কয়েক দশক পুরনো ডলারের আধিপত্যকে হুমকিতে ফেলছে রাশিয়া-ভারত জ্বালানি বাণিজ্য
রাশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের আধিপত্য ক্ষয় করতে শুরু করেছে। এদিক দিয়ে ভূমিকা রাখছে ভারত ও রাশিয়ার তেল বাণিজ্য। কারণ, সমুদ্রপথে রাশিয়ান অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির অধিকাংশ চুক্তি নিষ্পত্তি অন্যান্য মুদ্রায় করছে নয়াদিল্লি ও মস্কো। খবর রয়টার্সের
ফলে বিশ্ববাণিজ্যে সর্বাধিক ব্যবহৃত মুদ্রা হওয়ার পরও ডলারের সর্বোৎকৃষ্ট উপযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারত দীর্ঘদিনের মিত্র রাশিয়ার সাথে এভাবে জ্বালানি তেল বাণিজ্য শুরু করে। এতে করে, বৈশ্বিক জ্বালানি তেল বাণিজ্য বড় পরিসরে অন্যান্য মুদ্রায় হওয়ার যে প্রচলন শুরু হয়েছে তার অনেক স্থায়ী প্রভাব পড়তে পারে ডলারের মানে।
ভারতের রয়েছে বিপুল জ্বালানি চাহিদা। দেশটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ জ্বালানি তেল আমদানিকারক। ওদিকে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর মস্কোর তেল কেনা কমাতে থাকে ইউরোপ। আমদানিতে দেয় নিষেধাজ্ঞা। মস্কোও খুঁজছিল বিকল্প বাজারে রপ্তানি বৃদ্ধির উপায়। এশিয়ায় চীন ও ভারত মস্কোর তেলের আগ্রহী ক্রেতা হয়ে ওঠে তারপর।
গতবছরের ৫ ডিসেম্বর রাশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর মূল্যসীমা আরোপেও সম্মত হয় পশ্চিমা দেশগুলোর জোট। তারপর থেকেই ভারতীয় ক্রেতারা রাশিয়ান তেলের মূল্য পরিশোধ করছেন ডলার বাদে অন্যান্য মুদ্রায়। ব্যাংকিং ও জ্বালানি বাণিজ্যের বেশকিছু সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দিরহাম দিয়ে ভারত আমদানি দায় নিষ্পত্তি করছে, সম্প্রতি রাশিয়ান রুবলেও মেটানো হচ্ছে তেলের দাম।
সূত্রগুলো আরও জানায়, গত তিন মাসে এভাবে কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের আমদানির দাম অন্যান্য মুদ্রায় নিষ্পত্তি করা হয়েছে। জ্বালানি বাণিজ্যের ব্যাপক এই পরিবর্তন নিয়ে এর আগে সেভাবে জানা যায়নি।
এতে পশ্চিমাদের পরিকল্পনাও ভেস্তে যাচ্ছে। গেল বছর জি-৭ ভুক্ত দেশগুলো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অস্ট্রেলিয়া রাশিয়ান তেলের ওপর মূল্যসীমা আরোপে সম্মত হয়। এই সীমা না মানলে, রাশিয়ান তেল বাণিজ্যকে শিপিং ও বিমাসহ পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর অন্যান্য সেবাপ্রদানে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিষয়ে তারা ঐক্যমত্য হয়।
প্রতিক্রিয়ায় মস্কো জানায়, তারা কখনোই মূল্যসীমা মানবে না। এই বাস্তবতায় জ্বালানি পরিবহন ও বিক্রির বিকল্প উপায় সন্ধান করতে থাকে রাশিয়া। অচিরেই তা পেয়েও যায়। বর্তমানে দুবাই-ভিত্তিক কিছু জ্বালানি ব্যবসায়ী সংস্থা, রাশিয়ার জ্বালানি কোম্পানি গ্যাজপ্রম ও রসনেফট রাশিয়ান তেল বিক্রির মূল্য হিসেবে ডলার-ছাড়া অন্যান্য মুদ্রায় পেমেন্ট নিচ্ছে।
অপরিশোধিত তেল বা ক্রুড অয়েলের মান অনুযায়ী বিভিন্ন ক্যাটাগরি রয়েছে। রাশিয়ান ক্রুডেরও তেমনি একটি বিশেষ ধরন বিগত কয়েক সপ্তাহে পশ্চিমাদের বেঁধে দেওয়া ব্যারেলপ্রতি ৬০ ডলার মূল্যসীমার চেয়ে বেশি দরে বিকোচ্ছে।
বিষয়টি গোপন ও স্পর্শকাতর হওয়ায় সংশ্লিষ্টরা নাম না প্রকাশের শর্তে এই তথ্য জানান রয়টার্সকে।
তবে মার্কিন কর্মকর্তা ও জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের কাছে রাশিয়ার বিক্রি করা মোট তেলের তুলনায় খুব ছোট অংশেরই লেনদেন এভাবে হচ্ছে। এই বাণিজ্য পশ্চিমা সেবাগুলোকে এড়িয়ে রাশিয়ান বিমা ও শিপিং এর মাধ্যমেও হওয়া সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাবেক কর্মকর্তারা এবং বাণিজ্যিক সূত্রগুলো জানায়, মস্কো নিজ অর্থনীতিকে ডলারের প্রভাবমুক্ত করতে চাইছে। যার সাথে সঙ্গতি রেখে, ভারতের তিনটি ব্যাংক অন্যান্য মুদ্রায় মূল্য পরিশোধের কিছু লেনদেনে সহায়তা দিয়েছে।
এদিকে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র মস্কো ও আবুধাবি-ভিত্তিক রাশিয়ান ব্যাংক এমটিএসকে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ফলে আগামী দিনে রাশিয়ান তেলের দাম দিরহামে পরিশোধ করাটা আরো কঠিন হয়ে উঠবে।
