিষ্ক এ সংগ্রহশালায় থাকার সম্ভাবনা আছে কিনা।
কিয়েস্টেনের সন্ধানে
কোপেনহেগেনের সংবাদপত্র খায়েস্তলিত দাওব্লাদ-এ কাজ করেন লিস। নিজের এই 'গ্রেট আন্টের' খোঁজ শুরু করার পর এ পত্রিকাতেই অনেকগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন তিনি।
অনেকগুলো সূত্র থাকা সত্ত্বেও সেগুলো খাপছাড়া হওয়ায় লিসের অনুসন্ধান করতে শুরুতে বেগ পেতে হয়েছিল। শেষে দাদী ইঙ্গারের বলা হাসপাতালের নামের ওপর পূর্ণ মনোযোগ দেন তিনি।
অরিঞ্জ নামক ওই মানসিক হাসপাতালের রোগীদের তথ্য ইন্টারনেটে খুঁজতে শুরু করেন লিস। ন্যাশনাল আর্কাইভের তথ্য থেকে তিনি নিশ্চিত হলেন, কিয়েস্টেনের সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা করা হয়েছিল ওই হাসপাতালেই।
অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে তিনি মস্তিষ্ক সংগ্রহশালার কথা জানতে পারলেন।
ব্রেইন নাম্বার ৭৩৮
কোনো পরিবার তাদের ব্রেইন কালেকশনে সম্ভাব্য আত্মীয়ের খোঁজ করলে নৈতিক উভয়সংকটের কথা মাথায় রাখতে হয় বলে জানিয়েছেন নিয়েলসেন।
লিস সোগ কিয়েস্টেনের জন্য এ সংগ্রহশালায় অনুসন্ধান চালাতে ড্যানিশ ন্যাশনাল আর্কাইভস থেকে অনুমতি নিয়েছিলেন।
এ সংগ্রহশালায় থাকা প্রতিটি মস্তিষ্কের মালিকের নাম একগাদা কালো বইয়ে লিখে রাখা হয়েছে। সেখানেই কিয়েস্টেনের নাম খুঁজে পেলেন লিস।
'ন্যাশনাল আর্কাইভস আমাকে ফিরতি ইমেইল পাঠায়। সেখানে পাতার স্ক্যান করা ছবিতে আমি কিয়েস্টেনের নাম, জন্মদিনের পাশাপাশি একটি নাম্বারও দেখি। নাম্বার ৭৩৮,' লিস বলেন।
এরপর পরিচালক নিয়েলসেনকে লিখেন লিস। তার কাছে জানতে চান, ওই সংখ্যা লেখা কোনো বালতি সেখানে আছে কিনা।
নাম্বার বণ্টন করা থাকলেও সবগুলো বালতি সংগ্রহশালায় ছিল না। কোনো অজ্ঞাত কারণে কিছু বালতি হারিয়ে গেছে।
লিসের ইমেইল পেয়ে বেজমেন্টে গিয়ে ৭৩৮ নাম্বার বালতিটি খুঁজতে শুরু করেন ভিরেনফেলড নিয়েলসেন।
একটি তাকের ওপর ৭৩৮ সংখ্যা লেখা বালতিটি খুঁজে পান তিনি।
বালতির ভেতরে ফরমালডিহাইডে ডুবে আছে কিয়েস্টেনের মস্তিষ্ক।
প্রথম দেখার পর বালতিটিকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হয়েছিল লিসের।
'শ্বেতছিদ্র' বা লবোটমি
অতীতে মানসিক হাসপাতালগুলোতে রোগীদের চিকিৎসা করার একটি পদ্ধতি ছিল লবোটমি। এটি 'হোয়াইট কাট' নামেও পরিচিত ছিল।
চিকিৎসার অংশ হিসেবে কিয়েস্টেনেরও লবোটমি অস্ত্রোপচার করেছিলেন ডাক্তারেরা।
এ পদ্ধতিতে রোগীর মাথার ফ্রন্টাল লোবে ছিদ্র করে মগজের হোয়াইট ম্যাটার বের করে আনা হতো। এ কারণেই এটির নাম হয়েছিল 'হোয়াইট কাট'।
ফ্রন্টাল লোবের কিছু অংশে মানুষের আবেগীয় প্রতিক্রিয়া অবস্থিত। তাই তখনকার ডাক্তারেরা ভেবেছিলেন, এ অংশটুকু বের করে ফেললে রোগীকে কিছুটা শান্ত রাখা যাবে, ব্যাখ্যা করেন নিয়েলসেন।
