রাশিয়া-কিম জং উন ঐক্যে কেন উদ্বিগ্ন মার্কিন শিবির?
উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন চলতি মাসে রাশিয়া সফরের পরিকল্পনা করছে। আর এতে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই বেশ অস্থিরতা বিরাজ করছে। খবর বিবিসির।
মার্কিন কর্তৃপক্ষের ধারণা, কিম জং উন ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকে অস্ত্র কেনা-বেচার বিষয়টি উঠে আসতে পারে। অর্থাৎ ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোকে সহযোগিতার জন্য অস্ত্র সরবারাহের জন্য রাজি হতে পারে পিয়ংইয়ং।
তবে শুধু মার্কিন শিবিরকে বিপাকে ফেলতেই নয়, বরং রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যকার এই সম্ভাব্য অস্ত্র চুক্তির দুই দেশ নিজেদের প্রয়োজনেই বেশ লাভবান হতে পারে।
কেননা বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার প্রচুর অস্ত্রের প্রয়োজন। বিশেষ করে যুদ্ধে ইউক্রেনকে ধরাশায়ী করতে আরও গোলাবারুদ ও আর্টিলারি শেল দরকার; যা পিয়ংইয়ংয়ের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে।
অন্যদিকে তীব্র নিষেধাজ্ঞায় থাকায় উত্তর কোরিয়ার স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য ও অর্থের প্রয়োজন। গত তিন বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বৈরি সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশটি যেন আরও বিছিন্ন হয়ে পড়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া উভয় দেশই নিষেধাজ্ঞায় থাকায় পিয়ংইয়ং ও মস্কোর একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সামরিক ক্ষেত্রেও সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা চলছে।
রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া অস্ত্র চুক্তি করতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছুদিন ধরেই আশঙ্কা প্রকাশ করে আসছিল। যদিও দেশ দুটির পক্ষ থেকে এখনো এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। এমতবস্থায় কিম ও পুতিনের মধ্যকার সাক্ষাতের খবর যেন সেই শঙ্কাকে অনেকটা বাস্তবে রুপ দিয়েছে।
এমতবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান পরিকল্পনা হচ্ছে, যেকোনো মূল্যে উত্তর কোরিয়ার অস্ত্রগুলোকে ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহৃত হতে না দেওয়া। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য এই পরিস্থিতি যেন আরও ভয়ানক।
কেননা রাশিয়াকে অস্ত্র সরবারাহের বদৌলতে উত্তর কোরিয়া ঠিক কী সুবিধা নিচ্ছে সেটি এখনো পরিস্কার নয়। তবে রাশিয়ার এই সংকটময় পরিস্থিতিতে কিম যে চড়া মূল্যের কোনো সুবিধাই লাভ করবেন, সেটা অনেকটা আন্দাজ করা যায়। ফলে পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়াও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত।
ধারণা করা হচ্ছে যে, রাশিয়া কাছ থেকে কিম সামরিক সহযোগিতার দাবি করতে পারে। গত সোমবার দক্ষিণ কোরিয়ার ইনটিলিজেন্স সার্ভিস জানায়, রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু উত্তর কোরিয়ার কাছে চীনকে সাথে নিয়ে একটি যৌথ নৌ-মহড়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। মূলত তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের পক্ষ থেকে যে নৌ-মহড়া করা হয়, তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবেই এমন প্রস্তাব।
তবে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার শিবিরের জন্য সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, পুতিনের কাছে কিম রাশিয়ার অস্ত্র সম্পর্কিত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কিংবা নলেজ শেয়ারিং এর দাবি করতে পারে। বিশেষ করে নজরদারি স্যাটেলাইট ও নিউক্লিয়ার আর্মড সাবমেরিনের মতো উল্লেখযোগ্য কৌশলগত অস্ত্র সম্পর্কে রাশিয়ার কাছে থেকে সহযোগিতা পেতে পারে উত্তর কোরিয়া।
তবে দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা মনে করেন, রাশিয়া হয়তো এমন প্রস্তাবে রাজি নাও হতে পারে। কেননা সেটি পরবর্তীতে খোদ মস্কোর জন্যই কৌশলগতভাবে বিপদজনক বলে গণ্য হবে।
