নির্বাচনের ফলাফলে আশাহত ট্রাম্প
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক অদ্ভুত অভিবাসীদের দেশ, যেখানে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ কয়েক শতাব্দী ধরে সেখানে একত্রিত হয়ে ১৭৭৬ সনে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে। স্বাধীনতা ঘোষণার আগে তাদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ ছিল, উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল, পরিশেষে তাদের সেই স্বাধীনতার ঘোষণা। স্বাধীনতা ঘোষণার পরেই তারা সংবিধান রচনার কাজে হাত দেয় এবং প্রায় ১১বছর সময় লাগে একটি সংবিধান কার্যকর করতে। গৃহীত সংবিধানের কতগুলো সংশোধনী নিয়ে রাজ্যগুলোতে ১৭ ৮৭ সালে সংবিধান কার্যকর করা হয়।
সংবিধান প্রণয়নের সময় তাদের রাজ্যের সংখ্যা ছিল ১৩টি যা এখন পঞ্চাশে উপনীত হয়েছে। বহু রাজ্য বিভিন্নভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুসারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল ছাড়া তাদের নির্বাচন ব্যবস্থা অব্যাহত থেকেছে। তাদের নির্বাচন একক কোন আইনের আওতায় নয়। রাজ্যগুলোর নির্বাচনী আইন ও নির্বাচন ব্যবস্থা আলাদা। এর ফলে নির্বাচনের ফল পেতে অনেক সময় বিলম্ব ঘটে। যেমন সদ্যসমাপ্ত মধ্যবর্তী নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ ফল পেতে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে বিজয়ী প্রার্থীকে প্রদেয় ভোটের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ভোট পেতে হয়। এই বিধান অন্য রাজ্যগুলোর জন্য প্রযোজ্য নয়। সিনেটের ৯৯টি আসনের ফলাফল জানা গেলেও জর্জিয়ার একটি আসনের ফল জানতে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আসনটি ডেমোক্র্যাটরা পেলেই কেবল তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হবে, তা না হলে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের ভোটের উপর নির্ভর করতে হবে। ঘোষিত ফলাফলে ৪৯টি আসন গিয়েছে রিপাবলিকানদের দখলে। ম্যাজিক ফিগার ৫১টি। সেই হিসাবে সিনেটের কর্তৃত্ব ডেমোক্রাটদের কাছেই থাকছে বলা যায়।
এই নির্বাচনে এখন পর্যন্ত সিনেটের ১টি আসন রিপাবলিকানদের হাতছাড়া হয়েছে। প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে মাত্র ১টি আসন দূরে রয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ফলে রিপাবলিকান ২১৭ এবং ডেমোক্রাট ২০৫টি আসনে জয়লাভ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘকালের ইতিহাসে দেখা যায়, সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের পক্ষে যায় না। জনসাধারণ নানা কারণেই ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্টের দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং যার প্রকাশ ঘটে প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে ভোটের মাধ্যমে। এবারে নির্বাচনে মনে হচ্ছে, প্রতিনিধি পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে যাচ্ছে ডেমোক্রেটরা। রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের সম্ভাবনা বেশি।
মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মত একেবারে বিতর্কহীন নির্বাচনী ব্যবস্থা এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র করতে পারেনি। যদিও তারা তাদের কর্তৃত্ববাদীতার কারণে পৃথিবীর নানা প্রান্তের দেশগুলোকে নির্বাচন সংক্রান্ত উপদেশ দিয়ে থাকে। মার্কিনিরা নিজ দেশে একের পর এক বিতর্কিত নির্বাচন করলেও তারা চান পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বিতর্কবিহীন নির্বাচন করুক। আমাদের মনে আছে, গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল মানতে ডোনাল্ড ট্রাম্প অস্বীকৃতি জানান। ট্রাম্প আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন, 'নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে' -এ কথা বলে। যদিও আদালত তার এই অভিযোগ আমলে নেয়নি। এই নির্বাচনেও সেই পাল্টাপাল্টি কারচুপির অভিযোগ শোনা যাচ্ছে।
