রাশিয়ার স্টর্ম-জেড ইউনিট কারা? তাদের মোতায়েনের উদ্দেশ্য কী?
সামরিক ও বেসামরিক অপরাধীদের জন্য আলাদা করে একটি শাস্তিমূলক সেনা ইউনিট তৈরি করেছে রাশিয়া। এ পেনাল ইউনিটটির নাম 'স্টর্ম-জেড'। ইউক্রেনযুদ্ধে এ ইউনিটকে ফ্রন্টলাইনে পাঠানো হয়েছে। এসব তথ্য জানিয়েছেন এ ইউনিট সম্পর্কে জানা ১৩ জন ব্যক্তি। তাদের মধ্যে পাঁচজন এ ধরনের ইউনিটের যোদ্ধা।
তারা জানান, স্টর্ম-জেড-এর অল্প সেনাই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেঁচে ফিরে আসেন। রুশ সেনাবাহিনীর ৪০৩১৮ নাম্বার ইউনিটের একজন নিয়মিত সৈনিকের ভাষ্যে, 'স্টর্ম ফাইটার, ওরা তো স্রেফ মাংসপিণ্ড।'
ওই সৈনিক জানান, কমান্ডারের আদেশ অমান্য করে তিনি স্টর্ম-জেড-এর ছয়–সাতজন আহত সেনাকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ওই কমান্ডার আহত স্টর্ম ফাইটারদের কেন সাহায্য দিতে নিষেধ করছেন তা তিনি জানেন না। কিন্তু এ ইউনিটের সেনাদেরকে সচরাচর নিয়মিত বাহিনীর চেয়ে কম মূল্যবান হিসেবে মনে করেন অফিসারেরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সৈন্য আরও বলেন, 'কোনো কমান্ডার যদি কারও মুখে মদের গন্ধ পান, তাহলে তাদরকে তাৎক্ষণিকভাবে স্টর্ম স্কোয়াডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।'
রয়টার্স রুশ বাহিনীর ৪০৩১৮ নাম্বার ইউনিটের একজন অফিসারের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য অনুরোধ করার পর তিনি ফোন কেটে দিয়েছেন। ক্রেমলিন এ বিষয়ে রয়টার্সকে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে বললেও মন্তব্যের অনুরোধে কোনো সাড়া মেলেনি।
রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমের খবরে স্টর্ম-জেড-এর অস্তিত্বের কথা স্বীকার করা হয়েছে। এসব খবরে বলা হয়েছে, এ ইউনিটের সদস্যরা ভয়ংকর সব যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন, অনেকে সাহসিকতার জন্য পদকও পেয়েছেন। তবে এ ইউনিটগুলো কীভাবে তৈরি করা হয়েছে বা যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের ক্ষয়ক্ষতি কেমন তা প্রকাশ করেনি এসব গণমাধ্যম।
প্রথম কোনো গণমাধ্যম হিসেবে রয়টার্স এ স্কোয়াডগুলো কীভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ও রণক্ষেত্রে মোতায়েন করা হয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে।
রাশিয়ার এ ধরনের প্রতিটি পেনাল ইউনিটে সদস্য সংখ্যা ১০০ থেকে দেড়শ জন। তাদেরকে নিয়মিত ইউনিটের সঙ্গেই যুদ্ধে পাঠানো হয়।
এসব ইউনিটের সেনাদের রণাঙ্গনের সবচেয়ে ভয়ংকর স্থানগুলোতে মোতায়েন করে কর্তৃপক্ষ। আর যুদ্ধে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন এ যোদ্ধারা।
রয়টার্স-এর সঙ্গে কথা বলা পাঁচ জন স্টর্ম-জেড যোদ্ধার মধ্যে তিনজন এবং আরও তিন স্টর্ম-জেড যোদ্ধার আত্মীয়রা রক্তক্ষয়ী বিভিন্ন যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন যেখানে ইউনিটগুলো বেশিরভাগ সেনা নিহত হয়েছেন।
চুরির অপরাধে কারাভোগের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত এক যোদ্ধা বলেন, তার ইউনিটটি ২৩৭ নিয়মিত রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত ছিল। গত জুনে বাখমুতের কাছে লড়াইয়ে ইউনিটটির ১২০ জনের মধ্যে ১৫ জন বাদে বাকি সবাই হতাহত হয়েছিলেন।
স্টর্ম-জেড ইউনিটগুলো রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নির্দেশনায় কাজ করে। যেসব অপরাধী ক্ষমা পাওয়ার বদলে এ যুদ্ধে যোগ দিয়েছে তাদের স্থান হয় এসব ইউনিটে। আবার নিয়মিত সেনাদের যারা শৃঙ্খলাভঙ্গ করেন, তাদেরকেও এসব ইউনিটে পাঠায় কর্তৃপক্ষ।
