ওয়াগনার বিদ্রোহ: পুতিনের আধিপত্য পুনরুদ্ধার ও ইউক্রেন যুদ্ধে এর সম্ভাব্য প্রভাব
ওয়াগনার মার্সেনারি গ্রুপের নেতা ইয়েভগেনি প্রিগোজিন দাবি করেছিলেন, রাশিয়ার সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে তার বাহিনীর উপর আক্রমণ করেছে। প্রিগোজিন প্রথমে ন্যায়বিচার দাবি করেন। তবে শেষ পর্যন্ত এ ঘটনা সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ নেয়।
শুরুতে রাশিয়ার দক্ষিণ সামরিক জেলার সদর দফতর রোস্তভ-অন-ডনে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল ওয়াগনাররা। এরপর এগোতে থাকে মস্কোর দিকে।
তবে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় সমঝোতায় এসে বিদ্রোহ থেকে সরে আসে প্রিগোজিনের দল। এখন প্রিগোজিন বেলারুশে চলে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে; তার যোদ্ধারাও নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে।
ওয়াগনার গ্রুপ এবং রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর মধ্যে প্রকাশ্য শত্রুতা নতুন কিছু নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দুই দলই একে অপরের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে আসছে এবং শত্রুতামূলক পদক্ষেপও নিয়েছে।
বিদ্রোহের প্রচেষ্টা মূলত ইউক্রেনে রুশ সেনাবাহিনী এবং ওয়াগনার গ্রুপের মোতায়েন ও পরবর্তী রাজনৈতিক পদক্ষেপের ফল। তবে স্বল্পস্থায়ী এই বিদ্রোহ পরিবর্তন আনতে পারে ক্রেমলিনের ক্ষমতা কাঠামোতে। কিছু পদে আসতে পারে রদবদল। এমনকি প্রভাব পড়তে পারে ইউক্রেন যুদ্ধেও।
নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার
মূলত ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই রুশ সেনাবাহিনী ও ওয়াগনার গ্রুপের মধ্যকার সম্পর্কে ভাঙন ধরে। তার আগপর্যন্ত রাশিয়ার স্বার্থ পূরণে অনানুষ্ঠানিকভাবে কাজ করত মার্সেনারিরা। এর মাধ্যমে রাশিয়া সংঘাতে সরাসরি জড়িত হওয়ার বিষয়কে অস্বীকার করত।
যেমন সিরিয়া ও সুদানে নিজেদের স্বার্থ থাকলেও রাশিয়া সরাসরি সম্পৃক্ততা এড়াতে ওয়াগনার গ্রুপকে কাজে লাগায়।
আবার যেমন, ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলে সহায়তা করার জন্য ওয়াগনার গ্রুপকে ব্যবহার করা হয়েছিল। একই বছরে দনবাস অঞ্চলের কিছু অংশ দখলে জড়িত থাকার বিষয়টি রাশিয়া অস্বীকার করেছিল ওয়াগনার গ্রুপকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে।
তবে ইউক্রেন যুদ্ধ দুই দলের এমন মিত্রতায় পরিবর্তন নিয়ে আসে। রুশ সেনাবাহিনী ইউক্রেনে দ্রুত সামরিক বিজয় আশা করেছিল। কিন্তু শুরু থেকেই তারা এমন বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যে নিজেদের কার্যক্রমকে সরাসরি সমর্থন দিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াগনার গ্রুপকে মোতায়েন করতে বাধ্য হয়।
ইউক্রেনে রাশিয়াকে সাহায্য
ওয়াগনার গ্রুপকে মোতায়েন করার মাধ্যমে ইউক্রেনে রাশিয়া তার কার্যক্রম স্থিতিশীল করতে পেরেছে। ২০২২ সালে রুশ সেনাদের বড় অংশের চেয়ে বেশি প্রশিক্ষিত ও দক্ষ ছিল ওয়াগনার যোদ্ধারা। সিভিয়ারোদোনেতস্কে বিজয়ের মতো প্রাথমিক সাফল্যে বড় অবদান ছিল মার্সেনারিদের। তবে যুদ্ধে তাদের কম আত্মত্যাগ করতে হয়নি। ওয়াগনার গ্রুপের এত বেশি যোদ্ধা হতাহত হয় যে, তারা নিজেদের ঐতিহ্যগত কৌশল বজায় রাখতে পারেনি। মার্সেনারিরা নিজেদের দল ভারী করতে রুশ কারাগারসহ বিভিন্ন স্থান থেকে যোদ্ধা নিয়োগ শুরু করে।
এরপর থেকে রুশ আর্মি কিংবা ওয়াগনারদের আর স্বতন্ত্র কোনো সত্তা ছিল না। যুদ্ধে পুরোপুরিভাবে জড়িয়ে যায় মার্সেনারিরা। তখন নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব এক হাতে চলে যায়। এমনটা রাশিয়ার ক্ষেত্রে নতুন কিছু নয়। বরং বলা যায়, তা রাশিয়ার রাজনৈতিক পদ্ধতির অংশ। যার মূলে রয়েছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
