গাজার আল-শিফা হাসপাতালের পর ইসরায়েলের পরবর্তী নিশানা কী?
ইসরায়েলি বাহিনী দ্বিতীয় দিনের মতো গত বৃহস্পতিবার গাজার বৃহত্তম আল-শিফা হাসপাতালে ব্যাপকভাবে প্রবেশ করেছে।
হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোর নিচে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের ভূগর্ভস্থ কেন্দ্রের দৃঢ় অভিযোগ তুলে তা অনুসন্ধানের জন্য ইসরায়েলি বাহিনী যে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, তা এখন পর্যন্ত ব্যর্থ।
হামাস, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যাদের হাসপাতালে প্রবেশাধিকার রয়েছে, তারা সবাই জানিয়েছে যে আল-শিফা হাসপাতালে কোনো সামরিক স্থাপনা বা সৈন্য নেই। তারা বলেছে, এখানে কেবল ক্লান্ত চিকিৎসক, নার্স, অসংখ্য রোগী ও ইসরায়েলি হামলায় বাস্তুচ্যূত মানুষেরা রয়েছেন।
গাজার হাসপাতালগুলোতে হামলার বৈধতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইসরায়েলের প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে একটি হলো হামাস চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রগুলোতে হামলার না করার মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে। তারা সামরিক উদ্দেশ্যে হাসপাতালগুলো ব্যবহার করেছে। এটি ইসরায়েলি বাহিনীকে হাসপাতালে হামলা ও অভিযানের অধিকার দিয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনী তাদের এ অভিযোগ 'প্রমাণের' জন্য বহুদূর পর্যন্ত দৌড়েছে। কিন্তু তারা এ বিষয়ে প্রমাণ জোগাড় করতে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ। এ সপ্তাহের শুরুতে কয়েকজন সাংবাদিককে আল-রানতিসি চিলড্রেন'স হসপিটালে নিয়ে যান ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি। তিনি হাসপাতালে সাংবাদিকদের কয়েকটি কালাশনিকভ রাইফেল ও একটি মোটর সাইকেল দেখিয়ে সেগুলোকে তাদের অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন।
আল-শিফা হাসপাতালে হাগারির অধীনস্থ লেফটেন্যান্ট কর্নেল জোনাথন কনরিকাসও হাগারির সুরেই কথা বলেন। তিনি হামাসের 'সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রমাণ' হিসেবে ম্যাগজিনসহ অর্ধ ডজন একে রাইফেল, একটি ল্যাপটপসহ আরো কিছু জিনিস উপস্থাপন করেন।
মধ্যপ্রাচ্যে কখনো অবস্থান করেছেন কিংবা কোনো যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন এমন যে কেউ জানেন যে কালাশনিকভ অস্ত্রটি মোটামুটি সবখানেই রয়েছে। অপরাধী কিংবা কোনো সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার জন্য হাসপাতালের সশস্ত্র প্রহরীদের কাছে এ অস্ত্র থাকাটা স্বাভাবিক ও আইনগতভাবেও বৈধ।
ইসরায়েলের অসঙ্গতিপূর্ণ এ অভিযোগ ছাড়াও বন্দুকগুলো যেখানে পাওয়া গেছে, সেই জায়গাটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কনরিকাস অবশ্য তার দাবিতে অনড় যে এসব বন্দুক হাসপাতালের এমআরআই কক্ষে লুকানো ছিল।
কিন্তু যারা কখনো এমআরআই পরীক্ষা করেছেন বা করিয়েছেন তারা প্রত্যেকেই জানেন যে এ পরীক্ষার সময় সব ধরনের ধাতব বস্তু সরিয়ে রাখতে হয়।
একজন রেডিওলোজি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে এ নিয়ে লেখকের আলাপ হয়। লেখক তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে ওই কক্ষে বন্দুক লুকিয়ে রাখা সম্ভব কি না। বিশেষজ্ঞ তাকে জানিয়েছিলেন যে এমনটা সম্ভব নয়। কারণ এমআরআই মেশিন চালু করার সঙ্গে সঙ্গে সেটি বন্দুককে টেনে নেবে এবং একপর্যায়ে বন্দুকগুলো সেই মেশিনের সঙ্গে আটকে যাবে। এমআরআই মেশিন তখন আর কাজ করবে না।