জ্বালানি বাণিজ্যের সূত্রগুলো জানায়, নন-ডলার ভারতীয় পেমেন্ট সম্পন্ন করতে সহায়তা দিয়েছে এমটিএস ব্যাংক। তবে রয়টার্স এবিষয়ে যোগাযোগ করে মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয় বা এমটিএস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ – কারোরই মন্তব্য পায়নি।
ভারতীয় একটি শোধনাগারের সূত্র জানায়, যুদ্ধের পর থেকে বেশিরভাগ রাশিয়ান ব্যাংক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়লেও, ভারতীয় ক্রেতা ও রাশিয়ান সরবরাহকারী – উভয়পক্ষই এই বাণিজ্য চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
ওই কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, 'প্রয়োজনে পেমেন্ট গ্রহণের জন্য রাশিয়ান সরবরাহকারীরা অন্য ব্যাংক খুঁজে বের করবে। তাছাড়া, আমাদের সরকারও বলেনি রাশিয়ার তেল কেনা বন্ধ করতে। তাই আমরা আশাবাদী যে, মূল্য পরিশোধের বর্তমান উপায় বন্ধ হলে- বিকল্প ব্যবস্থা পাওয়া যাবে'।
'বন্ধুসুলভ' বনাম 'শত্রুভাবাপন্ন'
গত কয়েক দশক ধরেই তেলের মূল্য ডলারের পরিশোধ করা একটি সর্বজনীন চর্চায় রূপ নেয়। সে তুলনায়, মোট বিশ্ববাণিজ্যে ডলারের লেনদেন বেশ কম বা প্রায় ৪০ শতাংশ বলে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট ব্যবস্থা সুইফটের জানুয়ারি মাসের তথ্যে দেখা যায়।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বর্তমানে উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারের ফেলো ড্যানিয়েল আন বলেন, ডলারের শক্তি তুলনাহীন, কিন্তু রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ফলে পশ্চিমা আর্থিক ব্যবস্থা দুর্বল হতে পারে, একইসঙ্গে হয়তো নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্যও অর্জন করতে পারবে না।
অবশ্য তিনি এটাও মনে করেন যে, 'ডলার- ছাড়া অন্য মুদ্রায় রাশিয়ার পণ্য/ কাঁচামাল বিক্রির স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ– পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো অকার্যকর হওয়ার প্রধান হুমকি নয়। বরং মস্কোর বিরুদ্ধে আরেকটি প্রশাসনিক স্তর যোগ করে পশ্চিমারা নিজেরাই নিজেদের আর্থিক সেবা খাতকে দুর্বল করছে'।
২০২২ সাল জুড়েই রাশিয়ার জ্বালানি তেল আমদানির ওপর নানান বিধিনিষেধ দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এরপর মুল্যসীমা আরোপেও সম্মতি দেয়। তারও আগে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে বৈশ্বিক আর্থিক পেমেন্ট সিস্টেম- সুইফট থেকেও বহিষ্কার করে।
রাশিয়া যুদ্ধের আগেই ৬৪ হাজার কোটি ডলারের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ গড়ে তুলেছিল, যুদ্ধ শুরুর পর এর প্রায় অর্ধেকই ফ্রিজ করেছে পশ্চিমা দেশ ও তাদের মিত্ররা।
প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া জানায়, এখন থেকে তারা 'বন্ধুসুলভ' দেশের মুদ্রায় জ্বালানি তেলের মূল্যগ্রহণ করবে এবং গেল বছর 'শত্রুভাবাপন্ন' ইইউ-ভুক্ত দেশগুলোকে রাশিয়ান গ্যাসের দাম রুবলে পরিশোধের আদেশ দেয়।
রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক- ব্যাংক অব রাশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা অ্যালেক্সান্ডার প্রোকোপেঙ্কো বলেন, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা অমান্য না করার পরও অনেক রাশিয়ান ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের (ডলারে) পেমেট আটকে রাখা হয় বা অনেক দেরিতে দেওয়া হয়। ফলে ডলার তাদের কাছে 'বিষাক্ত সম্পদে' পরিণত হয়।
তিনি বলেন, তেল ও গ্যাস বিক্রির রাজস্বের ওপর ব্যাপক নির্ভরশীল হওয়ায়– বাকি বিশ্বের সাথে বাণিজ্য করাটা রাশিয়ার একান্ত প্রয়োজন। তাই দেশটি সম্ভাব্য সকল উপায়ে তা অব্যাহত রাখতে চাইছে। তারা রাশিয়ান ও ভারতীয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে সরাসরি লেনদেনের একটি কাঠামো তৈরির কাজও করছে'।
