ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ ইউক্রেন নিয়ে চাপে থাকা মার্কিন প্রতিরক্ষা খাতের জন্য নতুন পরীক্ষা
মার্কিন অস্ত্র নির্মাতারা বর্তমানে ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহের গতি বাড়াতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করতে গিয়ে মার্কিন অস্ত্রশিল্প এ মুহূর্তে বেশ চাপে রয়েছে। তাই ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহের নতুন এ চ্যালেঞ্জ মার্কিন কারখানাগুলোর ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করবে বলেই মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কয়েকশ ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান পেয়েছে। তবে ইসরায়েল মূলত গোলাবারুদ চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। বিশেষ করে আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ইন্টারসেপ্টর মিসাইল ইসরায়েলের চাহিদার শীর্ষে রয়েছে।
এছাড়া আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য নিখুঁত লক্ষ্যভেদী অস্ত্র এবং ১২০ মিলিমিটার ক্যালিবারের ট্যাংকের গোলাও দরকার বলে জানিয়েছে ইসরায়েল।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েল ও ইউক্রেনকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের অস্ত্র সরবরাহের শপথ করেছেন। একইসঙ্গে সম্ভাব্য অন্য কোনো রণাঙ্গনে (যেমন তাইওয়ান) নতুন করে যুদ্ধ লাগলে তার জন্যও যুক্তরাষ্ট্রের পর্যাপ্ত অস্ত্র রয়েছে বলে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেন তিনি।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ইউক্রেনযুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাশিল্পের টনক নড়িয়ে দিয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা খাত এতদিন চিরায়ত স্থলযুদ্ধের প্রয়োজনীয় অস্ত্রের ওপর গুরুত্ব কমিয়ে প্রযুক্তিগত অগ্রসরতার দিকে বেশি নজর দিয়েছিল।
ইসরায়েলের নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প ও অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে। এছাড়া এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বছরে প্রায় চার বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সামরিক সহায়তা পেয়ে থাকে। এ প্যাকেজের ৫০০ মিলিয়ন ডলার আকাশ ও মিসাইল প্রতিরক্ষা সহায়তা।
ইসরায়েল মার্কিন অস্ত্রের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। গত সাত দশকে এটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রায় ৫৩.৫ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যের অস্ত্র কিনেছে।
ইসরায়েলের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এখন আরও অস্ত্র পাঠাচ্ছে। একজন মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র 'দ্রুতগতিতে' ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে গোলাবারুদ ও সরঞ্জামসহ বাড়তি রসদ পাঠাচ্ছে। বাড়তি এ সহায়তার দুটি শিপমেন্টের মধ্যে প্রথমটি গত সপ্তাহে ইসরায়েলে পৌঁছেছে। এ সহায়তা প্যাকেজে রয়েছে স্মল ডায়ামিটার বম্বসহ অন্যান্য গোলাবারুদ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও জানিয়েছে, এটি ইসরায়েলের আয়রন ডোম আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় ইন্টারসেপ্টর মিসাইলের সরবরাহও বাড়িয়ে তুলবে।
মার্কিন ওই প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের মজুত থাকা কিছু আয়রন-ডোম মিসাইল অল্প সময়ের মধ্যে ইসরায়েলে পাঠানো হয়েছে। আমরা আরও মিসাইল পাঠাব।'
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েল ও ইউক্রেনে সহায়তার জন্য মার্কিন কংগ্রেসের কাছে বাড়তি সহায়তা অনুরোধ করবেন বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
ইসরায়েলের আয়রন ডোমের ইন্টারসেপ্টর মিসাইলগুলো তামির নামে পরিচিত। মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদার কোম্পানি আরটিএক্স (সাবেক রেথিয়ন টেকনোলজিস) এবং ইসরায়েলি গ্রুপ রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমস যৌথভাবে এ মিসাইলগুলো উৎপাদন করে।
ইসরায়েলের চাহিদায় থাকা অন্য অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে জয়েন্ট ডিরেক্ট অ্যাটাক মিউনিশনস (জেড্যাম), হেলফায়ার মিসাইল ও স্মল ডায়ামিটার বম্ব (এসডিবি)-এর মতো আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য বিভিন্ন অস্ত্র।
যুক্তরাষ্ট্র এ অস্ত্রগুলো উৎপাদনে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে, তাই এগুলো ইসরায়েলকে সরবরাহ করা দেশটির জন্য তুলনামূলক সহজ হবে। আর চাহিদায় এ উল্লম্ফন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখা দেবে।
লকহিড মার্টিন হেলফায়ার মিসাইল তৈরি করে। আর জেড্যাম ও এসডিবি'র উৎপাদনকারী বোয়িং। বিশ্লেষকেরা বলছেন, জেড্যাম-এর উৎপাদন বাড়াতে বেশি বেগ পেতে হবে না মার্কিনীদের। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন সরকার নিজেদের জন্য হেলফায়ার মিসাইল ক্রয় কমিয়ে দিয়েছে, তাই নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এর মজুত বেশি।
এগুলোর পাশাপাশি জেনারেল ডায়নামিক্স-এর তৈরি ১২০ মিলিমিটার ট্যাংকের গোলাও দরকার হবে ইসরায়েলের।
গত ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে আচমকা আক্রমণের পর থেকে পেন্টাগনের বড় চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লকহিড, আরটিএক্স, নরথ্রপ গ্রুম্যান ও জেনারেল ডায়নামিক্স-এর শেয়ার দ্রুত বেড়ে গিয়েছে। তবে এ তিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি আরেক বড় কোম্পানি বোয়িংয়ের শেয়ার।
যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি নির্ভর করছে যুদ্ধের আকার এবং ইসরায়েলের স্থলাভিযান হিজবুল্লাহর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলবে কি না, তার ওপর।
হিজবুল্লাহর সঙ্গে দ্বিতীয় রণাঙ্গনে লড়াই শুরু হলে ইসরায়েলের অস্ত্র চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে। তখন মার্কিন সরবরাহের জন্য ইউক্রেনের সঙ্গে সরাসরি দেশটির প্রতিযোগিতা তৈরি হবে।
এমনকি যদি সাম্প্রতিক মার্কিন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা হিজবুল্লাহর লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে সফল হয়, তাহলেও ইসরায়েলের মৌলিক অস্ত্রের চাহিদা নির্ভর করবে এটি গাজায় কী ধরনের যুদ্ধ পরিচালনা করে তার ওপর।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী যদি দূর থেকে হামাসের ওপর আক্রমণ চালানো বজায় রাখে এবং গাজার ঘরে ঘরে গিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়, তাহলে এটির অত বেশি গোলাবারুদের দরকার হবে না। কিন্তু গাজার মতো জনবহুল এলাকায় পুরোদমে অপারেশন পরিচালনা সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার, যা মার্কিন সরবরাহের জন্য ইসরায়েলেে চাহিদাকে দ্রুত বাড়িয়ে তুলবে।