ফুটবল বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে যেভাবে বৈশ্বিক জুয়ার প্রসার ঘটতে চলেছে
কাতারে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপে বিয়ার পানে নিষেধাজ্ঞা, লিঙ্গ বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তির সমর্থনে আর্মব্যান্ড পরলে খেলোয়াড়দের ব্যানের হুমকি– সবমিলিয়ে এই আয়োজনের নানান নিয়মকানুন নিয়ে সমালোচনা করছে পশ্চিমা বিশ্ব। অথচ, অশনির মেঘ ঘনিয়ে আসছে পশ্চিমাদের সমর্থিত এক ব্যবসা- জুয়াকে ঘিরে। পুরো বিশ্বের আর্থ-সামাজিক ও ক্রীড়াঙ্গনে পড়তে চলেছে যার গভীর প্রভাব। খবর ব্লুমবার্গের
ফুটবল বিশ্বকাপ ঘিরে জুয়া শিল্পের রয়েছে ১৬০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যবসার সম্ভাবনা। সঙ্গে বিকাশ ও উন্নতির লক্ষ্য তো আছেই। তাদের নিজস্ব সংকট থেকেও বাঁচাবে ফুটবলে সংশ্লিষ্টতা। যেমন আমেরিকার একটি বৃহৎ জুয়া-ভিত্তিক কোম্পানি ড্রাফটকিংস। সম্প্রতি তাদের বিপুল সংখ্যক জুয়ারি গ্রাহকের একাউন্টের তথ্য ফাঁস হয়, উত্তোলন করা হয় নগদ অর্থ। কোম্পানিটি জানায়, তাদের অন্তত ৩ লাখ ভোক্তার তহবিল এভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছে। গ্রাহকদের এই লোকসান তারা পুষিয়ে দেবে। কিন্তু, এ ঘটনায় পুঁজিবাজারে তাদের শেয়ারমূল্যে পতন ঘটেছে রাতারাতি।
মহামারি পরবর্তী সময়ে জুয়ার প্রসার সমাজে কোন ধরনের নেতিবাচক পরিণতি আসতে পারে, এটি তার সামান্যতম উদাহরণ মাত্র। ক্রীড়া-নির্ভর জুয়ার লেনদেন রমরমা হলে সমাজে আসক্তি, দুর্নীতি, অর্থপাচার বৃদ্ধির ঝুঁকি নতুনমাত্রা লাভ করবে। অথচ, অর্থসংকটে অনেক দেশের সরকার ও ক্রীড়া সংগঠন উদারীকরণ ও সংস্কারের মাধ্যমে বহুল সমালোচিত এই ব্যবসাকে জোরালো করার উদ্যোগ নিচ্ছে। অবৈধ দিকগুলিকে করতে চাইছে বৈধ।
বৈশ্বিক বিভিন্ন শক্তিও জুয়ার পক্ষে কাজ করছে। যেমন প্রযুক্তির প্রসারের ফলে হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। যেকোনো সময় চাইলেই দেখা যাচ্ছে খেলার সরাসরি সম্প্রচার। এতে মানুষের মধ্যে ক্রীড়ায় বাজি ধরার আবেদনও বাড়ছে। তার ওপর পুঁজি করে পুরো বছরজুড়ে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা বাজি লাগানোর সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।
করোনা মহামারিতে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে– তার মধ্যে রাজস্ব বৃদ্ধির নানান উপায় খুঁজেছে সরকারগুলি। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল থেকে শুরু করে থাইল্যান্ড– বিভিন্ন দেশের সরকার জুয়ার নীতিমালা শিথিল করছে। লকডাউন শুরুর পর অলস অর্থের এক জোয়ার দেখা যায় জুয়া শিল্পে।
এজন্যই ফুটবল বিশ্বকাপকে এক সুবর্ণ সুযোগ মনে করছে ড্রাফটকিংসের মতো কোম্পানি। বিশ্ব ক্রীড়ার প্রধান প্রধান আসর এবং মার্কিন বাজারের নতুন বৈধতা মিলে ২০২৫ সাল নাগাদ ক্রীড়া-ভিত্তিক জুয়া যুক্তরাষ্ট্রে ১৯ বিলিয়ন ডলারের হবে বলে ধারণা করছে ইউবিএস।
আমেরিকানদের নেই সকার তথা ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা। ব্লুমবার্গ ইন্টেলিজেন্সের বিশেষজ্ঞ ব্রায়ান এগারের প্রক্ষেপণ অনুসারে, এবারের বিশ্বকাপে মার্কিনীরা মাত্র ১৭০ কোটি ডলার বাজি ধরেছে, যা রাগবির সুপারবোল প্রতিযোগিতায় ধরা বাজির ভগ্নাংশ মাত্র। কিন্তু, এই অবস্থার পরিবর্তন চায় বেটিং কোম্পানিগুলো। এজন্য আগ্রাসী মার্কেটিং কৌশল নিচ্ছে তারা। গত বছর শুধুমাত্র ড্রাফটকিংস-ই নতুন গ্রাহক আকর্ষণে ব্যয় করেছে প্রায় ১০০ কোটি ডলার।
