রাশিয়ার কাছে অস্ত্র বিক্রির শঙ্কা, উত্তর কোরিয়াকে সতর্ক করল যুক্তরাষ্ট্র
রাশিয়ার সাথে অস্ত্র বিক্রির সম্ভাব্য চুক্তি করতে বেশ 'কার্যকরীভাবে অগ্রসর' হচ্ছে উত্তর কোরিয়া- এমনটাই দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন ইন্টিলিজেন্স রিপোর্ট মতে, ইউক্রেনে আক্রমণের গতি বাড়াতে উত্তর কোরিয়া থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেনার চেষ্টা করছে রাশিয়া।
গতকাল (বুধবার) হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি এমন অভিযোগ করেছেন। এছাড়াও রাশিয়ার কাছের অস্ত্র বিক্রি না করতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উত্তর কোরিয়াকে সতর্ক করেছেন তিনি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালীন উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রির আশংকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ফলে ওয়াশিংটন ও পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যকার উত্তেজনার পারদ যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত সম্ভাব্য এই চুক্তি অগ্রসরের ব্যাপারে খোলাখুলি কিছুই বলা হয়নি।
জন কিরবি বলেন, "আমরা ডেমোক্র্যাটিক পিপলস রিপাবলিক অফ কোরিয়ার প্রতি রাশিয়ার সাথে অস্ত্র আলোচনা বন্ধের আহ্বান জানাই। একইসাথে পিয়ংইয়ং রাশিয়ার কাছে অস্ত্র সরবরাহ বা বিক্রি না করার জন্য জনসাধারণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেটি মেনে চলারও আহ্বান জানাই।"
জন কিরবি জানান, মার্কিন ইন্টিলিজেন্স মতে, রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু গত জুলাইয়ে উত্তর কোরিয়া ভ্রমণের সময় দেশটির নেতা কিম জং উনের সাথে সাক্ষাত করেন। তখন পিয়ংইয়ংকে অস্ত্র বিক্রির জন্য প্রলুব্ধ করেছে মস্কো।
তবে মার্কিন প্রশাসন ঠিক কোন সূত্রে সম্ভাব্য চুক্তির তথ্যটি পেয়েছেন, সে ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। তবে শুধু উত্তর কোরিয়া নয়, বরং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকেও মস্কোর কাছে অস্ত্র বিক্রি না করতে সতর্ক করেছে ওয়াশিংটন।
এদিকে কিছুদিন আগে পুতিন ও কিম জং উন কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে একে অপরের সাথে চিঠি বিনিময় করেছেন। চিঠিতে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক জোরদারে দুই নেতাই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
তখন এক বিবৃতিতে পুতিন বলেন, "আমি নিশ্চিত যে, আমরা দুই দেশের জনগণের মঙ্গল কামনায় এবং কোরীয় উপদ্বীপ থেকে শুরু করে সমগ্র উত্তর-পূর্ব এশিয়ার দৃঢ় স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য সকল ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা জোরদার করব।"
অবশ্য গতবছর যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা একইভাবে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে রাশিয়াকে গোপনে আর্টিলারি শেল পাঠানোর অভিযোগ করেছে।
জন কিরবি বলেন, "উত্তর কোরিয়া ইউক্রেনে থাকা রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে সামরিক সহায়তা প্রদানের বিষয়ে বিবেচনা করছে। এক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যকার আলোচনা অগ্রসর হচ্ছে। সামনের মাসগুলোতে হয়তো এ সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।"
এ সম্পর্কে জানতে জাতিসংঘে অবস্থিত উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মিশনের সাথে যোগাযোগ করে রয়টার্স। তবে দুই দেশের মিশন এই বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি। যদিও মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের পক্ষ থেকে বরাবরই অস্ত্র কেনা-বেচার মার্কিন এই অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে অনেকটা প্রকাশ্যেই উত্তর কোরিয়া মস্কোকে সমর্থন করেছে। কিম জং উনের মতে, মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা 'আধিপত্যবাদী নীতির' ফলে রাশিয়া নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য হয়েছে।
এদিকে একের পর এক নিউক্লিয়ার ও ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রোগ্রাম পরিচালনার জন্য ইতিমধ্যেই উত্তর কোরিয়া জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞায় রয়েছে। অন্যদিকে গতবছর যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রয়েছে রাশিয়া।
এমতবস্থায় গত ১৫ আগস্ট মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে বলা হয়, "উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে যেকোনো ধরণের নিরাপত্তা সহযোগিতা বা অস্ত্র চুক্তি অবশ্যই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন লঙ্ঘন করবে।"
এদিকে ওয়াশিংটনের তীব্র বিরোধিতার মাঝেই উত্তর কোরিয়া আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের উৎক্ষেপণ অব্যাহত রেখেছে। গতকাল (বুধবার) উত্তর কোরিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশটি ঐ অঞ্চলে মার্কিন দূরপাল্লার বোমারু বিমান উড্ডয়নের কয়েক ঘণ্টা পরই দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে৷ এই ঘটনায় হোয়াইট হাউজ মুখপাত্র ক্যারাইন জিন-পিয়েরে গতকালের উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি বলে অভিহিত করে নিন্দা প্রকাশ করেছেন।
এদিকে চলতি সপ্তাহের শুরুতে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের সঙ্গে যৌথ নৌ মহড়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছে উত্তর কোরিয়া। একইসাথে কোরীয় উপদ্বীপে এই মহড়া 'পরমাণু যুদ্ধের বিপদ' বৃদ্ধি করছে বলেও সতর্কতা প্রকাশ করে দেশটি।
অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে জাতিসংঘের রেজুলেশন লঙ্ঘন এবং ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার মাধ্যমে কোরীয় উপদ্বীপকে অস্থিতিশীল করার অভিযোগ করছে। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি মাসে ওয়াশিংটনে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ত্রিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলনে বিষয়টি উঠে আসে। ঐ সামিটে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা সহযোগিতা আরও জোরদার করার অংশ হিসেবে নিজেদের মধ্যে ঐ অঞ্চলে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের তথ্য রিয়েল-টাইম শেয়ারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনান্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কিম জং উনের সাথে পারস্পরিক যোগাযোগ চালু করা হয়েছিল। তবে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যকার উচ্চ পর্যায়ের মিটিংয়ে যেন ভাটা পরেছে।
তবে গতকাল (বুধবার) জিন-পিয়েরে বলেন, "আমরা উত্তর কোরিয়ার সাথে কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছি। একইসাথে এখনো সময় থাকায় আমরা দেশটিকে সংলাপে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।"
২০১৮ সালে ট্রাম্প ও কিমের প্রথম সাক্ষাতের পর যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়া একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছিল। বিবৃতিতে উত্তর কোরিয়া 'কোরীয় উপদ্বীপের সম্পূর্ণ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ' বলেও অভিহিত করা হয়েছিল। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচী বন্ধ করার উত্তর কোরিয়ার সেই প্রতিশ্রুতি পরবর্তীতে আর বাস্তবে দেখা যায়নি।
২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়। তারপর থেকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে সর্বসম্মতিক্রমে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচির প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বহু প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে।
তবে গতবছর উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব করা হলে তাতে ভেটো দেয় চীন ও রাশিয়া। এক্ষেত্রে দেশ দুটির যুক্তি এই যে, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচি রোধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা কোনো কার্যকর ফলাফল বয়ে আনতে পারেনি।