রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার চাপ প্রতিহত করছে উন্নয়নশীল বিশ্ব
চলতি মাসে বেঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত হয়েছে জি-২০ বৈঠক। এতে সোজাসাপ্টা অবস্থান নিয়ে হাজির হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। সম্মেলনে মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন বলেছেন, গ্রুপ অব টোয়েন্টি-ভুক্ত দেশগুলোকে অবশ্যই ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর জন্য রাশিয়ার নিন্দা করতে হবে। একইসাথে, মস্কোর ওপর দেওয়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞাও মেনে চলা উচিত তাদের।
অন্যদিকে, ৩০ নভেম্বর, ২০২৩ পর্যন্ত জি-২০'র সভাপতির দায়িত্বে থাকা ভারত যে মার্কিন এজেন্ডার সাথে সহমত নয়, সেটাও স্পষ্ট হয়ে যায়। ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়ে দেন, এই জোটের বৈঠক রাজনৈতিক সভা নয়, বরং অর্থনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে পারস্পরিক আলোচনার ক্ষেত্র। রুশ আগ্রাসনকে বোঝাতে 'যুদ্ধ' শব্দটির ব্যবহারেও আপত্তি জানান তারা। বরং একে 'সংকট' বা 'চ্যালেঞ্জ' বলেই বর্ণনা করেন। ফ্রান্স আর জার্মানি-ও বৈঠকের ঘোষণার খসড়ায় রাশিয়ার নিন্দা না থাকায় এটি বর্জন করেছে। ফলে কোনোপ্রকার মতৈক্য হয়নি।
গত বছরের ইন্দোনেশিয়ার সম্মেলনের মতোন চলতি বছরের বৈঠকেও জি-২০ ভুক্ত উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর নেতারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পশ্চিমা চাপকে অবজ্ঞা করেছেন। বিশেষ করে, ব্রাজিল, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা এই বিরোধিতায় অটল রয়েছে। বাস্তব দৃষ্টিতে তারা মনে করছে, রাশিয়াকে একঘরে করলে বিশ্ব আরো বিপন্ন হবে।
পরবর্তী দুটি জি-২০ সম্মেলন হওয়ার কথা ব্রাজিলে (২০২৪ সালে) এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় (২০২৫ সালে)। ফলে পশ্চিমারা এই বার্তা পেয়ে গেছে যে, বৈশ্বিক বিষয়ে তাদের মতামত আরোপ করা সহজ হবে না।
জি-২০ দেশের বেশিরভাগ নেতা প্রথমে জার্মানির বার্লিনে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দেন। সেখান থেকেই সরাসরি তারা ব্যাঙ্গালুরু আসেন। মিউনিখ সম্মেলনের প্রথম দিনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, 'বৈশ্বিক দক্ষিণের (উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশ) কাছে আমরা যে পরিমাণ বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছি তা আমাকে হতবাক করছে'। এখানে 'আমরা' বলতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোকেই বোঝান তিনি।
বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর প্রমাণ কী? প্রমাণ হলো- রাশিয়াকে একঘরে করার পশ্চিমা উদ্যোগে অল্প সংখ্যক উন্নয়নশীল দেশই সায় দিয়েছে। এমনকী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবের ভোটাভুটিতেও তাদের অংশগ্রহণ ছিল সীমিত।
বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণের বিবেচনায়, যেসব দেশ পশ্চিমাদের সাথে রুশ-বিরোধী অবস্থান নেয়নি, তাদের সবাই কিন্তু 'পশ্চিমা বিরোধী' নয়। বরং ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলো বাস্তবসম্মত বিভিন্ন বিবেচনা থেকেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হলো – রাশিয়ার জ্বালানি তেল ক্রয়ে মূল্যছাড়ের সুবিধা পাওয়া। আবার রাশিয়ার আকর্ষণীয় জ্বালানি খাত থেকে সরে এসেছে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো, এসব সম্পদ তারা বিক্রি করছে কম দামে– যা সস্তায় কেনার সুযোগ পাচ্ছে উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর ব্যবসা খাত।
রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের নতুন সুযোগগুলো কাজে লাগানো, অথবা পশ্চিমাদের সব বিষয়ে মাথার ওপর ছড়ি ঘোরানোতে বিরক্ত হয়েই হয়তো আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো ওয়াশিংটনের চাপ উপেক্ষা করছে। ফলে তারা মস্কোর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। উন্নয়নশীল বিশ্বের এই অস্বীকার ও অবজ্ঞার ফলেই হয়তো 'হতবাক' হয়েছেন এমন মন্তব্য করেন মাখোঁ।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের এক প্যানেল আলোচনায়, আফ্রিকা ও এশিয়ার তিনটি দেশের দেশের নেতারা ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পশ্চিমাদের অব্যাহত চাপের বিষয়ে তাদের অসন্তোষের কারণ ব্যাখ্যা করেন।
লাতিন আমেরিকার দেশ- ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরা এই সংঘাতে জড়িত সকল পক্ষকে একটি সমাধানের উপায় বের করার আহ্বান জানান। তার মতে, 'আমরা শুধু যুদ্ধ নিয়েই কথা বলতে পারি না'। অবশ্য একইদিন তিনি আগ্রাসন চালানোর ঘটনায় রাশিয়ার নিন্দাও করেন।
যথার্থ বলেছেন ভিয়েরা। পশ্চিমা দেশগুলো শত শত কোটি ডলারের অস্ত্র-সরঞ্জাম ইউক্রেনকে দিয়ে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করেছে। এমনকী ২০২২ সালের মার্চে যখন রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়, তখন এতে বাধ সাধে পশ্চিমারা। আর তাতে দুর্ভোগ বেড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। অথচ বিপজ্জনক এ যুদ্ধের ইতি টানার দরকার ছিল, নেওয়া যেত কূটনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ। কিন্তু, তা না করায় এই সংঘাত নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
তারপরেও পশ্চিমা রাজনীতিকরা অনন্ত যুদ্ধ ও ইউক্রেনকে আরো অস্ত্র দেওয়ার কথাই কেবল বলছেন। এই বাস্তবতায়, গত ২১ ফেব্রুয়ারি পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের নতুন স্টার্ট চুক্তি থেকেও সরে এসেছে রাশিয়া। এর আগে ২০০২ সালে 'অ্যান্টি-ব্যালেস্টিক মিসাইল ট্রিটি' থেকে এবং ২০১৯ সালে 'ইন্টারমিডিয়েট নিউক্লিয়ার ফোর্সেস ট্রিটি' একতরফাভাবে সরে আসে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্রধর দুই বৈরী দেশের মধ্যে নিয়ন্ত্রণের আর কোনো চুক্তি কার্যকর থাকলো না।
ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরা সমাধানের উপায় তৈরির যে পরামর্শ দিয়েছে, সেটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরেছে। কারণ, তারা মনে করছে, সংঘাত চলতে থাকলে তা বিশ্বের জন্য শুভ হবে না।
ওই প্যানেল আলোচনায় কলম্বিয়ার ভাইস-প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কিয়া মার্কুয়েজ বলেন, 'যুদ্ধে কে জিতবে, কে হারবে – আমরা সেই আলোচনায় যেতে চাই না। দিনশেষে আমরা সবাই হারি, হারে মানবতা ও মানবজাতি'।
শান্তিতে বিনিয়োগ দরকার, যুদ্ধে নয়
মিউনিখ সম্মেলনে বিশ্ব শান্তির পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী বিবৃতিটি দিয়েছেন নামিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী সারা কুগোনগেলওয়া আমাধিলা। তিনি বলেন, 'ইউক্রেন যুদ্ধের এক শান্তিপূর্ণ সমাধানকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। যাতে অস্ত্র কিনে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়ার বদলে– পুরো বিশ্ব ও তার সম্পদকে আপামর জনতার জীবনমান উন্নয়নে নিয়োজিত করা যায়'।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে ভোটাভুটিতে বিরত থাকে নামিবিয়া। এবিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমাদের মনোযোগ হলো সমস্যার সমাধানের দিকে, দোষারোপ অন্যের ওপর চাপানোর দিকে নয়'।
