একটি দুর্ঘটনা, আর এক ভাইকে খুঁজে পেতে আরেক ভাইয়ের লড়াই!
কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনে সোমবার সংঘটিত দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যায় আহসান শেখ নামের একজন যাত্রী। ট্রেনটির পেছন থেকে তিনটি বগি দুর্ঘটনায় পড়ে। কিন্তু আহসান সৌভাগ্যবশত চার নাম্বার বগিতে থাকায় তার বগিটি থাকে অক্ষত। তার পরিবারও সাথে ছিল তবে তাদের সহ ঐ বগির সবাই সুস্থ ছিল।
বগির কোন ক্ষতি না হলেও সেখানকার যাত্রীরা সবাই আতংকিত হয়ে পড়ে। তাই আহসান তার পরিবারকে নিয়ে বাইরে চলে আসে।
এরপর পাশেই দাঁড়িয়ে তারা দুর্ঘটনায় কবলিত হতাহতদের উদ্ধার কার্যক্রম দেখছিল। হঠাত আহসানের পরিচিত একজন (তিনিও ওই ট্রেনের যাত্রী ছিল ও সামান্য আঘাতপ্রাপ্ত ছিল) তাকে ডাক দিয়ে জানতে চায় সে তার ভাইকে পেয়েছে কিনা।
আহসান জানত না তার আপন ভাইও একই ট্রেনে ঢাকা আসছিল। তাই সে কিছু না বুঝতে পেরে লোকটিকে বলে, 'আমি পরিবার নিয়ে আজ ঢাকা যাচ্ছিলাম। তুমি কোন ভাইয়ের কথা বলছ?'
লোকটি তখন আহসানকে জানায় যে, তার আপন বড়ভাইও এই ট্রেনে করে আজ ঢাকা যাচ্ছিল। দুর্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া দ্বিতীয় বগিতে সে ছিল। তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।
শুনেই আহসান চিৎকার দিয়ে ওঠে। মানুষ ঠেলে সে দুর্ঘনায় কবলিত বগির দিকে দৌড় দেয়। উচ্চস্বরে ভাইয়ের নাম ধরে ডাকতে থাকে। কিন্ত কোন সাড়া পাচ্ছিল না।
ততক্ষণে ওই স্থানে চলে আসে বর্ডার গার্ডের সদস্যরা, তারা আহসানকে দুর্ঘটনাস্থল থেকে সরাতে উদ্দ্যত হয়। কিন্তু আহসানের পাগলের মত কান্না তাদেরকেও নাড়া দেয়। বর্ডার গার্ডের সদস্যরা আহসানকে তার ভাইয়ের নাম্বারে কল দিতে বলে যাতে ফোনের শব্দে তাকে 'লোকেট' করা যায়।
আহসান কল দেয়। ফোনে রিং হলেও কোন শব্দ পাচ্ছিল না কেউ। প্রায় ৩০ মিনিট টানা কল দেয়ার পর কেউ একজন সেই ফোনটি ধরে।
"এই আধা ঘণ্টা সময় আমার জন্য অনেক কঠিন ছিল। মনের মধ্যে ঝড় চলছিল। একটা অনিশ্চয়তপূর্ণ সময়। লোকটি কল ধরেই জানতে চাইলো আমি কে। আমি তাকে বললাম, আপনি যার ফোন ধরেছেন আমি তার ছোট ভাই। তাকে খুঁজছি। লোকটি আমাকে জানায় আমার ভাইকে তারা ভৈরব হাসপাতাল নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে যেতে বলল। আমি বললাম, 'বাবা, আপনি যে হন- আপনি আমার বাবা। আমার ভাইকে আপনি ভালভাবে হাসপাতাল নিয়ে যান আমিও আসছি।"
ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন দুর্ঘটনায় আহত তার ভাইয়ের পাশে বসেই এই প্রতিবেদককে কথাগুলো জানায় আহসান।
আহসান বলতে থাকেন, 'এরপর আমি আমার পরিবারকে একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে দ্রুত রিক্সা নিয়ে হাসপাতাল যাই। গিয়ে দেখি ভাই বেহুঁশ, ফ্লোরে পড়ে আছে। ডাক্তাররা তাকে একের পর এক ব্যান্ডেজ করছে। আমার যাওয়ার পর ডাক্তার জানায় তার অনেক রক্ত গেছে, রক্ত দেওয়া লাগবে। আমি এদিক সেদিক মাতালের মত দৌড়াতে লাগলাম, একে ওকে ফোন দিতে থাকলাম। সবাই রক্তের গ্রুপ জানতে চায়। আবার ডাক্তারের কাছে গেলাম। তারা ব্লাড টেস্ট করে আমাকে গ্রুপ জানায়। আমি রক্তের জন্য আবার যখন ছুটাছুটি করছিলাম, তখন এক ভাই স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে এগিয়ে আসে ও আমাকে রক্তের ব্যবস্থা করে দেয়।'
