নতুন বছরে সবাই মিলে যেন ‘গণনিঃসঙ্গতায়’ না ভুগি বা ‘একা না থাকি’
আসাদগেট নিউকলোনির বাসাটিতে সব মিলিয়ে ছোট তিনটি কক্ষ ছিল। সাথে আরো ছোট একখানা নামকাওয়াস্তে ডাইনিং রুম, ছোট একটা ঝুলবারান্দাও ছিল। সেখানে যে পরিবারটি বাস করত, তাদের সদস্যসংখ্যা ছিল মূলত চারজন, বাবা-মা ও দুই ভাইবোন। কিন্তু সেই বাসায় প্রতিবেলায় কমপক্ষে ৭টি থালায় খাবার বাড়া হতো। আর কোনো কোনোদিন সেটা বেড়ে দাঁড়াত ১০-১২ জন। যার যখন ইচ্ছা এসে ভাত খেত। যে যখন ইচ্ছা গ্রাম থেকে এসে ব্যাগ হাতে নিয়ে বাসায় ঢুকে পড়ত, কিছুদিন থাকার জন্য।
তাদের প্রত্যেকেরই ঢাকায় আসার কারণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ—কারো লক্ষ্য ছিল চাকরি খোঁজা, কারো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, কারো চিকিৎসা, কারো বিয়ের কেনাকাটা, কারো বিদেশ গমন, কারো উদ্দেশ্য ছিল নিছক ঢাকা দেখা। এমনকি বিশ্ব এজতেমা উপলক্ষে এসে ঢাকায় বেড়িয়ে যাওয়া। কেউ থাকত দুইবেলা, কেউ দুই মাস, আবার কেউ বা বছরখানেক। অসংখ্য ছেলেমেয়ে কলোনির এই ছোট বাসা থেকেই তাদের পড়াশোনা শেষ করেছে। এরচেয়েও আরো বেশিসংখ্যক আত্মীয়-অনাত্মীয় এই বাসাটিকে ঘিরে ঢাকা শহরে তাদের আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন।
৭০-৮০-র দশকের যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময়ে ঢাকা শহরে আশ্রয় দেওয়ার মতো মানুষ ছিল কম। খুব সীমিত আয় ছিল অধিকাংশ মানুষের। এরপরেও সীমিত আয়ের মানুষগুলো কারো দায়িত্ব নিতে পিছপা হতো না। তখন অনেকগুলো মানুষ একসাথে থাকত, সাধারণ খাবার ভাগ করে খেত, একটা ঘরে গাদাগাদি করে মাটিতে চাদর পেতে ঘুমাত, একটা পড়ার টেবিলে তিন-চারজন গুনগুনিয়ে পড়ত, একটা ডিম ভেজে তিন-চারজনে ভাগ করে খেত, ভাইবোন এ-ওর জামা পরে, পড়ার বই পড়ে বড় হয়েছে। গৃহে আগত অতিথি, আত্মীয়-স্বজন সবাই যেন পাশাপাশি থাকাটা শিখে নিয়েছিল। তাই তখন মানুষগুলো বিচ্ছিন্নতায় ভুগত না।
সময়ের সাথে সাথে আমাদের জীবনমানের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। অনেকেরই বড় বাড়ি হয়েছে, গাড়ি হয়েছে, ব্যাংকে টাকা বেড়েছে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। ঘরভরা নতুন নতুন দামি আসবাব, হাতে প্রযুক্তি, কিন্তু সেই ভালোবাসায় ঘেরা আশ্রয় কোথায়? প্রয়োজনের সময় এই শহরে পা রাখার মতো জায়গা কোথায়? পাশে দাঁড়ানোর মতো বন্ধু-স্বজন কোথায়? পাড়া-প্রতিবেশী, মহল্লাবাসী সবাই যেন থেকেও নেই।
বছর শেষে প্রতিবারই ফেলে আসা শৈশব-কৈশোর ও তারুণ্যের দীর্ঘ পথচলার নুড়ি-পাথর, ছবি, মায়া ডাক দিয়ে যায় বারবার। সেইসময় বাড়িটা শুধু বাড়ি ছিল না, ছিল অপরিমিত হাসি, আনন্দ, শক্তি আর শান্তির উৎস। ছিল না কোনো ভয়, বিধিনিষেধের বাড়াবাড়ি। এখানে যেটুকু কষ্ট ছিল, তা এই বাসায় থাকা একঝাঁক মানুষ ভাগ করে নিয়েছিল।