জুয়ার পক্ষে যারা- তাদের যুক্তি হলো– বৈধতাদানের মাধ্যমে এতদিন সুদূরপ্রান্ত থেকে সঙ্গোপনে পরিচালিত ব্যবসাগুলি–আইনি স্বীকৃতি নিয়ে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। তাদের অফশোর লেনদেন এখন হবে অনশোরে। ফলে অর্থপ্রবাহকে নজরে রাখা সহজ হবে কর্তৃপক্ষের।
যুক্তিগুলি ভালোই। কিন্তু, জুয়ার প্রসার অনেক সমস্যাও নিয়ে হাজির হবে। এরমধ্যেই ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিপুল অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ক্রীড়ায় এই দুর্নীতি বিস্তার ভয়াবহ মাত্রা লাভ করতে পারে। অপরদিকে, ডিজিটাল অর্থ লেনদেন, হ্যাকিং ঝুঁকি, গ্রাহকের তথ্যফাঁস এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বাড়বে নিঃসন্দেহে। এসব রুখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি তাল মিলিয়ে চলতে পারবে কিনা– তা নিয়েও থেকে যাচ্ছে সন্দেহ।
জুয়া শিল্পে মুনাফার মার্জিন বরাবরই ছিল উচ্চ। আর সেখান থেকে আরও বেশি বেশি রাজস্ব আদায় করতে চান নীতিনির্ধারকরা। এই আগ্রহটাই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়।
আগামী বছর অনলাইন স্পোর্টস বেটিং থেকে সাড়ে ৬১ কোটি ডলার রাজস্ব আদায়ের প্রত্যাশা করছে আমেরিকার নিউইয়র্ক রাজ্য। রাজ্যের এক সিনেটর বলেছেন, 'নিউইয়র্ক যা পাচ্ছে সেটাই যথেষ্ট আকর্ষণীয়, কারণ আগে কখনো তা পায়নি'।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজ্যের জন্য জুয়ার ব্যবসা ভালো– এমনটা ধরে নিয়ে কর্তৃপক্ষ হয়তো আগুন নিয়ে খেলছে। জুয়ার বর্তমান নীতিমালা অবিন্যস্ত ও শিথিল। নিউইয়র্ক রাজ্যের জুয়া নিয়ে নিজস্ব কিছু নীতিমালাও রয়েছে, যা আমেরিকার অন্য রাজগুলির চেয়ে ভিন্ন। যেমন বাজি লাগাতে ভোক্তার ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেখানে। অথচ কিছু জুয়া কোম্পানি এটিকে অমান্য করছে।
যুক্তরাজ্যের অভিজ্ঞতা থেকে এক্ষেত্রে শিক্ষা নিতে পারে আমেরিকাসহ বাকি বিশ্ব। দেশটিতে জুয়ার কারণে সামাজিক মূল্যদান বছরে অন্তত ১৩০ কোটি পাউন্ড (১৫০ কোটি ডলার)। তাছাড়া, গাঁজাকে বৈধতাদানের ব্যর্থতার মতোই এক্ষেত্রেও কালোবাজারের উপস্থিতি সম্পূর্ণভাবে দূর হবে না। ফলে প্রত্যাশিত রাজস্বও হয়তো পাওয়া যাবে না।
জুয়ার আসক্তি প্রবল- এমন অনেক দেশই এই ইচ্ছেপূরণ দৈত্যকে ফের বোতলে পুরতে চাইছে। সম্পূর্ণটা না হলেও আংশিকভাবে জুয়া বৃক্ষের ডালপালা ছাঁটতে উদ্যমী তারা। যুক্তরাজ্যকে সেই কৃতিত্ব দিতেই হবে, দেশটি এখন তরুণ সমাজকে আকৃষ্টকারী জুয়ার প্রমোশন ও স্পন্সরশিপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। তবে এখনও সামাজিক মাধ্যমের বিশাল পরিধিকে জুয়া ব্যবসা থেকে সাফসুতরো করতে পারেনি।
সাম্প্রতিক সময়ে অ্যামাজন ডটকমের মালিকানাধীন গেমিং ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম অনিবন্ধিত জুয়া-ভিত্তিক লাইভস্ট্রিম প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এর আগে একজন স্ট্রিমার দাবি করেছিলেন, তাকে ৩৬০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে ক্যাসিনো স্টেক, এই কোম্পানিটি আবার ফুটবল টিম এভারটনের স্পন্সর।
কোভিড-পরবর্তী বিশ্বে এমনতর অজস্র ঝুঁকি নিয়ে হাজির হয়েছে 'জুয়ারিকরণ' এর জোয়ার। আরও বেশি নীতিমালা প্রণয়ন এবং আইনের প্রয়োগ এখানে অপরিহার্য। জুয়ার প্রচার এবং এটিকে স্বাভাবিক ব্যবসার কাতারে ফেলার প্রবণতাও তার সাথে হ্রাস করতে হবে।