আল্পস পর্বতমালায় যেভাবে ১৯৬৬ সালের ভারতীয় সংবাদপত্রের সন্ধান মিলল
বোয়িং-৭০৭ মডেলের বিমানটি ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ারলাইন্স এয়ার ইন্ডিয়ার। সংস্থাটির অধীনে ফ্লাইট ১০১ নামেই পরিচিত ছিল এটি, আর নামটিও ছিল চমৎকার 'কাঞ্চনজঙ্ঘা'। যদিও শেষ পরিণতি ছিল ভয়ঙ্কর। ১৯৬৬ সালে যাত্রীসহ এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয় পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের নামের বিমানটি। আছড়ে পড়েছিল হিমালয় থেকে হাজার হাজার কিলোমিটার দূর, ফ্রান্সের আল্পস পর্বতমালায়।
ওই দুর্ঘটনার ৫৪ বছর পর সম্প্রতি পাওয়া যায় বিমানটিতে থাকা সেই সময়ের ভারতীয় সংবাদপত্র। যাতে রয়েছে ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধির ক্ষমতায় আহরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ।
গত সপ্তাহে এমন তাৎপর্যপূর্ণ সংবাদপত্রের কিছু কপি খুঁজে পান ফ্রান্সের শ্যামনি শহরের ক্যাফে মালিক টিমোথি মার্টিন। দ্য হিন্দু, দ্য স্টেটসম্যান, ন্যাশনাল হেরাল্ড এবং ইকোনমিক টাইম- এর মতো ভারতের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোর শিরোনাম ছিল; '' ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী'' আর ''প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন ইন্দিরা গান্ধি'' এমনভাবে।
বম্বে থেকে লন্ডনগামী ফ্লাইট ১০১ পাইলটের ভুলবশত ফ্রান্সের আল্পস অংশে অবস্থিত মন্ট ব্লাঁঙ্ক পর্বতে আছড়ে পড়ে। ১৯৬৬ সালের ২৪ জানুয়ারির ওই দুর্ঘটনায় ১০৬ জন যাত্রী ও বিমানটির ১১ জন ক্রুর সকলেই মারা যান। ১৯৫০ সালে ঠিক ওই একইস্থানে এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ২৪৫ ৪৮ জন যাত্রীসহ বিদ্ধস্ত হয়েছিল। সেবারও কেউ প্রাণে বাঁচতে পারেননি।
কাকতলীয় হলেও ফ্লাইট ১০১ এর বিদ্ধস্ত হওয়াটাকে নিছক দুর্ঘটনা মানতে নারাজ আজো অনেকেই। কারণ ওই বিমানেই ছিলেন ভারতের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডক্টর হোমি জি. ভবা। তার মৃত্যুতে সে সময় অনেক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম নেয়, আজো অনেক ভারতীয় যা বিশ্বাস করেন।
এমনই এক তত্ত্বে দাবি করা হয়, ডক্টর ভবাকে হত্যা করতেই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ' বিমানটি ধ্বংস করে দেয়। এমন বিশ্বাসের পেছনে যুক্তিও বেশ জোরালো। পৃথিবীর বৃহৎ দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন পরস্পরের বিরুদ্ধে চরম অস্ত্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ভারত ছিল সোভিয়েত ব্লকের দেশ। দেশটি পরমাণু বোমা তৈরির চেষ্টাও করছিল সে সময়।
১৯৬৫ সালের অক্টোবরেই ভারতের শীর্ষস্থানীয় নিউক্লিয়ায় ফিজিসিস্ট ভবা ঘোষণা করেন, সরকার অনুমতি দিলে তার সংস্থা মাত্র ১৮ মাসের ভেতর পরমাণু বোমা তৈরি করে ফেলবে। ওই ঘোষণার কয়েক মাস পরই তার মৃত্যু তাই সন্দেহের উদ্রেক করে বৈকি।
সাংবাদিক গ্রেগরি ডগলাস ২০০০ সনে প্রকাশিত তার ''কনভারসেশন উইথ দ্য ক্রো'' বইতে সিআইএ'র কর্মকর্তা রবার্ট ক্রাউলি'র বরাত দিয়ে দাবি করেন যে, ফ্লাইট ১০১ এর মালামাল রাখার স্থানে বোমা রেখে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতীয় এ বিজ্ঞানীকে হত্যা করে।
বইটিতে রবার্ট ক্রাউলির একটি মন্তব্য যুক্ত করা হয়, যেখানে তিনি ডগলাসকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন; ''ওই সময় আমরা (যুক্তরাষ্ট্র) মারাত্মক সমস্যায় ছিলাম। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ। ১৯৬০ এর দশকে ভারত খুবই উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করছিল। এমনকি তারা পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টাও করছিল।''
ভবাকে হত্যার বিষয়ে সিআইএ'র এ কর্মকর্তা আরও জানান, '' সময়টা ছিল খুবই বিপদজনক। তিনি আকস্মিক এক দুর্ঘটনার শিকার হন। কারণ,কার্গো হোল্ডে পেতে রাখা একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটলে তার বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিধ্বস্ত হয়।
ওই দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্ট অবশ্য জানায়, লন্ডন যাওয়ার পথে বিমানটি ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের চেষ্টাকালে এর পাইলট নিজের অবস্থান নির্ণয়ে ভুল করেন। আগেভাগেই উচ্চতা কমিয়ে অবতরণের চেষ্টা করায় বিমানটি পর্বতের গায়ে ধাক্কা খায়।
এর আগে ২০১৭ সালে প্রথম সুইস এক পর্বতারোহী ফ্লাইট ১০১ এবং ২৪৫ এর ধ্বংসাবেশ খুঁজে পান। তার অনুসন্ধানে বোয়িং ৭০৭ বিমানের ইঞ্জিন এবং যাত্রীদের দেহাবশেষেরও সন্ধান মেলে।