আর আজকের এই নাগরিক জীবনে কপটতার ছড়াছড়ি, অথচ আন্তরিকতার অভাব। আমাদের চাহিদা বেড়েছে অনেক, বেড়েছে জৌলুস, খরচের হাত বেড়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, অনুষ্ঠান-আয়োজন বেড়েছে, আয়ও বেড়েছে অনেকের অনেক বেশি। কিন্তু কমেছে ভালবাসা ও সহমর্মিতা। প্রতিনিয়ত অনুভব করছি আমরাই ক্রমশ জীবনকে প্রতিযোগিতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি। আর যত বেশি প্রতিযোগিতার মধ্যে ঢুকছি, যত বেশি চাহিদা সৃষ্টি করছি, ততই আয় করার চেষ্টা করছি। যত বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছি, ততোই যেন সুখ হারিয়ে ফেলছি।
যার ১ লাখ টাকা আছে, সে ৫ লাখ টাকা আয়ের জন্য কাজ করছে। যার ১০০ কোটি টাকা আছে, সে হাজার কোটি টাকা আয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। যার দুটো ব্যবসা আছে, সে আরো চারটি ব্যবসা করার চেষ্টা করছে। যার মাথা গোঁজার মত একটি বাড়ি আছে, সে চাইছে আরো দুটি বাড়ির মালিক হতে। অবশ্য মানুষ নিজের অবস্থার উন্নতি চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যখন আমরা সাধ্যের বাইরে গিয়ে নিজের ও পরিবারের সাধ মেটানোর চেষ্টা করি, তখনই আমরা পরাজিত হতে শুরু করি। সবসময় লাগাতার চেষ্টা করে, পরিশ্রম করেও চাহিদার এই ঊর্ধ্বগতিকে মেটানো সম্ভব না হলে মানুষ তখন টাকা আয়ের অন্য কোনো উপায় বেছে নেয়। আমরা চাহিদার লাগাম টানতে ভুলে যাচ্ছি, কোথায় থামতে হবে ভুলে যাচ্ছি বলেই দুর্নীতিতে দেশটা ভরে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেভাবে কোটিপতি টাইপের ধনী লোকের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া সম্ভব যে এই ধনিক গোষ্ঠীর একটা বড় অংশের আয় সৎ পথে উপার্জিত হচ্ছে না। অসৎ মানুষের কালো টাকাকে সাদা করার জন্য এবং বাড়ি-জমি সবকিছুকে হালাল করার উপায় বের হয়েছে। তবে কালো মনকে সাদা করার কোনো পথ বের হয়নি। তাই বাড়ছে কালো মনের মানুষের সংখ্যা আর সাদা মনের মানুষ খোঁজার জন্য পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপন দিতে হচ্ছে।
আজকাল শিশুদের বদ্ধ জীবন দেখে, প্রযুক্তিতে মাথা গুঁজে থাকতে দেখে, ভালোবাসাহীন ও বন্ধুহীন একক পরিবারে বড় হতে দেখে আমাদের বয়সী প্রায় সকলেরই মনে পড়ে পাড়ার মাঠে খেলার কথা, আনন্দময় স্কুলজীবন, পথে পথে দলবেঁধে ঘোরাঘুরি করা, মাঠে বৃষ্টির পানি জমে গেলে তাতে মাছ ধরা, খেলাঘর-কচিকাঁচার আসর করা, কবিতা পড়া, সবাই মিলে পাড়াতেই পিকনিক করার কথা। ঈদ, শবেবরাত, পুজো, পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারিসহ সবকিছু করেছি সবাই মিলে। তখন কোনো ভাল খাবার পাশের বাড়িতে না দিয়ে খাওয়া হতো না। পাড়ার বন্ধুরা একটা খাবার কিনলে ১০ জনে ভাগ করে খেতাম। পাশাপাশি যারা থাকতেন, তারা শুধু প্রতিবেশীই ছিলেন না, ছিলেন আত্মার আত্মীয়। যেসব পুরোনো বাসায় আমরা থাকতাম, সেগুলোর অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হয়ে পড়েছিল। জৌলুস হারিয়ে, পলেস্তারা খসে পড়তে শুরু করেছিল। রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় চলে গেলেও মায়া কাটানো খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল এখানকার বাসিন্দাদের, এখানে বেড়ে ওঠা শিশু-কিশোরদের।
আজকাল নগরবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে কোথায় যেন একটা মায়ার অভাব চোখে পড়ে। শুধু ছুটে চলা, শুধু অর্জনের গল্প। কতটা ছুটব, কতটা আয় করবো, কতটা অর্জন করার পর থামতে হবে, এই বোধটুকু ক্রমেই ফিকে হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন:
'আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি।
সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ।
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক।'
সেইরকম কোনো সুখ এখন আমরা কল্পনাও করতে পারি না। বরং এইসব সুখের গল্প শুনে মানুষ হাসে। ইয়াং জেনারেশন প্রাপ্তি বলতে টাকা বোঝে, আমরাও তা-ই বুঝি। সবাই এখন সুখ মাপি টাকার অঙ্কে। যে তিতাস গ্যাসের মিটার রিডার, বন বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ হাজার কোটি টাকার মালিক, এরাই সমাজের নিয়ন্ত্রক, পথের দিশারী।
আমাদের সন্তানেরা সবকিছু শিখছে, জানছে, জিপিএ পাচ্ছে, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-আমলা হচ্ছে, কর্পোরেট জগতে ঢুকছে। এদের কতজন তাদের পড়াশোনা, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্বপালন ও নিজেদের কাজের প্রতি পূর্ণ মনোযোগী হচ্ছে? কতজন তাদের নিজেদের কাজ বা প্রয়োজনের বাইরে মানুষের জীবন কীভাবে চলছে, পরিবেশটা কীভাবে চলছে বা সেখানে কী হচ্ছে সেটা নিয়ে উৎসাহী বা আগ্রহী? যেখানে পড়াশোনা করার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হচ্ছে ভালো নম্বর পাওয়া, সুযোগ-সুবিধা অর্জন, সার্টিফিকেট ও পুরস্কার পাওয়া, সেখানে যে প্রকৃত জ্ঞান অর্জিত হবে না, তা সহজে অনুমেয়।
এখনকার শিক্ষিত ও অবস্থাপন্ন অভিভাবক, যারা নিজেদের সচেতন বলে দাবি করছেন, তারা যেমন নিজেরা থামতে ভুলে গেছেন, তেমনি সন্তানদেরও থামাতে চাইছেন না বা পারছেন না। চাহিদা বাড়ছে ঘরে ঘরে। যারা পারছেন, তারা প্রতিটি অনুষ্ঠানে, যেমন সন্তানের বিয়ে, জন্মদিন, খাতনা, বিয়ে বার্ষিকীতে এখন দেদার খরচ করছেন। যারা খরচ করতে পারছেন না, তারা হতাশ হচ্ছেন অথবা ঋণ করে, জমি বন্ধক দিয়ে করার চেষ্টা করছেন। সব আনন্দ ও দিবস উদযাপন যেন রাজকীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ যেন একটা চক্র, আর এই চক্রে পড়ে যেতে হয় আমাদের সবাইকে। এই চক্রে পড়ে গেলে জীবন থেকে আন্তরিকতা, মনোযোগ ও ভালবাসা হারিয়ে যায়, পড়ে থাকে জৌলুস, অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও আমাদের অতৃপ্ত আত্মা।
জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ রুমি বলেছেন 'আগে তোমার মনকে মুক্ত করে দাও, এবং তারপর মনোযোগী হও। কান বন্ধ করে শোনো!' আমরা ভালো থাকার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পড়ে মনোযোগটাই হারাতে বসেছি। বুঝতেই পারছি না কখন আমরা পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে একসাথে থেকেও একা হয়ে পড়ছি। পোলিশ দার্শনিক জিগমুন্ট বাউম্য্যান যেমনটা বলেছেন, 'আমরা সবাই এখন একসাথে একা। আমরা গণনিঃসঙ্গতার শাস্তিপ্রাপ্ত।' আসুন নতুন বছরে নিজেদের কিছুটা পরিবর্তন করি। শুধু ছুটে চলা নয়, অসুস্থ প্রতিযোযাগিতা নয়, ব্যাপক চাহিদা নয়—বরং পাশে থাকা মানুষগুলোর দিকে নজর দিই, তাদের ভালবাসি।
- শাহানা হুদা রঞ্জনা: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিষ্ট