‘লাভের চিন্তা করলে বিপিএলে থাকা যাবে না’
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) মালিকানার পালাবদলে পাল্টে যায় সিলেট ফ্র্যাঞ্জাইজির ভাগ্য। টি-টোয়েন্টি টুর্মামেন্টটির গত আসরে গড়পড়তা দল নিয়েই বাজিমাত করে সিলেট স্ট্রাইকার্স। মাশরাফি বিন মুর্জতার চৌকস নেতৃত্ব এবং নাজমুল হোসেন শান্ত ও তাওহিদ হৃদয়ের অবিশ্বাস্য ব্যাটিংসহ আরও কিছু উল্লেখযোগ্য পারফরম্যান্সে ফাইনাল খেলে দলটি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের কাছে শিরোপা খোয়ালেও দারুণ একটি আসর কাটে সিলেটের। সেই দলটিরই এবার করুণ দশা!
আগেরবারের মতো এবারও তারকা নির্ভর দল গড়েনি সিলেট। আজকের ম্যাচের আগ পর্যন্ত নেতৃত্বে ছিলেন মাশরাফি। জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক ও তার দল: কারোরই সময় ভালো যায়নি। হার দিয়ে বিপিএল শুরুর পর টানা হেরে গেছে দলটি। ব্যাটিং ব্যর্থতা ও গড়পড়তা বোলিংয়ে প্রতিপক্ষকে হারের স্বাদ দিতে পারেনি তারা। টানা পাঁচ হারের পর সরে দাঁড়ান মাশরাফি। হুইপের দায়িত্ব সামলাতে বিপিএল থেকে বিরতি নিয়েছেন তিনি।
অবশেষে জয়ের দেখা পেয়েছে সিলেট, মাশরাফিহীন দলটি আজ সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে দুর্দান্ত ঢাকাকে হারিয়ে প্রথম জয়ের স্বাদ নিয়েছে। দলে মাশরাফির উপস্থিতিতে ক্রিকেটাররা অনুপ্রাণিত হয়েছেন, কিন্তু তার ছোঁয়ায় এবার জয়ের মালা গাঁথতে পারেনি সিলেট। উল্টো চোট নিয়ে খেলায় প্রবল সমালোচনা হয়েছে তাকে নিয়ে। একাদশে থেকেও নিয়মিত বোলিং না করা, অনেকটা হেঁটে হেঁটে বোলিং করায় সিলেটের হারের দায় চাপানো হয়েছে মাশরাফির ওপর।
যদিও 'চোটাক্রান্ত' মাশরাফিকে দলের অনুপ্রেরণার কেন্দ্রবিন্দু বলছেন সিলেটের মালিকানায় থাকা জগলুল হুদা মিঠু। তার দৃষ্টিতে সিলেট দলের 'বাবা-মা', সবকিছুই মাশরাফি। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের ওয়ানডের সফলতম অধিনায়ক সিলেটের কোনো কিছুতেই নেই, আবার সবকিছুতেই আছেন বলে জানান জগলুুল।
বিপিএলে দল গড়া, লাভ না হওয়ার পরও দল গড়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য, বিপিএলে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ, দলে মাশরাফির ভূমিকা, এবারের আসরে টানা হারের পর ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জসহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন জগলুল। দীর্ঘ আলাপচারিতার মাঝে তিনি জানান, লাভ করার আশায় কেউ বিপিএলে এলে এটা তার জন্য ভুল জায়গা।
খারাপ করলেও দলের ওপর আস্থা আছে জগলুলের। খেলায় হার-জিত থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের দল ভালো হয়েছে। খেলায় তো হার-জিত থাকবেই। সব শুরু বা শেষ একই রকম হবে না সব সময়। লম্বা সময় ধরে আমাদের সেরাটা দিয়ে যেতে হবে, এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া। বাকিটা মাঠের লড়াইয়ে ঠিক হবে।'