পুতিনের প্রভাব
যেকোনো বিরোধে শেষ পর্যন্ত শুধু রুশ প্রেসিডেন্ট তার অধীনস্থদের মধ্য মধ্যস্থতা করতে পারেন। এটি তাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে এমন অধীনস্থদের ক্ষমতাকে সীমিত করার পাশাপাশি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তার গুরুত্বও বাড়িয়ে দেয়।
রুশ রাজনৈতিক ব্যবস্থার এই দিকটি স্বাভাবিক সময়ে অত্যন্ত কার্যকর। তবে সংঘাত বা সরাসরি যুদ্ধের সময়, বিষয়টি একরকম দায় হয়ে উঠতে পারে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের সময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পুতিনের অধস্তনরা তাকে ইউক্রেনীয় বা রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতার সঠিক ও স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরতে পারেনি।
দ্বন্দ্বের সময় বিষয়টি দুই দুটি ফলাফল নিয়ে আসতে পারত। প্রথমটি হলো, রুশ সেনাবাহিনী ও তার আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে নামমাত্র পারস্পারিক সহযোগিত হওয়া। আর সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হতে পারে, দুই দলের মধ্যে থাকা চাপা উত্তেজনা প্রকাশ্য সংঘাতে রূপ নেওয়া। যেমনটা দেখা গেছে ওয়াগনার গ্রুপ ও রুশ সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে।
যদিও এই ঝড় আপাতত কাটিয়ে উঠেছেন পুতিন, তবে ওয়াগান গ্রুপ রাশিয়ার প্রতি আধাসামরিক বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষের সবচেয়ে বড় উদাহরণে দেখিয়ে গেছে।
পুতিনের জন্য অজুহাতের সুযোগ?
১২ হাজার সদস্যের একটি আধাসামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া চেচেন নেতা রমজান কাদিরভ এর আগে তার বাহিনী এবং রুশ সেনাবাহিনীর মধ্যে সমস্যার কথা উল্লেখ করেছিলেন।
একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ওয়াগনারদের বিদ্রোহের মধ্যে পুতিন যখন টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তাদের নিন্দা করছিলেন তখন তিনি প্রিগোজিনের নামটি একবারও উচ্চারণ করেননি। ইচ্ছাকৃতভাবেই নামটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যাতে বিদ্রোহের সাফল্য বা ব্যর্থতার উপর নির্ভর করে পুতিনের হাতে বিকল্প খোলা থাকে।
স্বল্পস্থায়ী বিদ্রোহ এখনো ইউক্রেনের যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রভাব হয়ে উঠতে পারে। তবে এটি কীভাবে সংঘাতের চিত্র পাল্টে দেবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
যদি বিদ্রোহ আরো দীর্ঘ হতো, তাহলে পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান এবং নিজের মুখ বাঁচানোর একটি সুযোগ পেতেন। কারণ সংঘাতের শুরু থেকে রুশ প্রেসিডেন্ট জানতেন, ইউক্রেনে হারের ভার তিনি বহন করতে অক্ষম।
যদি তিনি পরাজয়ের জন্য এক বা একাধিক বলির পাঁঠার ওপর দোষ চাপাতে পারেন, যেমন ওয়াগনার গ্রুপ বা রাশিয়ার প্রতি এখনো ক্ষুব্ধ অন্যান্য আধাসামরিক গোষ্ঠী, তাহলে পুতিনের জন্য টিকে থাকা সহজ হতো।
তবে বিষয়টি এখনো পুতিনের অধীনস্থদের মধ্যে ক্ষমতা কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে পারে। ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তর্কযোগ্যভাবে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় আছেন পুতিন। তবে তিনি সহজে নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করবেন না।
প্রভাব বজায় রাখতে এবং রাশিয়ার উপর নিজের আধিপত্য পুনরুদ্ধার করতে পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধে এসবের সরাসরি প্রভাবসহ প্রতিটি সম্ভাবনা বিবেচনা করবেন।