এবারের নির্বাচনের আগে নানা জরিপ ইঙ্গিত দিচ্ছিল, প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে যাচ্ছে। ডেনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনের পেছনে দেদার অর্থব্যয় ও তার শরীরী ভাষা এমন ধারণা দিচ্ছিল যে, কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ তো নিচ্ছেই এমন কি পরবর্তী নির্বাচনে তিনি আবার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন। নির্বাচনের ফল বোধহয় ট্রাম্পকে সবচেয়ে বেশি আশাহত করছে।
সকল জরিপ, বিশেষজ্ঞদের ধারনা কেন এমনটা উল্টে গেল? চাপের মধ্যে থাকা মার্কিন অর্থনীতি বিশেষ করে মূদ্রাস্ফীতি সেখানকার মানুষকে অস্থির করে তুলেছে। বাইডেন ইতিমধ্যে তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন অনেকখানি। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থতা এই সময় অনেক বেশি করে সামনে আসছে। ধারণা করা হয়েছিল, মানুষের এই ক্ষুব্ধতার বহিঃপ্রকাশ ঘটবে এই নির্বাচনে। কিন্তু কার্যত তেমনটি ঘটেনি। এর একটি বড় কারণ হতে পারে, সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্টের রায়ে নারীর গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেওয়া মার্কিন নাগরিকদের অনেক বেশি ক্ষুব্ধ করেছে। কোর্টে রায় রিপাবলিকানদের খুশি করেছিল।
জন্মনিয়ন্ত্রনের প্রশ্নে রিপাবলিকানরা সবসময়ই রক্ষণশীল। তারা মনে করে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বাতিল হওয়া উচিত। যদিও এই বিতর্কের গভীরতা অনেক বেশি। সেখানকার উচ্চ আদালতের রায় মার্কিন সমাজে নারীদের অর্জিত সাফল্য পিছিয়ে দেবে। তবে এটা ঠিক, নারীদের ব্যক্তি জীবনের স্বাধীনতা, কর্মজীবন সবকিছু মিলিয়ে নারীদের সন্তান ধারণের নানা সংকটের কারণে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রভাব পশ্চিমের দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে আছে। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনও জনসংখ্যা হ্রাসের চলমান প্রবণতায় উদ্বিগ্ন। চীন তার এক সন্তানের নীতি থেকে সরে আসছে। এখন তারা তিন সন্তান পর্যন্ত বৈধতা দিয়েছে।
করোনা মহামারি মোকাবেলায় বাইডেন প্রশাসনের গৃহীত পদক্ষেপ এবং সেই সময়ে ব্যাপক আর্থিক সংকটে পড়া মানুষকে নগদ সহায়তা প্রদান প্রশংসিত হয়। এবারের ভোটে এটার প্রতিফলন থাকতে পারে।
নির্বাচনের ফলাফলের অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই জো বাইডেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সামিটগুলোতে যোগ দিচ্ছেন। আসিয়ান, ইন্দোনেশিয়ার জি ২০ সম্মেলন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্ব মিডিয়ার প্রধান শিরোনাম জো বাইডেনের সঙ্গে শি জিনপিং এর মুখোমুখি তিন ঘণ্টার বৈঠক।
বাইডেন বলেছেন, চীনের পেসিডেন্ট শি'র সাথে একটা ভুল বোঝাবুঝি চলছে এবং এটার অবসান হওয়া দরকার। চীনের সঙ্গে কোন ধরনের শীতল যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জড়াতে চায় না। দুই প্রেসিডেন্ট পারস্পারিক সহযোগিতার উপর জোর দিয়েছেন। জো বাইডেন বলেছেন, তিনি চীনের সঙ্গে তুমুল প্রতিযোগিতা চান, কোনো সংঘাত চান না।
২০২১ সালে জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর এ পর্যন্ত কয়েকবার টেলিফোনে কথা হলেও এই প্রথম দুই নেতার মধ্যে সাক্ষাৎ ঘটলো। বিশ্ব মিডিয়া এটা খুবই ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করছে। সংকটময় বিশ্ব পরিস্থিতিতে এই দুই পরাশক্তির উষ্ণতা বিশ্বময় একটা স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বের চলমান সংকটময় অবস্থা মোকাবেলা করতে হলে জরুরি অনেকগুলো বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। 'তুমুল প্রতিযোগিতা' অর্থপূর্ণ করতে হলে বিশ্বময় বাণিজ্য বাধাগুলো অপসারণ করতে হবে। অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞাগুলো তুলে নিতে হবে। তবেই কেবল অবাধ ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাণিজ্যিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। চলমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রধান উপাদান সেমি কন্ডাক্টরের উৎপাদন ও বিপণনের সকল বাধা দুর হতে হবে।