কম সংখ্যক হতাহত ও সীমিত সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে আল-শিফা হাসপাতালের মতো গাজায় স্থল দখলে ইসরায়েলি বাহিনী সফল হয়েছে ঠিকই, তবে তারা হামাসের ভূগর্ভস্থ টানেল বা পরিচালনা কেন্দ্র উন্মোচিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।
যদিও ইসরায়েলি বাহিনীকে কিছুটা ভূগর্ভে অভিযান চালাতে দেখা গেছে এবং এ অভিযানে তাদের কোনো প্রতিরোধের মুখেও পড়তে হয়নি, তবে ইসরায়েলি সেনাদের এ অভিযান পরিচালনার জন্য অতটা আন্তরিক বলে মনে হয়নি।
হামাসের ভূগর্ভস্থ কেন্দ্র খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে মাটিতে একটি গর্ত দেখিয়ে এটিকে হামাসের সামরিক টানেলের প্রবেশদ্বার বলে দাবি করেছে ইসরায়েল।
যতক্ষণ পর্যন্ত না গণমাধ্যমকে এটি পরীক্ষা করে দেখতে দেওয়া হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত এটি আসলেই হামাসের সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ নাকি ভূগর্ভস্থ বৈদ্যুতিক তারের জন্য ব্যবহৃত কোনো ব্যবস্থা, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।
আমার কোনো সন্দেহ নেই যে হামাসের ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার, যোগাযোগের সরঞ্জাম, পাওয়ার স্টেশন, স্টোরেজ সুবিধা ও পরিচালনা কেন্দ্র রয়েছে।
প্রত্যেক বিশেষজ্ঞকে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে যে 'হামাসের এমন কোনো হৃৎপিণ্ড' রয়েছে এবং সেটি গাজার নিচে কোথাও টিক টিক করছে, যেমনটি অভিযোগ করে আসছে ইসরায়েল। তবে সম্ভবত তা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু দৃশ্যত তা আল-শিফা হাসপাতালের নিচে অন্তত নয়।
আকাশ থেকে অব্যাহত বোমা হামলার মধ্যে অনেক পর্যবেক্ষক হয়ত লক্ষ্য করেননি যে হাসপাতালগুলোতে অভিযান ছাড়া প্রায় এক সপ্তাহ ধরে স্থল অভিযান খুব কম পরিচালনা করেছে ইসরায়েল।
অন্যদিকে হামাসও বেশ নীরব। প্রথমদিকে যদিও তারা ইসরায়েলি বাহিনীর কিছু আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ইসরায়েলি বাহিনীকে ভূগর্ভস্থ টানেল ও হামাসের পরিচালনা কেন্দ্র ধ্বংস করার জন্য সেটিকে খুঁজে বের করতে ভূগর্ভে অভিযান চালাতে হবে- এটা জানার পর হামাসের আল-কাসাম ব্রিগেড এক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে।তারা কেবল ভূমিতে থেকে জিততে পারবে না।
তাহলে এরপর কী হবে?
যদি লড়াই চালিয়ে যেতে হয় তাহলে ইসরায়েলকেই প্রথমে অগ্রসর হতে হবে। হামাস ইসরায়েলি বাহিনীর চেয়ে দীর্ঘসময় ধরে অপেক্ষা করতে পারবে। ইসরায়েল যে অভিযোগ তুলেছে সে সম্পর্কে বাস্তব ফলাফল সামনে আনতে না পারলে যুদ্ধ অব্যাহত রাখার বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিরোধিতা আরো শক্তিশালী হবে — এটি জেনে ফিলিস্তিনিরা নীরব থাকার মাধ্যমে ইসরায়েলকে তাদের মতো করে ছেড়ে দেওয়ার কৌশল নিতে পারে।
ইসরায়েল যে তার নাগরিকদের কাছে কিছু সাফল্য দেখানোর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন তার কিছু লক্ষণ রয়েছে। তারা জনসংযোগের কৌশলজনিত কিছু চমক আবারও চালু করছে।
গত বুধবার ইসরায়েল ৩৫ প্যারাট্রুপার ব্রিগেড গাজায় নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের মেরুন বেরেট (বিশেষ পোশাক) প্রদান করেছে।
তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কেউ কেউ স্পষ্টতই আশা করেন যে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ও গাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে গত বৃহস্পতিবার প্রতীকীভাবে ইসরায়েলি পতাকা প্রদর্শনের ফলে যে দৃষ্টিভঙ্গির উদয় হয়েছিল তা হয়ত অনেকের মনে প্রশ্ন তৈরি করবে যে 'আমরা কি আসলেই হামাসকে মারছি?'