বিপিএলের গত আসরে খুব কাছে গিয়েও শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হয়নি সিলেটের, রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় দলটিকে। এবার আগেই শিরোপায় চোখ রাখেনি তারা, ধাপে ধাপে এগোনোর পরিকল্পনার কথা জানানা জগলুল। তার ভাষায়, 'লক্ষ্য তো সবারই থাকে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার। তবে আমরা ধাপে ধাপে এগোতে চাই। আগে কোয়ালিফায়ার, এরপর চ্যাম্পিয়নশিপ হওয়ার ব্যাপারটা।'
গত আসরের তুলনায় এবারের সিলেট দলটা তুলনামূলক কম শক্তিশালী। কিন্তু সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিপিএলে দল গড়ার খরচও বেড়ে যাচ্ছে বলে জানান জগুলুল। তিনি বলেন, 'সবকিছুর মূল্য বদ্ধি পাচ্ছে। খেলোয়াড় থেকে শুরু সবকিছুর মূল্য প্রতিবছরই বেড়ে যাচ্ছে, তো প্রতি বছরই খরচ বাড়ছে। সেই হিসেবে এবারও খরচ বেড়েছে। আমি নির্দিষ্ট পরিমাণ বলতে পারছি না, তবে খরচ বেড়েছে।'
বাংলাদেশে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি লিগ আছে, এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন জগলুল। মানের দিক থেকে অন্যান্য লিগের সঙ্গে বিপিএলকে তুলনা করতে চান না তিনি, 'আমাদের একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট আছে, এটার জন্য আলহামদুলিল্লাহ। আমি আইপিএল বা অন্য কোনো টুর্নামেন্টের সঙ্গে বিপিএলের তুলনা করবো না। তবে একটা চাওয়া যে, তিন-চারটা ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট চলাকালীন বিপিএল না হলে ভালো হতো। সবদিক থেকে সবার সুবিধা হতো তাহলে।'
মার্কেটিংয়ের জন্য বিপিএলকে বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে থাকে আসরটির অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজিই। কিন্তু সিলেটের মালিকানায় যারা আছেন, তাদের ব্যবসা দেশের বাইরে। বিপিএলকে মার্কেটিং প্ল্যাটফর্ম হিসেবে নেয়নি তারা। নিছকই ক্রিকেটপ্রেম থেকে বিপিএলে দল গড়া জানিয়ে জগলুল বলেন, 'আমরা ক্রিকেট ভালোবাসি। আমেরিকায় ক্রিকেটের সংশ্লিষ্ট কাজে যুক্ত আছি। ওখানে আমাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ বিনোয়াগ আছে। অন্য কোথাও বিনিয়োগ না করে দেশে বিনিয়োগ করার ভাবনা থেকে বিপিএলে দল গড়া।'
যে উদ্দেশ্যে বিপিএল দল গড়া, এক বছরেই সেটা পূরণ হবে না বলে মনে করেন জগলুল। আরও সময় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা সাজানোর ইচ্ছা সিলেটের, 'এক বছরেই উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। এক বছরেই যদি সব ফল খেয়ে ফেলতে চান, তাহলে গাছটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ইনশাআল্লাহ, দেখা যাক আস্তে আস্তে এগোলে কী হয়। আমার বিশ্বাস বিসিবির পরিকল্পনা আছে, বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের পরিকল্পনা আছে, হয়তো সামনে দিনে দিনে উন্নতি হবে। দল হিসেবে দারুণ হয়ে উঠতে আমাদেরও চেষ্টা করতে হবে, যা আমরা করে যাচ্ছি। আমাদের জার্সি এবং স্পন্সরদের যেভাবে আমরা প্রমোট করছি, এটা নতুন। আমার আশা সবকিছু আরও ভালো হবে এবং স্পন্সর থেকে শুরু করে বাকিরা বিপিএলে যুক্ত হতে আরও আগ্রহী হবে।'
