কিশোর গ্যাং: অন্যের সন্তান বখে যায় যাক, আমার সন্তান দুধে ভাতে থাক
পানির মূল ট্যাংকে যদি দূষিত বা ময়লা পানি থাকে, তাহলে সেই ট্যাংকের সাথে সংযুক্ত প্রতিটি কল থেকেই ময়লা পানি বের হবে। সেক্ষেত্রে যতক্ষণ পর্যন্ত না মূল ট্যাংকের পানি পরিশোধিত হবে, ততক্ষণ অন্য কলগুলোতেও সেই দূষিত পানিই আসতে থাকবে। মানুষের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। সমাজের অভিভাবক, পথ প্রদর্শক ও কাণ্ডারিরা যদি ভুল পথে যায়, তাহলে যুব সমাজ, শিশু-কিশোর সেই দিকেই ধাবিত হয়।
এই সমাজে আমরা যারা অভিভাবক, তারা নিজের দিকে চোখ ফেরালেই বুঝবো যে কিভাবে অসচেতনতা, অসততা, দ্বন্দ্ব, বিচ্ছেদ, প্রতিহিংসা, ক্ষমতা ও অর্থলোভের মত নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের সন্তানদের ধ্বংসের পথে পরিচালিত করছে।
শিশু-কিশোররা দেখছে পরিবার ও সমাজের মধ্যে চরম অব্যবস্থা, মূল্যবোধের অভাব, ভালবাসাহীনতা, অসততা এবং অর্থের প্রতি মোহ। পরিবারের ভিতরে অপরাধী বা অপরাধের উপস্থিতি শিশুকে বিপদের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বন্ধুবান্ধবরাই শিশু কিশোরদের অপরাধ জগতের দিকে টেনে নিলেও 'সমাজে বড় ভাই হয়ে শক্তি দেখানোর' প্রবণতা শিশুকে অপরাধী হতে প্রলুব্ধ করছে।
আজকে এই যে কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান, ক্ষমতা ও সংখ্যাবৃদ্ধি- এর দিকে তাকালে স্পষ্ট বোঝা যায় যে এই প্রেক্ষাপট একদিনে তৈরি হয়নি। অথবা কিশোররা নিজেরা এজন্য দায়ী নয়। দায়ী আপনি, আমি, আমরা। আমরা বুঝতেই পারছি না যে আমাদের সন্তানদের হারিয়ে ফেলছি খুব দ্রুত। গল্পে যেমন পড়েছি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার পেছনে শহরের সব শিশু-কিশোররা দলবেঁধে ছুটে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি আমাদের সন্তানেরা অপরাধ জগতের পেছনে ছুটে যাচ্ছে।
'গডফাদার' নামক বাঁশিওয়ালার পেছনে চলতে চলতে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ছে অনেকেই। এই অবস্থা চলতে থাকলে, একদিন এমন হবে যে বাবা-মায়েরা ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি, ভাঙা দেহ, ব্যথিত হৃদয় নিয়ে শূন্য অট্টালিকায় বসে থাকবেন, আর তাদের আদরের সন্তানরা হারিয়ে যাবে অপরাধ জগতে। এখন ব্যস্ত হয়ে, ন্যায় নীতি বিসর্জন দিয়ে যা আয় করছেন, সব ভেসে যাবে। কারণ সন্তান যদি মানুষ না হয় তাহলে জীবনের অর্জন ষোল আনাই মিছে হয়ে যায়।
কিশোর গ্যাং এর সাথে জড়িত কিশোরদের অনেকেই বলেছে তাদের সামনে কোন 'রোল মডেল' নেই। এই কিশোরদের জীবনের লক্ষ্য 'বড় ভাই' হওয়া। রাজনৈতিক দলে থাকা বড় ভাইদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি কিশোরদের প্রলুব্ধ করে। এই বাস্তবতারই প্রতিধ্বনি শুনেছি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলামের ভাষ্যে। তিনি বলেছেন, "কিশোররা দেখে অপরাধীরা হিরো। তারা দেখে বড়রা নানা অপরাধ করে ক্ষমতাবান হচ্ছে। ফলে তারাও সেই পথে যায়, তারাও গ্যাং গঠন করে নিজেকে ক্ষমতাবান করতে চায়, হিরো হতে চায়।"
সেই অপরাধ জগতটাই খুব দ্রুত গড়ে উঠছে আমাদের চারপাশে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বখাটে কিশোর-তরুণ নিয়ে এমন চক্র গড়ে উঠেছে, যারা মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, নারীর শ্লীলতাহানি ও খুনসহ নানান অপকর্মে যুক্ত। এসব চক্রের সদস্যদের বড় অংশই কিশোর এবং দলের নেতারা যুবক। নেতাদেরকে 'সিনিয়র' বা 'বড় ভাই' বলে ডাকে চক্রের সদস্যরা। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরাই কিশোর গ্যাং-এর নেপথ্যে সক্রিয় বলে অভিযোগ আছে। তাই পুলিশ একটি গ্যাং ধরে তো আরেকটি গ্যাং গজিয়ে ওঠে, বিলুপ্তি আর ঘটেনা।