'পকেটেও তখন টাকা ছিল ২০০০, তার মধ্যে রক্ত নিতে ১৩০০ টাকা খরচ হয়ে যায়', তিনি যোগ করেন।
আহসান জানান, 'রক্ত দেয়ার পর ডাক্তার জানায় তাকে বাঁচাতে হলে উন্নত কোন হাসপাতালে নিতে হবে। পরে তাকে ঢাকায় আনার সিদ্ধান্ত নেই ও একটি অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করি। অনেক রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসি। আসার পরপরই এখানকার ডাক্তাররা চিকিৎসা দেন। এখন ভাই অনেক ভাল আছেন', বলছিলেন আহসান।
যে বড় ভাইকে নিয়ে এতক্ষণ কথা হচ্ছিল তিনি আবুল কাসেম (৫৫)। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা থেকে তিনি বেঁচে ফিরলেও, এখনও তিনি পুরোপুরি শংকামুক্ত নন বলে জানান একজন ডিউটি ডাক্তার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিকিৎসক বলেন, 'তিনি এখন অনেক ভাল আছেন। তবে তার ইন্টারনাল কী পরিমাণ হ্যামারেজ হয়েছে সেটা জানতে কিছু পরীক্ষা করা হবে। তারপর তার অবস্থা বোঝা যাবে।'
আবুল কাসেম এখন ঢাকা মেডিকেলে ১১৫ নাম্বার ওয়ার্ডের ৮ নাম্বার বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। অত্যন্ত দুর্বল ও ক্ষীণ কণ্ঠে সেই দিনের বর্ণনা দেন তিনিও।
কাসেম বলেন, "কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসছিলাম। আমি তখন সিটে বসে জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলাম। হঠাৎ আমি সামনে উপুর হয়ে পড়ি। ওঠার চেষ্টা করি অনেক, কিন্তু কোনভাবে উঠতে পারছিলাম না। পেছনে তাকিয়ে দেখি আমার পায়ের পুরো চামড়া উঠে গিয়ে সিটের লোহার মধ্যে ঢুকে গেছে। হাতও নাড়াতে পারছিলাম না, ভেংগে গেছে।"
মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসা কাসেম যোগ করেন, "শুধু কিছু কণ্ঠ শুনি–ওনাকে ধরেন, তাকে উঠান, উনি তো মারা যাবেন…, আর কান্নার শব্দ। ভাবছিলাম হয়ত আমিও মারা যাব। এরপর আমার চোখ বন্ধ হয়ে যায়, তারপর আর কিছুই মনে নাই। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি হাসপাতালে।"
পাশেই তার ছেলে নুরুজ্জামান, তার মেয়ে মরিয়ম ও স্ত্রী দাঁড়িয়ে শুনছিল সব। সবার মুখ ছিল শুকনো।
জানতে চাইলাম, চিকিৎসা কিভাবে হচ্ছে। তার স্ত্রী বলেন, "আমরা গরীব মানুষ। তিনি একা আয় করেন। বাড্ডায় পাটের বস্তার ব্যবসা করেন। তার এই অবস্থায় আমাদের হাতে কোন টাকা নাই। কোন রকম ধারদেনা করে চলছি। কতদিন চিকিৎসা চালাতে পারব জানি না। তিনি আয় করতে পারলেই আমাদের সংসার চলে।"
এদিকে দুর্ঘটনায় হতাহতদের কোন ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে কি-না জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক মোঃ কামরুল আহসান বলেন, "মন্ত্রী দেশের বাইরে আছে। তিনি ফিরে আসলে ক্ষতিপূরণের বিষয় আলোচনা হবে।"