নামিবিয়ার প্রধানমন্ত্রীর মতে, যে অর্থ অস্ত্র ক্রয়ে ব্যয় করা হচ্ছে, 'তা দিয়ে ইউক্রেন, আফ্রিকা, এশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে এমনকী ইউরোপেও অর্থনৈতিক দুর্দশায় থাকা লাখো মানুষের কষ্ট লাঘব করা যেত'।
১৯৫৫ সালে আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলো উপনিবেশবাদ ও নব্য-উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করে বান্দুং সম্মেলন করে। এই সম্মেলনের মূল সিদ্ধান্তগুলোর ওপর ভিত্তি করে ইউক্রেনের জন্য একটি শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে চীন। এই প্রস্তাবে উন্নয়নশীল দেশের নেতৃবৃন্দের মতামতের প্রতিফলন রয়েছে।
তবে প্রতিযোগী চীন তো দূরঅস্ত, ইউরোপের নেতারা আমাধিলার মতো শান্তিবাদীদের পরামর্শেই কান দিচ্ছেন না। শান্তির বার্তায় তারা যেন বধির।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেল গত নভেম্বরে বিতর্কিত এক মন্তব্য করে বিশ্বব্যাপী নিন্দা কুড়ান। তিনি বলেছিলেন, 'ইউরোপ এক সাজানো বাগান। আর বাকি বিশ্ব হলো জঙ্গল। এই জঙ্গল বাগানে আগ্রাসন চালাতে পারে… তাই বাকি বিশ্বের সাথে আরো বেশি সম্পৃক্ত হতে হবে ইউরোপকে। নাহলে তারা আমাদের ওপর আগ্রাসন চালাবে'।
উপনিবেশিক মানসিকতার কুৎসিত প্রতিফলন ছিল তার বক্তব্য। উন্নয়নশীল বিশ্বেই যার সমালোচনা হয় বেশি।
মাখোর সাথে একমত পোষণ করে মিউনিখ সম্মেলনে বোরেল বলেছেন, 'তথাকথিত বৈশ্বিক দক্ষিণের অনেক দেশের সাথে আস্থাযোগ্য সহযোগিতার সম্পর্ক পুনর্নিমাণ করা দরকার। সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবিলার কথা বলায়, তারা আমাদের বিরুদ্ধে দ্বিচারিতার অভিযোগ করছে। তাদের এই ধারণাকে ভাঙতে হবে'।
পশ্চিমের বড় বড় আর্থিক সংস্থাগুলোও বোরেলের মতো শীর্ষ কূটনীতিকদের উদ্বেগকে তুলে ধরছে। বৃহৎ বিনিয়োগ সংস্থা ব্ল্যাকরক এক প্রতিবেদনে বলেছে, 'বিশ্ব এখন বিভাজিত হয়ে পড়ছে এবং প্রতিযোগী পক্ষগুলোর দ্বন্দ্বের এক যুগে প্রবেশ করছে'। অন্যদিকে ক্রেডিট সুইস বলেছে, বিশ্বব্যবস্থায় 'গভীর ও স্থায়ী ফাটল; দেখা দিয়েছে।
ক্রেডিট সুইসের বিশ্লেষণে, এই ফাটলের সুস্পষ্ট চিত্র তুলে ধরা হয়; যার একদিকে রয়েছে পশ্চিমা দুনিয়া (উন্নত পশ্চিমা দেশ ও তাদের মিত্ররা) – তাদের সঙ্গে বৈশ্বিক পূর্বের (চীন, রাশিয়া ও তাদের মিত্রদের) ব্যবধান বড় হচ্ছে মূল কৌশলগত স্বার্থের দ্বন্দ্ব ঘিরে। অন্যদিকে, বৈশ্বিক দক্ষিণ (ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন ও ভারতসহ অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশ) নিজ স্বার্থ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।
এই ঐক্যই বৈশ্বিক দক্ষিণকে ওয়াশিংটনের চাপের মুখে মাথানত না করার শক্তি দিচ্ছে।
- লেখক: বিজয় প্রসাদ ভারতীয় ঐতিহাসিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক। তিনি চীনের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের চংইয়াং ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল সায়েন্সের জ্যেষ্ঠ অনাবাসিক ফেলো। 'দ্য ডার্কার নেশনস' ও 'দ্য পোরার নেশনস'-সহ ২০টিরও বেশি বই লিখেছেন তিনি।