এসব ইউনিটের সেনাদের খরচের খাতায় রাখে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। অর্থাৎ এ সেনাদের রণক্ষেত্রে প্রাণহানি নিয়ে মাথা ঘামায় না এটি। এমন তথ্য জানিয়েছে চলমান যুদ্ধে নজর রাখা একটি স্বাধীন সংগঠন কনফ্লিক্ট ইন্টেলিজেন্স টিম।
রাশিয়ান প্রতিলক্ষা মন্ত্রণালয় কখনোই স্টর্ম-জেড ইউনিট গঠনের কথা স্বীকার করেনি। এসব ইউনিটে মোট কতজন সেনা নিযুক্ত আছেন, তা নিশ্চিতভাবে জানতে পারেনি রয়টার্স। তবে সাক্ষাৎকার দেওয়া ব্যক্তিরা বলছেন বর্তমানে কয়েকশ স্টর্ম-জেড যোদ্ধা ফ্রন্টলাইনে মোতায়েন আছেন।
সামরিক ও বেসামরকি অপরাধীদের জোর করে যুদ্ধরত ইউনিটে পাঠানোর নজির রুশ ইতিহাসে রয়েছে। ১৯৪২ সালে নাৎসিবাহিনীর অগ্রগতির মুখে রেড আর্মি পিছু হটার সময় সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন যুদ্ধক্ষেত্রে ভয় পাওয়া বা অবস্থান ছেড়ে যাওয়া সেনাদের শাস্তি হিসেবে 'পানিশমেন্ট ব্যাটালিয়ন'-এ রণাঙ্গনের সবচেয়ে ভয়ংকর স্থানে মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ইউক্রেন সরকারও জানিয়েছে, যুদ্ধ করতে যেতে রাজি হওয়া কিছু অপরাধীকে এটি মুক্তি দিয়েছে।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বন্দিদের যুদ্ধে যাওয়ার বিনিময়ে তাদের অপরাধের ইতিহাস মুছে ফেলা এবং নিয়মিত বেতন দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। স্টর্ম-জেড-এর তিন যোদ্ধা জানিয়েছেন, তাদেরকে মাসে দুই লাখ রুবল (২ হাজার ডলার) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যদিও তারা গড়ে কেবল অর্ধেকের মতো বেতন পেয়েছেন।
সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের দিয়েই রাশিয়ার এ স্টর্ম-জেড স্কোয়াডগুলো মূলত গঠিত হলেও নিয়মিত সৈন্যদেরও এগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সৈন্যরা নিয়মভঙ্গ করলে তাদের শাস্তি হিসেবে এসব স্কোয়াডে যোগদান করতে হয় বলে ভুক্তভোগী একটি নিয়মিত ইউনিটের দুই সৈন্য জানান।
সৈন্যদের শৃঙ্খলাভঙ্গের মধ্যে রয়েছে মদ্যপ হওয়া, মাদক গ্রহণ করা, ও আদেশ পালন না করা। তবে সামরিক শৃঙ্খলা বিষয়ক রুশ আইনে বলা হয়েছে, কোনো সৈন্যকে কেবল সামরিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে শাস্তিমূলক ইউনিটে পাঠানো যাবে। কিন্তু যেসব সৈনিককে স্টর্ম-জেড-এ পাঠানো হয়েছে, তাদের কাউকেই সামরিক আদালতে তোলা হয়নি।
উল্লেখ্য যুদ্ধসংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির জেনেভা কনভেনশনে নিজ পক্ষ কর্তৃক সৈনিকের শাস্তি বিষয়ে কোনো কিছু বলা নেই।
কর্তৃপক্ষের রুঢ় ব্যবহার ও কর্মকাণ্ড সহ্য করতে না পেরে ২২১৭৯ নাম্বার ইউনিটের প্রায় ২০ জনের মতো স্টর্ম-জেড যোদ্ধা ফ্রন্টলাইনে যাওয়ার আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর তারা ২৮ জুন একটি ভিডিও প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষের আচরণ বিষয়ে অভিযোগ জানান।
ওই ভিডিওতে একজন যোদ্ধা অভিযোগ করেন, ফ্রন্টলাইনে তারা পর্যাপ্ত গোলাবারুদ পান না। পাশাপাশি তারা খাবার ও পানিসংকটেও ভুগছেন।
'আমাদেরকে এমন সব বিপজ্জনক আদেশ দেওয়া হয় যেগুলো মেনেও কোনো লাভ নেই। আমরা কমব্যাট মিশনে যাওয়া প্রত্যাখ্যান করছি,' ওই সৈনিক আরও বলেন।
ওই ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর রাশিয়ার মিলিটারি পুলিশ ভিডিওতে থাকা কয়েকজন যোদ্ধাকে তাদের বিদ্রোহের শাস্তি হিসেবে মারধর করে। তবে ওই ভিডিওর দুই সৈনিক জানিয়েছেন, ওই ঘটনার পর থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। তবে তাদেরকে কখন সামরিক বাহিনী ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হবে তা তারা জানেন না।