বর্তমানে লবোটমিকে বর্বর পদ্ধতি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। ১৯৪০-এর দশক থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত যে সময়টাতে মস্তিষ্ক সংগ্রহ করা হয়েছিল, একইসময়ে বিশ্বের অন্য কোনো দেশের তুলনায় ডেনমার্ক গড়ে অনেক বেশি লবোটমি করেছে বলে মনে করা হয়।
ঝুঁকিপূর্ণ এ পদ্ধতিতে রোগীর মারা যাওয়ারও আশঙ্কা থাকত। তবে নিয়েলসেন বলেন, তখনকার ডাক্তারদের এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না।
মানসিক চিকিৎসাপদ্ধতি সীমাবদ্ধ ছিল ওই দশকগুলোতে। যেগুলো ছিল, সেগুলোও মারাত্মক পর্যায়ের পদ্ধতি ছিল।
রোগীকে ইলেকট্রিক শক, ইনসুলিন শক থেরাপি, লবোটমি ইত্যাদি দিয়ে চিকিৎসা করতেন ডাক্তারেরা।
প্রিফ্রন্টাল লবোটমির পথিকৃৎ ছিলেন পর্তুগিজ নিউরোলজিস্ট অ্যান্তোনিও ইগাস মনিজ। ১৯৪৯ সালে এর জন্য তাকে নোবেলও দেওয়া হয়।
১৯৫০ সালে কিয়েস্টেনের লবোটমি করানো হয়। ১৯৫১ সালে মারা যান তিনি। তার বয়স হয়েছিল স্রেফ ২৪ বছর।
ভবিষ্যতের জন্য শপথ
অরিঞ্জ সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালের একটা ছোট আলাদা ভবনে কিয়েস্টেনের মস্তিষ্ক খুলে নিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। সেখান থেকে তা রিসকভের ব্রেইন প্যাথলজি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়।
যে লোহার টেবিলের ওপর কাঠের হাড়িকাঠে মৃতের মাথা রেখে ডাক্তারেরা মস্তিষ্ক খুলতেন, সেটিও দেখেছেন লিস।
ভয়ানক এসব ইতিহাস নিজের ও নিজের পত্রিকার জন্য লিখতে গিয়ে লিস সবসময় মাথায় রেখেছিলেন, তার লেখা যেন একটা হরর গল্প হয়ে না যায়।
'আমি মনে করি না চিকিৎসকেরা খারাপ কিছু করতে চেয়েছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিল... আমার মনে হয় সবচেয়ে নৈতিক কাজটা হলো এ মস্তিষ্কগুলো দিয়ে কী করা হবে তা ঠিক করা। আর তারা এখন সেটাই করছেন। তারা চেষ্টা করছেন, এগুলোর মাধ্যমে আমাদেরকে কীভাবে সাহায্য করবেন তা খুঁজে বের করতে,' লিস বলেন।
এ মস্তিষ্কের সংগ্রহ ব্যবহার করে গত কয়েক বছরে কিছু গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা।
তবে সবদিক বিবেচনা করলে মস্তিষ্কগুলো ব্যবহার করে অনেক কিছুই করার সম্ভাবনা রয়েছে। লিস সোগ নিজের সবচেয়ে ব্যক্তিগত, ঘনিষ্ঠ পারিবারিক রহস্য ও গোপন অধ্যায় বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন মানসিক সমস্যা নিয়ে প্রচলিত কুসংস্কার দূর করতে।
"আমার দাদী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, 'আমার মনে হয় আমি আমার বোনের আরও কাছাকাছি চলে যাচ্ছি,'" বলেন লিস।
অনুবাদ: সুজন সেন গুপ্ত