ভারতের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ঋণদাতা- স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ভারতে একটি নস্ট্রো একাউন্ট বা বৈদেশিক মুদ্রায় খোলা ব্যাংক হিসাব রয়েছে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে সহায়তা দিতে, একইভাবে রাশিয়ার অনেক ব্যাংকও ভারতে একাউন্ট খুলেছে।
চলতি মাসে আইএমএফের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর গীতা গোপীনাথ-ও বলেছেন, রাশিয়ার ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞার ছোট ছোট বাণিজ্য জোটগুলো ডলারের বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনে উৎসাহিত হবে; ফলে ডলারের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ হতে পারে।
অভিজাত ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে তিনি বলেন, 'এই অবস্থাতেও বিশ্বের প্রধান মুদ্রার স্থান ধরে রাখবে ডলার, তারপরও আরো ছোট স্তরে ডলারের আধিপত্য ক্ষয় হয়ে যাওয়া একটি নিশ্চিত সম্ভাবনা'। এবিষয়ে আইএমএফের মন্তব্য জানতে চায় রয়টার্স, তবে সংস্থাটি তাতে সাড়া দেয়নি।
রাশিয়া ছাড়া চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধের কারণেও ডলার-নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থার ক্ষয় হচ্ছে।
যেমন রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে চীনা মুদ্রা ইয়েন বা রেনমিনবির বড় মজুত আছে। অন্যদিকে, চীনও তাদের রিজার্ভে ডলারের অংশ কমাচ্ছে। গত বছরের সেপ্টম্বরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও বলেন, ইয়ান ও রুবলের মাধ্যমে চীনের কাছে জ্বালানি তেল বিক্রিতে রাজি হয়েছে মস্কো।
ইউরোপের বিকল্প হয়েছে ভারত
সমুদ্রপথে রাশিয়ার রপ্তানিকৃত তেলের শীর্ষ ক্রেতা হিসেবে গত বছরেই ইউরোপের স্থান দখল করে ভারত। রাশিয়া থেকে সস্তায় লাখ লাখ ব্যারেল তেল কিনেছে দেশটি। আগের বছর বা ২০২১ সালের তুলনায় এসময় ১৬ গুণ বেশি রাশিয়ান ক্রুড কেনে দিল্লি। এ তথ্য জানিয়েছে প্যারিস-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা (আইইএ)। এমনকী গেল বছর দেশটির মোট আমদানির এক-তৃতীয়াংশই ছিল রাশিয়ান ক্রুড।
বাণিজ্যিক সূত্রগুলো জানায়, মস্কোর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে ভারত স্বীকৃতি না দিলেও, অধিকাংশক্ষেত্রেই ক্রয় করেছে মস্কোর সুবিধামতো মুদ্রায়। বেশিরভাগ ক্রয়ই হয়েছে রাশিয়ার তেলে আরোপিত পশ্চিমা মূল্যসীমার চেয়ে কম দরে।
তবে এই বাণিজ্যে যাতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন না হয় সেবিষয়ে সতর্ক থেকেছে ভারতের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
তবে বিগত কয়েক সপ্তাহ ভারতীয় পরিশোধনারগুলো রাশিয়ান তেলের দর রুবলে পরিশোধ শুরু করেছে বলে সূত্রগুলো জানায়। মূল্য পরিশোধের প্রক্রিয়ায় আংশিক সহায়তা দিয়েছে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার রাশিয়ায় রুবলে খোলা নস্ট্রো একাউন্ট। এসব ক্রয়ের বেশিরভাগই করা হয় রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গ্যাজপ্রম ও রসনেফট থেকে।
অন্যদিকে, দিরহামে মূল্য পরিশোধের বেশিরভাগ লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে ব্যাংক অব বরোদা এবং এক্সিস ব্যাংকের মাধ্যমে।
এই দুটি ব্যাংকসহ গ্যাজপ্রম ও রসনেফট এবিষয়ে রয়টার্সকে কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হয়নি।
তবে ব্যাংকিং সূত্রগুলো জানিয়েছে, রুবলে লেনদেনে আরো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে- ভারতীয় ব্যাংকগুলো রুপিতে বাণিজ্যিক লেনদেন নিষ্পত্তি করবে।
মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে এবিষয়ে জানতে চাইলে, তারা মার্কিন অর্থমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের প্রতি জোর সমর্থন ব্যক্ত করে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর দুই সপ্তাহের মাথায় মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন বলেছিলেন, 'আমি মনে করি, ডলারের বিরুদ্ধে কোনো গুরুতর প্রতিযোগিতা নেই, এবং আরো দীর্ঘকাল তেমন ঝুঁকিও দেখি না'।