১৫ বছরের মধ্যে ঘরের মাঠে কিউইদের বিপক্ষে প্রথম হার বাংলাদেশের
ইশ… বাংলাদেশের যদি একজন ইশ সোদি থাকতো! অন্যভাবে বললে, বাংলাদেশের যদি একজন লেগ স্পিনার থাকতো- বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমন দীর্ঘশ্বাস বহুদিনের। এই দীর্ঘশ্বাস ফুরানোর আশা নেই বললেই চলে, উল্টো প্রতিপক্ষের লেগ স্পিনারকে ঘিরে আছে রাশি রাশি হতাশা। লেগ স্পিনারের নাম শুনলেই বাংলাদেশ শিবিরে ভর করে ভীতি, সেই ভয় বাস্তবে রূপ নেয় ম্যাচে। আরও একবার পুরনো সেই গল্পই লেখা হলো। ক্যারিয়ার সেরা বোলিং করা সোধির লেগ স্পিনে কুপোকাত বাংলাদেশ ম্যাচ হারলো অসহায় আত্মসমর্পণ করে।
অবশ্য আট নম্বরে নেমে ব্যাট হাতে নিউজিল্যান্ডকে অনেকটা পথ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সোধিকে পুরো কৃতিত্ব দিলে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের ছবি অস্পষ্ট থেকে যায়। এশিয়া কাপে দুটি ম্যাচ জিতলেও সাকিব আল হাসানের দল বন্দী ছিল ব্যাটিং ব্যর্থতার বৃত্তে। শনিবার মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপের বাংলাদেশকেই দেখা গেল। স্পিনে কাবু বাংলাদেশ চরম ব্যাটিং ব্যর্থতায় দ্বিতীয় ওয়ানডেতে হার মানলো ৮৬ রানের বড় ব্যবধানে। ঘরের মাঠে ১৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে হারলো বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০০৮ সালে অক্টোবরে কিউইদের বিপক্ষে হেরেছিল তারা।
কিউইদের বিপক্ষে এই সিরিজটি বাংলাদেশের কাছে পরীক্ষা-নিরীক্ষার। প্রথম দুই ওয়ানডের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে বিশ্বকাপ দলের কয়েক জায়গা ঠিক করে নেওয়ার পরিকল্পনা বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্টের। নিয়মিত অধিনায়ক সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিমসহ ছয়জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে বিশ্রাম দিয়ে গড়া হয় এই সিরিজের দল। প্রথম ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ায় পুরোপুরিভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়নি। দ্বিতীয় ম্যাচে করা গেলেও ফলটা মনমতো হলো না।
টস জিতে ব্যাটিং করতে নামা নিউজিল্যান্ড শুরুতে বিপাকে পড়লেও হেনরি নিকোলস ও টম ব্লান্ডেলের জুটিতে ঠিক পথ খুঁজে পায়। সেখান থেকে লড়াই চালিয়ে কিউইদের আরও অনেকটা পথ এগিয়ে দেন টেইলএন্ডাররা। অনেকটা ব্যাটসম্যানের মতো করে ভূমিকা পালন করেন কোল ম্যাকনকি, কাইল জেমিসন, ম্যাচসেরা ইশ সোদিরা। এরপরও ৪৯.২ ওভারে অলআউট হয়ে যায় কিউরা, স্কোরকার্ডে জমা হয় ২৫৪ রান। জবাবে সোদির স্পিন তোপের সামনে কেবল তামিম ইকবাল ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ লড়াই করতে পারলেন। বাকিরা ভাঙনের সুরে পথ ভুলে মুহূর্তেই সাজঘরে ফেরেন। ৪১.১ ওভারে ১৬৮ রানে অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ।
জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নামা বাংলাদেশের শুরুটা বরাবরের মতোই ভালো হয়নি। দলীয় ১৯ রানে ফিরে যান লিটন কুমার দাস, তাকে ফেরান কিউই পেসার কাইল জেমিসন। এরপর তানজিদ হাসান তামিমের সঙ্গে ৪১ রানের জুটি গড়েন গত জুলাইয়ের পর কোনো ম্যাচ খেলতে নামা তামিম ইকবাল। জুটিতে তামিমের অবদানই বেশি। তবে তানজিদকেও সাবলীল দেখাচ্ছিল।
যদিও ইনিংস লম্বা করতে পারেননি তানজিদ, সোদিকে বাউন্ডারি মারতে গিয়ে মিড অফে লকি ফার্গুসনের হাতে ধরা পড়েন ১২ বলে ৩টি চারে ১৬ রান করা তরুণ এই ব্যাটসম্যান। তানজিদকে ফিরিয়ে উইকেট উদযাপন শুরু করা সোদি এরপর রীতিমতো যমদূত হয়ে ওঠেন। একের পর এক উইকেট তুলে নিতে থাকেন তিনি। বিশ্বকাপ দলে থাকার পরীক্ষা দিতে নামা সৌম্য সরকার উইকেটে টিকতেই পারেননি, দ্বিতীয় বলেই বোলার সোদিকে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফিরে যান তিনি। তাওহিদ হৃদয়ও হতাশ করেন, তিনিও সোদির শিকার।