তবে এশিয়ান ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো ইয়াং ইউকে মনে করেন যে, অস্ত্রের বিনিময়ে রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক প্রোগ্রামে সহায়তা করতে পারে।
ইয়াং ইউকে বলেন, "রাশিয়া যদি অস্ত্রের বিনিময়ে তেল কিংবা খাদ্যও সরবারাহ করে, তবে সেটি উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করবে। এতে করে পরবর্তীতে দেশটি নিজেদের অস্ত্র ভাণ্ডার আরও শক্তিশালী করতে পারবে। এটা দেশটির জন্য হবে অতিরিক্ত আয় যেটা বর্তমানে তাদের নেই।"
মিলিটারি স্ট্র্যাটেজি ও সামরিক অস্ত্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইয়াং ইউকে আরও বলেন, "গত ১৫ বছর ধরে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে নিষেধাজ্ঞার একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছে। যাতে করে দেশটি নিজেদের বিধ্বংসীকারী অস্ত্রের উন্নতি ও কেনা-বেচা না করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে রাশিয়া, যারা কি-না জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য, পুরো নেওওয়ার্কটিকেই ধ্বংস করে দিতে পারে।"
এদিকে উত্তর কোরিয়ার ওপর যতই নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে; দেশটি সেইসব নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পরাশক্তি চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়েছে। এমনকি নানা সময়ে বেইজিং থেকে খাদ্য সহায়তাও পেয়েছে পিয়ংইয়ং।
এছাড়াও গত কয়েক বছরে পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিশোধে প্রস্তাব তোলা হলেও তাতে সায় দেয়নি চীন। যার ফলে বড় কোনো ধরণের বাধা ছাড়াই দেশটি নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্র শক্তি আরও উন্নত করতে পেরেছে।
এক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়াকে চীনের সহযোগিতার পেছনেও কারণ রয়েছে। কেননা পিয়ংইয়ং চীনের জন্য মার্কিন সৈন্য থাকা দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যকার একটি বাফার জোন হিসেবে কাজ করে। তাই উত্তর কোরিয়াকে চীন নিজেদের স্বার্থেই সহায়তা করে।
তবে একক দেশ হিসেবে চীনের প্রতিই একচেটিয়া ঝুঁকে থাকেনি উত্তর কোরিয়া। বরং রাশিয়া যখন যুদ্ধ চলাকালীন নিজেদের মিত্র খুঁজতে মরিয়া তখন সেই সুযোগটি লুফে নিয়েছে কিম। কেননা এতে করে অনেকটা একঘরে হয়ে থাকা উত্তর কোরিয়ার সহযোগিতার নেটওয়ার্ক বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
বরং সমসাময়িক পরিস্থিতিতে রাশিয়া যখন অস্ত্র চুক্তিতে খুব বেশি আগ্রহী; তখন কিম চীন অপেক্ষা রাশিয়া থেকে বেশি সুবিধা নিতে পারবে। এমনকি উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ইস্যুতেও চুপ থাকতে পারে পুতিন।
তবে শেষ পর্যন্ত পুতিন ও কিমের সাক্ষাত হবে কি-না; সেই সম্পর্কে এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কেননা কিম উত্তর কোরিয়ার বাইরে খুব কম ভ্রমণ করেন। মূলত তিনি তার নিরাপত্তা নিয়ে সবসময়েই অতিরিক্ত সতর্ক থাকেন এবং বিদেশ ভ্রমণকে বেশ বিপদজনক বলে মনে করেন।
কিম সর্বশেষ দেশের বাইরে সফরে গিয়েছিল ২০১৯ সালে; তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে সাক্ষাত করতে। ঐ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কিম হ্যানয় উপদ্বীপে ট্রাম্পের সাথে বৈঠক করেন। আর এপ্রিল মাসে পুতিনের সাথে ভ্লাদিভোস্টকে দেখা করেন। এক্ষেত্রে তিনি বিমানে নয় বরং একটি সাঁজোয়া ট্রেনে করে যাতায়াত করেছিলেন এবং চীন হয়ে দীর্ঘ ২ দিন যাত্রা করে হ্যানয় পৌঁছেছিলেন।
এটা এখনো পরিস্কার নয় যে, কিম ও পুতিন আসলেই বৈঠকটি কতটা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। তবে এটাও হতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে যে, বৈঠকটির খবর প্রকাশ করার মাধ্যমে হয়তো কিম কিছুটা শঙ্কা বোধ করবেন। এতে করে দুই নেতার বৈঠক ও সম্ভাব্য অস্ত্র চুক্তি উভয়ই ব্যর্থ হতে যেতে পারে।
তবে বার্নাড লু মনে করেন যে, কিম বৈঠক ও অস্ত্র সংক্রান্তও চুক্তির সিদ্ধান্তে অনড়ই থাকবেন। আর যেখানে নৌ-মহড়ার বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে, তখন উভয়েরই স্বার্থ উদ্ধার না করে এই ধরণের পদক্ষেপগুলি বাতিল করা কঠিন হবে।