তীব্র গরমে জমজমাট এসির বাজার
কয়েক দিন ধরেই ঢাকাসহ দেশের বড় অংশজুড়ে প্রচণ্ড গরমে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে মানুষের। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, ৫৮ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গরম অনুভূত হচ্ছে রাজধানীতে। আর এই গরমে বেড়েছে এয়ার কন্ডিশনার বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের বিক্রি।
আমদানিকারক, প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও রাজধানীতে বেশ কিছু বিক্রয়কেন্দ্র ঘুরে জানা যায়, রাজধানীতে গত কয়েকদিনে এসির চাহিদা বহুলাংশে বেড়েছে। বিক্রেতারা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় এখন এসির বিক্রি ৫ গুণেরও বেশি।
এমনকি গত বছর এপ্রিলের তুলনায়ও দুই থেকে চারগুণ পর্যন্ত বেশি বিক্রি হচ্ছে।
ওয়ালটন এয়ার-কন্ডিশনারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর রহমান সজিব টিবিএসকে বলেন, "গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় আমরা এই এপ্রিলে ১০০% বেশি প্রবৃদ্ধি এবং স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৪০০% বেশি প্রবৃদ্ধি দেখছি।"
তিনি বলেন, "সাধারণ সময়ে দিনে এক হাজার ইউনিটের মতো বিক্রি হলেও এখন তা সাড়ে তিন চার হাজার ইউনিটে উন্নীত হয়েছে। ভালো মান এবং দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় ওয়ালটনের এসি গ্রামেও প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। করপোরেট হাউজেও আমরা বিপুল সাড়া পাচ্ছি।"
দেশের বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত গ্রি এসির বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান ইলেক্ট্রো মার্ট। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহ ধরে তাদের এসি বিক্রি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এমনকি গত বছর এপ্রিলের তুলনায়ও এটি প্রায় দ্বিগুণ।
ইলেক্ট্রো মার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ নুরুল আমিন বলেন, গ্রি এসির চাহিদা সারা বছরই থাকে। তবে গত এক সপ্তাহে বিপুল চাহিদা তৈরি হয়েছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম শহরে বিক্রি দ্বিগুণের বেশি।
তিনি বলেন, "নতুন প্রযুক্তির ইনভার্টার এসির চাহিদা বেশি। ইনভার্টার এসির বড় সুবিধা হচ্ছে ইনভার্টার এসির কমপ্রেসর মোটরটি প্রয়োজনমতো নিজস্ব চলার গতি পরিবর্তন করতে পারে। এমন একটি সেন্সর থাকে, যা ঘরের তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে কমপ্রেসর পুরোপুরি বন্ধ না করে, মোটরটির চলার গতি কমিয়ে দেয়। এর কারণেই বিদ্যুৎ খরচ কমে আসে, যা পরিবেশবান্ধব।"
দুই বছর আগেই বাচ্চার জন্য ঘরে এক টনের এসি লাগিয়েছেন মালিবাগের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন। এবারের তীব্র গরমে মায়ের থাকার রুমেও এসি কিনতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। গতকালই মগবাজার থেকে আরেকটি দেড় টনের জেনারেল ব্র্যান্ডের এসি কিনেন আমজাদ।
আমজাদ বলেন, "যে বেতনে চাকরি করি তাতে দুটি এসি চালানো ভীষণ কষ্টের ব্যাপার হবে। তবে গরমও সহ্য হচ্ছে না। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে ইএমআইতে এক লাখ টাকায় নতুন এসি কিনেছি। ধীরে ধীরে দেনা শোধ করবো।"
দেশে বিদেশি ব্র্যান্ডের এসির সবচেয়ে বড় বিক্রেতা এসকোয়ার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড মনে করে, আবহাওয়ার পরিবর্তন এবং সাশ্রয়ী মূল্য এসির বিক্রয় বৃদ্ধির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
এসকোয়ার ইলেকট্রনিক্স যেসব আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের এসি ডিস্ট্রিবিউট করে তার মধ্যে রয়েছে জেনারেল ইলেকট্রনিক্সের জেনারেল এয়ার কন্ডিশনার, জাপানের শার্প এবং ডাচ ব্র্যান্ড ফিলিপস।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মঞ্জুরুল করিম বলেন, "এবার হিট ওয়েভের একটি আশঙ্কা ছিল। আমরা সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় চারগুণ এবং আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ বিক্রি হচ্ছে।"
দেশের এসি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে স্যামসাং, মাইওয়ান, ইউনিটেক, ট্রান্সকম ডিজিটাল, ভিশন, যমুনা এবং বাটারফ্লাইয়ের বিক্রি ৫০-১০০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
কারওয়ান বাজারে অবস্থিত ট্রান্সকম আউটলেটের বিক্রয়কর্মী ইমরান হোসেন বলেন, "সাধারণত আমাকে মেশিন বসানোর জন্য ক্রেতাদের বাড়িতে বাড়িতে যেতে হয় কিন্তু আজকাল গ্রাহকের চাপ সামাল দিতে আমাকে আউটলেটেই থাকতে হচ্ছে।"
এক বছরে এসির দাম বেড়েছে ১৫-২০%
এসিআই গ্রুপের মার্কেটিং বিভাগে মাসিক ৫০,০০০ টাকা বেতনে চাকরি করেন নওশাদ হোসেন। শিশুসহ তিন সদস্যের পরিবার তার। সম্প্রতি তিনি ৪৬ হাজার টাকায় স্থানীয়ভাবে তৈরি একটি এসি কিনেছেন।
নওশাদ বলেন, "ঢাকার অসহনীয় গরমের জন্য আমি ইএমআইতে এসি কেনার সাহস দেখিয়েছি। কিন্তু গত বছরের তুলনায় দাম অনেক বেড়েছে। তবু খুশি লাগছে যে, এই গ্রীষ্মে আমার সন্তানকে স্বস্তি দিতে পেরেছি।"
বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে প্রায় সব কোম্পানির এসির দামই এক বছরে ১৫-২০% বেড়েছে।
এক বছর আগে ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া চায়নিজ এসির দাম এখন ৪২ হাজার থেকে ৪৮ হাজার টাকা। দেড় টনের (স্থানীয় বা চায়নিজ) এসির দাম এখন ৭০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা, যা এক বছর আগেও ৬০ হাজার টাকা থেকে ৬৫ হাজার টাকার মধ্যে ছিল। বিদেশি বড় ব্র্যান্ডের একই সাইজের এসির দাম ৯০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা ছিল, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায়।
বাংলাদেশে স্যামসাংয়ের এসি প্রস্তুতকারী ফেয়ার গ্রুপের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, "ডলার সংকট এবং বিশ্ববাজারে কাঁচামাল ঘাটতির কারণে উৎপাদকদের খরচ ৪০% পর্যন্ত বেড়েছে। তাই কোম্পানিগুলোর দাম বৃদ্ধি করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।"