চোট কাটিয়ে ফেরা তামিম আরও কিছুটা পথ পাড়ি দেন, মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে গড়েন ২২ রানের জুটি। সেদির চতুর্থ শিকবারে পরিণত হওয়ার আগে ৫৮ বলে ৭টি চারে ৪৪ রান করেন অভিজ্ঞ এই ওপেনার। ৯২ রানে ৫ উইকেট হারানো দলকে ঠিক পথে ফেরানোর চেষ্টা করেন মাহমুদউল্লাহ ও শেখ মেহেদি হাসান। ৬৩ বলে ৪২ রান যোগ করেন এ দুজন। সোদির বলে বোল্ড হওয়ার আগে ২৯ বলে ১৭ রান করেন শেখ মেহেদি।
তার বিদায়ের পর নাসুমকে নিয়ে এগোচ্ছিলেন সৌম্যর মতো বিশ্বকাপে দলে জায়গা করে নেওয়ার পরীক্ষা দিতে নামা মাহমুদউল্লাহ। কিন্তু এ জুটি দীর্ঘ হয়নি, লেগ স্টাম্পের অনেক বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে আউট হন ৭৬ বলে ৪টি চার ও একটি ছক্কার বাংলাদেশের ইনিংস সেরা ৪৯ রান করা অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার। এরপর নাসুমের ব্যাটে বাংলাদেশের হারের ব্যবধান কমেছে মাত্র, ৩০ বলে একটি চার ও ২টি ছক্কায় ২১ রান করেন তিনি।
বাংলাদেশকে পথ ভুলিয়ে দেওয়া কিউই লেগ স্পিনার ১০ ওভারে এক মেডেনসহ ৩৯ রান খরচায় ৬টি উইকেট নেন। ওয়ানডেতে এটাই তার ক্যারিয়ার সেরা বোলিং, যা ওয়ানডেতে যৌথভাবে নিউজিল্যান্ডের তৃতীয় সেরা বোলিং। জেমিসন ৭ ওভারে ৩২ রানে ২টি উইকেট পান। একটি করে উইকেট নেন লকি ফার্গুসন ও কোল ম্যাকনকি।
এর আগে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেওয়া নিউজিল্যান্ড ভালো শুরু করতে পারেনি। পরিত্যক্ত হওয়া প্রথম ওয়ানডের মতো এই ম্যাচেও ব্যাটিংয়ের শুরুতে মুস্তাফিজের তোপের মুখে পড়তে হয় কিউইদের। ইনিংসের তৃতীয় ওভারেই উইল ইয়াংকে ফিরিয়ে দেন বাংলাদেশের বাঁহাতি এই পেসার। উইকেটের পেচনে ক্যাচ দেওয়া কিউই এই ওপেনার ৮ বল খেললেও রানের খাতা খুলতে পারেননি।
ইনিংসের সপ্তম ওভারে আরেক ওপেনার ফিন অ্যালেনকেও সাজঘর দেখিয়ে দেন মুস্তাফিজ। ১৫ বলে ২টি চারে ১২ রান করে সৌম্য সরকারের হাতে ধরা পড়েন ফিন। ২৬ রানে ২ উইকেট হারানো কিউইদের বিপদ বাড়ান অভিষিক্ত খালেদ। পায়ের ওপর করা তার একটি ডেলিভারিটি চিপ করতে গিয়ে তাওহিদ হৃদয়ের হাতে ক্যাচ দেন ১৯ বলে ১৪ রান করা চ্যাড বোয়েজ।
৩৬ রানে ৩ উইকেট খোয়ানো দলের হাল ধরেন নিকোলস ও ব্লান্ডেল। চতুর্থ উইকেটে ১১১ বলে ৯৫ রানের জুটি গড়েন তারা। ৬১ বলে ৬টি চারে ৪৯ রান করা নিকোলসকে ফিরিয়ে এই জুটি ভাঙেন খালেদ। রাচিন রবীন্দ্রকে নিয়ে ২৬ রানের জুটি গড়েন ব্লান্ডেল। রাচিন ১০ রান করে আউট হওয়ার পর হাসানের শিকারে পরিণত হন তিনি। ডানহাতি এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান ৬৬ বলে ৬টি চার ও একটি ছক্কায় ৬৮ রানের মহাকার্যকর এক ইনিংস খেলেন।
এরপর শেষের ব্যাটসম্যানদের ব্যাটে আসল লড়াই করে নিউজিল্যান্ড। ১৮৭ রানে ৭ উইকেট হারানো কিউইরা শেষ ৩ উইকেটে ৬৭ রান যোগ করে। ডানহাতি অলরাউন্ডার ম্যাকনকি ৩৩ বলে ২০, পেসার জেমিসন ২৮ বলে ২০ ও অধিনায়ক লকি ফার্গুসন ১৩ বলে অপরাজিত ১৩ রান করেন। তবে এদের সবচেয়ে উজ্জ্বল লেগ স্পিনার ইশ সোধি। 'মানকাড' করে আউট করলেও লিটন কুমার দাস তাকে ফিরিয়ে আনেন।
১৭ রানে জীবন ফিরে পেয়ে আরও ১৮ রান করেন সোধি। ৩৯ বলে ৩টি ছক্কায় ৩৫ রান করেন তিনি। এই সিরিজে বাংলাদেশের বোলিং কাণ্ডারী হয়ে ওঠা মুস্তাফিজ ১০ ওভারে ৫২ রানে ২টি উইকেট নেন। অভিষিক্ত খালেদ ৯.২ ওভারে ৬০ রান খরচায় ৩টি উইকেট পান। ১০ ওভারে ৪৫ রানে স্পিনার শেখ মেহেদি হাসানের শিকারও ৩ উইকেট। নাসুম আহমেদ ও হাসান মাহমুদ একটি করে উইকেট পান।