রাজধানীতে সক্রিয় ৫২টি 'কিশোর গ্যাং' চক্রের নাম পেয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ। চক্রের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬৮২ এবং এই সদস্যরা কিন্তু ভিনগ্রহ থেকে আসা কেউ নয়' আপনার, আমার সন্তান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা কমেনি, বরং প্রকোপ ও পরিধি দুই-ই বেড়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে, বিভিন্ন এলাকায় কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত কিশোর গ্যাং সদস্যদের আটকের পর তাদের কাছ থেকেই জেনেছে যে, কিছু অসৎ ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা নির্মাণ কাজসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তোলার কাজে তাদের ব্যবহার করে। এরাই কিশোরদের অস্ত্র দেয় ও অপরাধ করতে শেখায়। কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের শক্তির জোরে নিজেরাও স্বাধীনভাবেও অপরাধ করে।
অদ্ভূত নামকরণ করা হয়েছে এই সংঘবদ্ধ কিশোর গ্রুপগুলোর। যেমন 'ইয়াং স্টার', 'ডিসকো বয়েজ', 'বিগবস', 'রাজু গ্রুপ', 'রকি গ্রুপ', 'রোমান্টিক গ্রুপ', 'মুসা-হারুণ গ্রুপ', 'সোহেল গ্রুপ', 'অতুল গ্রুপ', 'পটেটো রুবেল গ্রুপ'। বাবা মায়ের কাছে সন্তান রাজপুত্র, রাজকন্যাসম। সেই আদরের সন্তানই একদিন ভিড়ে যায় অথবা নিহত হয় এইসব অপরাধ গ্রুপের হাতে।
রাজধানীর উত্তরায় ২০১৭ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কিশোর গ্যাংয়ের নির্মমতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। এই ৬ বছরে সেই গ্রুপ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫২টি। পুলিশ এদের কথা জানে, অজানা আরো গ্যাং থাকতে পারে। ডিএমপি জানিয়েছে এ পর্যন্ত ৪৬ মামলায় ২৩৬ জন কিশোর অপরাধী চক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এসব চক্রের সদস্যরা পার্টি করে, নেশা করে, হর্ন বাজিয়ে প্রচণ্ড গতিতে মোটরসাইকেল চালায়, ছিনতাই কওে, খুন কওে, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এবং রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। এসব করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক কারণে কিশোর অপরাধীরা সক্রিয় হলে সেটা নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে বেগ পেতে হয়।
খুব সম্প্রতি রাজধানীর বসুপাড়ায় স্কুলছাত্র সিয়াম খানকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তার আগে দনিয়া কলেজের সামনে 'জুনিয়র-সিনিয়র' দ্বন্দ্বে খুন হয় মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মুশফিক। পটুয়াখালীর বাউফলে দশম শ্রেণির দুই ছাত্রকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে ইন্দ্রকুল উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে একদল কিশোর। প্রায় সব হত্যাকাণ্ডের পেছনেই রয়েছে এলাকাভিত্তিক 'কিশোর গ্যাং'। অপরাধ কর্মকাণ্ডে কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে; কেবল রাজধানীতে নয়, সারাদেশে। অধিকাংশের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে।
ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ঘটলেও আমাদের ভেতর চরম শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। শিশু থেকে তরুণ-যুবার এই আচরণ একধরনের অসহিষ্ণু সমাজের কথা বলছে। মানুষের এই অসহিষ্ণু হয়ে উঠার পেছনে নানাধরনের ক্ষোভ ও নেতিবাচক উদাহরণ কাজ করে বলে মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন। তারা বলছেন শিশু-কিশোর ও যুবকদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।
শিশু অপরাধ বিষয়ক গবেষকরা মনে করেন, অপরাধে জড়িয়ে পড়া শিশুদের সামাজিক বন্ধন খুব দুর্বল থাকে। এই সামাজিক বন্ধনহীনতা একধরনের সমস্যা তৈরি করে। এদের অনেকেই মা বাবা ও পরিবারের ভালোবাসা, যত্ন ও মনোযোগ না পেয়ে অনাদরে অবহেলায় বড় হয়। আদর্শিক জায়গা থেকে তাদের সামনে কোনো 'রোল মডেল' থাকে না।