বিপিএলের দশম আসর চলছে। অর্থের ঝনঝনানি থাকলেও ঘরোয়া এই আসর থেকে বেশিরভাগ ফ্র্যাঞ্চাইজিই লাভ করতে পারেননি। সিলেটও দেখতে পারেনি লাভের মুখ। জগলুল বলেন, 'এখানে লাভ করার কোনো রাস্তাই নেই। লাভের চিন্তা করলে বিপিএলে থাকা যাবে না। বিপিএল থেকে লাভ করতে হলে আপনাকে প্রচলিত ভাবনার বাইরে ভাবতে হবে, 'আউটসাইড দ্য বক্স' ভাবতে হবে। একাডেমি বা অন্য কিছু নিয়ে কাজ করতে হবে।'
বিপিএলে স্পন্সরশিপের বাইরেও আয় করা সম্ভব জানিয়ে জগলুল বলেন, 'আমি ভুল না করে থাকলে গত বিপিএলে আমরা ৩০-৪০ হাজার জার্সি বিক্রি করেছি। দুই-এক মাসের মধ্যেই এই পরিমাণ জার্সি বিক্রি হয়ে গেছে। এবারও আমরা ভিন্নভাবে জার্সি তৈরি করেছি, আমাদের জার্সিতে ভিন্নতা আছে। জার্সি উন্মোচনের পর আমরা ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। এবার আমরা ভালো পরিমাণে জার্সি বিক্রি করতে পারবো বলে আশা করছি।'
বিপিএল শুরুর আগে সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বোলার হান্ট কার্যক্রম চালিয়েছে সিলেট স্ট্রাইকার্স। তবে দলটির লক্ষ্য আরও বড়, একাডেমি গড়ে নতুন নতুন খেলোয়াড় তৈরি করতে চায় তারা। জগলুল বলেন, 'আমাদের লক্ষ্য একাডেমি গড়া। যেখান থেকে আমরা আয় করে বিপিএলে বিনিয়োগ করতে পারি। একাডেমি থেকে তরুণ ক্রিকেটার উঠে আসতে পারে, যা বাংলাদেশ ক্রিকেটের কাজে আসতে পারে। এ কারণেই একাডেমি করাটা আমাদের প্রধান লক্ষ্য।'
'আমরা বিপিএল শুরুর আগে বোলার হান্ট করেছি। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কীভাবে উন্নত করা যায়, পরের ধাপে নেওয়া যায়, সেটা নিয়ে আমাদের কোচরা পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন, কাজ করছেন। পুরো বছরই তাদের নিয়ে কাজ করা হবে। ক্রিকেট যেহেতু ভালোবাসি, শুধু বিপিএলে সীমাবদ্ধ থাকতে চাই না। বড় পরিসরে কাজ করার ইচ্ছা, পরিকল্পনা আছে। সেই পরিকল্পনায় একাডেমি গড়া সবচেয়ে বড় কাজ আমাদের।' যোগ করেন তিনি।
কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের স্বত্বাধিকারী নাফিসা কামাল বিপিএলের লভ্যাংশ দাবি করেছেন। লভ্যাংশ না পেলে বিপিএলের আগামী আসর থেকে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স থাকবে না বলে জানিয়েছেন তিনি। লভ্যাংশের ভাবনার ব্যাপারে জানতে চাইলে জগলুল বলেন, 'যোগাযোগের মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। এমন কথা হলে সমাধানও আসবে। অনেক বছর ধরে কুমিল্লা এখানে আছে, দলটির মালিকের অধিকার আছে হয়তো এটা নিয়ে বলার। আমরা এলামই গত বছর, দেখছি-বুঝছি। সত্যি বলতে এসব বলার সময় আমাদের হয়নি।'
গত আসরের মতো এবারও সরাসরি চুক্তিতে মাশরাফিকে দলে ভেড়ায় সিলেট স্ট্রাইকার্স। হাঁটুর চোটে ভুগলেও তাকে একাদশে চেয়েছেন দলটির মালিকপক্ষ। জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়কের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে জগলুল বলেন, 'উনি শতভাগ যুক্ত সিলেট স্ট্রাইকার্সের সঙ্গে। আমরা বাংলাদেশে কীভাবে ক্রিকেট কার্যক্রম চালাতে পারি, উনি আমাদের বুঝিয়েছেন। বিপিএলের পথচলায় উনি আমাদের সঠিক মানুষ দিয়েছেন। কোনো কিছুর সঙ্গে তিনি যুক্ত নন, আবার সবকিছুর সঙ্গেই যুক্ত। সিলেট স্ট্রাইকার্সে তিনি বাবার ভূমিকায় আছেন।'