শিশু যদি ভালবাসাহীন, ঝগড়াঝাটিপূর্ণ এবং সন্দেহ-কোন্দলের মধ্যে বড় হয় তাহলে সেই শিশুও মায়াহীন মানুষ হয়। আপনজনের প্রতি তাদের কোন টান থাকেনা। পরিবারের মানুষের সাথে যেসব শিশুর মানসিক নৈকট্য বা শারীরিক স্পর্শের কোন যোগ থাকেনা, এরাই বড় হয়ে অসুস্থ মানসিকতার মানুষ হয়। জীবনের কোন এক সংকটে এই শিশু-কিশোররাই ঘৃণা ও দূরত্বকেই বেছে নেয় নিজের আবেগজনিত কষ্ট থেকে বাঁচতে এবং হয়ে ওঠে সহিংস। তারা এই সহিংসতার প্রকাশ ঘটাতে পারে নিজের প্রতি, বাবা-মা ও সমাজের প্রতি।
শিশু-কিশোররা মন্দ পথে চলে যায় দারিদ্র্যের কারণে, এটি একটি মাত্র কারণ। এদের মধ্যে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা যেমন আছে, তেমনি আছে নিম্নবিত্ত ঘরের নিরক্ষর কিশোর-তরুণরাও। বর্তমানে জীবনযাত্রা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। শিশুর প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের ভূমিকা হয়ে পড়েছে দুর্বল।
শিশু-কিশোররা ইউটিউব, টিকটক, ভায়োলেন্ট গেমস, পর্নোগ্রাাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এসব আসক্তিই মূলত তাদের মধ্যে ডেভিয়েন্ট বিহেভিয়ার বা সমাজ বহির্ভূত আচরণকে প্ররোচিত করে। অনেক সময় মা-বাবারা ব্যস্ত থাকার কারণে বা পারসোনাল স্পেসের জন্য ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন দিয়ে শিশুকে ছেড়ে দিচ্ছেন।
এছাড়া সমাজে নানাকারণে ডিভোর্স ও পারিবারিক সংঘাত বাড়ছে। এর নির্মম শিকার হচ্ছে সেই পরিবারের সন্তানরা। তারা সঠিক পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধাগুলো পায় না। পায় না যত্ন ও ভালবাসা। পায় অতিরিক্ত প্রশ্রয় বা শাসন, যার কোনটাই শিশু-কিশোরের জন্য ভালো না।
২০/২৫ বছর আগেও আমরা দেখেছি পারিবারিক কাঠামো, সামাজিক যোগাযোগ, একে অন্যের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক। এখন প্রযুক্তিভিত্তিক সামাজিক সম্পর্ক শিশুকে একা ও বিচ্ছিন্ন করে তুলেছে। সমাজের মধ্যে নৈরাজ্য, দুর্নীতি, অনৈতিক কার্যকলাপ বেড়েছে। কিশোর গ্যাং নিয়ে কাজ করা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, এর পেছনে ইন্টারনেট সংস্কৃতির প্রভাব থাকলেও মূল কারণ হলো স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতা এবং জনপ্রতিনিধিরা। তারাই তাদের স্বার্থে নতুন নতুন কিশোর গ্যাং তৈরি করে বখে যাওয়া ও হাতাশাগ্রস্ত শিশু কিশোরদের নিয়ে।
কিশোরেরা কেন এত বেশি হারে অপরাধে জড়াচ্ছে, তা নিয়ে কোন গবেষণা নেই, নেই একে প্রতিহত করার নীতিমালা। নীতি নির্ধারকরাও খুব একটা চিন্তিত নন। সবাই ভাবছেন অন্যের ঘরে আগুন লাগছে, আমার ঘর তো নিরাপদ। অর্থাৎ অন্যের সন্তান বখে যাবে, আমার সন্তান থাকবে দুধে ভাতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক সংবাদমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন, "কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা যখন দেখে তাদেরকে যারা ব্যবহার করছেন, তারা গণ্যমান্য, পুলিশসহ প্রশাসনের লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা করেন, তখন তারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাদের বয়স কম হওয়ায় তারা পরিণতির কথা চিন্তা না করে যেকোনো ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এটা এখন আমাদের একটি বড় সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে।"
শিশু-কিশোর উন্নয়নে সকল পক্ষের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে, নয়তো কোন লাভ হবে না। সন্তানকে যদি বাঁচাতে চাই, তাহলে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে অনেক শক্তিশালী ও সক্রিয় করতে হবে। পরিবার, সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, গণমাধ্যম, শিশু সংগঠক, বুদ্ধিজীবি সমাজ, নাগরিক সমাজসহ অন্যান্য পেশাজীবিদের এক হয়ে নিজেদের সন্তানকে বাঁচানোর ওয়াদা করতে হবে, নয়তো এই দেশটাই খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। কারণ একজন শিশুই একটি দেশ।
লেখক: যোগাযোগকর্মী