সীমান্তে রাশিয়ার আক্রমণ ঠেকাতে ইউক্রেন কিছুই করতে পারেনি!
গত সপ্তাহে ইউক্রেনের উত্তর সীমান্ত দিয়ে নতুন করে আক্রমণ চালায় রাশিয়ান বাহিনী। তাদের আক্রমণের গতি আর বহরের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যৎসামান্য পালটা প্রতিরোধ দাঁড়াতেই পারেনি।
অনেক ইউক্রেনীয় সেনা এ হামলায় হতচকিত হয়ে নিজেদের অবস্থান থেকে পিছু হটে। প্রায় দুই বছর আগে স্বাধীন করা অনেক গ্রাম হঠাৎ নতুন করে আবার গোলাবৃষ্টির সম্মুখীন হয়।
রাশিয়ান বাহিনী আক্রমণ শুরু করলে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আসেন ৫৫ বছর বয়সি অবসরপ্রাপ্ত কারখানাকর্মী তাতিয়ানা নভিকোভা। 'ওরা রাস্তাঘাটের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে,' রাশিয়ানদের আক্রমণ এভাবেই বর্ণনা করেন তিনি। তাদের প্রতিরোধ করার জন্য আশপাশে কোনো ইউক্রেনীয় সেনার টিকিটিও দেখতে পাননি তাতিয়ানা।
ইউক্রেনের সীমান্তে জড়ো হওয়া রুশ সেনাদের সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনী ও বিমানবাহিনী ছিল। রাশিয়ান বিমানবাহিনী এ আক্রমণে ফাইটার জেট ও ভারী গ্লাইড বোমা ব্যবহার করেছে। ইউক্রেনের ক্ষয়িষ্ণু আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একদমই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি রাশিয়ানদের জন্য।
সীমান্ত পার হওয়ার পর রুশ সেনারা ইউক্রেনের পাতা পরিখা, ল্যান্ড মাইন ও ট্যাংকবিধ্বংসী ফাঁদ সহজেই পার হয়েছে। এসব ফাঁদের কোনো কোনোটি দায়সারাভাবে বানানো হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের অনেক সৈন্য।
তবে ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো জনবল। গত দুই বছরের বেশি সময়ে যুদ্ধে শ্রান্ত ইউক্রেন এখন এর ৬০০ মাইল দীর্ঘ ফ্রন্টলাইন রক্ষায় পর্যাপ্ত সংখ্যক নতুন সৈন্য সংগ্রহে হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়া নতুন করে কয়েক হাজার সেনা সমাবেশ করেছে।
সপ্তাহান্তে রাশিয়ান আক্রমণের বহর স্পষ্ট হয়ে ওঠার পর ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী অন্যান্য এলাকা থেকে সেনা সরিয়ে ফ্রন্টলাইনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা অবলম্বন করে। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের দাবি, নতুন করে সেনা সমাবেশ করানোর জন্য তাদের পর্যাপ্ত রিজার্ভ সেনা নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউক্রেনীয় সেনা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খারকিভের বর্তমান পরিস্থিতি সংকটপূর্ণ, তবে নিয়ন্ত্রণে। শনিবার নাগাদ ইউক্রেনীয় বাহিনী রুশ অগ্রগতিকে মন্থর করেছে বলে জানা গেছে। তবে রাশিয়ান সীমান্তের কাছে দুপক্ষের তীব্র সংঘর্ষের কথা জানা গিয়েছে।
আঞ্চলিক সরকারসূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার নাগাদ প্রায় ১০ হাজার ইউক্রেনীয় সংঘাতপূর্ণ এলাকা ছেড়ে গিয়েছেন। অনেক গ্রামবাসী জানিয়েছেন, দুপক্ষের লড়াইয়ে তাদের পুরো গ্রাম ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তারা এভাবে এগোতে থাকলে খুব শীঘ্রই ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ রাশিয়ান গোলন্দাজ বাহিনীর পাল্লায় চলে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নাম গোপন রাখার শর্তে একজন ইউক্রেনীয় কমান্ডার মন্তব্য করেন, রাশিয়ানরা 'জানে তারা কী করছে'। যেসব বাসিন্দা ভেবেছিলেন তারা নিরাপদে আছেন, তাদের জন্য তার খারাপ লাগছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।
কয়েকমাস ধরে রাশিয়া ইউক্রেনের উত্তর সীমান্তের কাছে সেনা সমাবেশ করছিল। কস্তিয়াতিন ম্যাশোভেতস নামক একজন ইউক্রেনীয় সামরিক বিশ্লেষকরে মতে, খারকিভ ও সামি রিজিয়নের আশপাশে রাশিয়া ৫০ হাজারের বেশি সেনা জড়ো করেছে।
এর আগে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই ভি. ল্যাভরভ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সীমান্তসংলগ্ন 'স্যানিটারি জোন' তৈরির স্থাপনের ইচ্ছায় খারকিভের 'গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে'।
ইউক্রেন সমূহ বিপদকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়েছিল। গত ৯ এপ্রিল খারকিভের আশপাশের ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ ঘাঁটিগুলো পরিদর্শন করেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
'আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে। রাশিয়ানরা যেন দেখে আমরা আমাদের প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুত। আর আমাদের জনগণ যেন জানে শত্রুর আক্রমণের জন্য ইউক্রেন প্রস্তুত,' বলেছিলেন তিনি।
তবে ওসব প্রস্তুতি রুশ আক্রমণ ঠেকাতে খুব অল্পই ভূমিকা রেখেছে। সীমান্তে রাশিয়ার প্রস্তুতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকলেও রুশ সীমানার অভ্যন্তরে হাইমার্স-এর মতো হাই-প্রিসিশন মার্কিন অস্ত্র ব্যবহারে হোয়াইট হাউজের সম্মতি না থাকায় আক্রমণ করতে পারেনি ইউক্রেন।
ইউক্রেনের আরেকটি অসুবিধা যুদ্ধ শুরুর সময় থেকেই লেগে রয়েছে। দেশটি তার আয়তনের তুলনায় অনকে বড় একটি দেশের বিরুদ্ধে লড়তে নেমেছে। ইউক্রেনের তুলনায় রাশিয়ার জনবল ও অস্ত্রভান্ডার উল্লেখযোগ্যহারে বড়। আর ক্রেমলিন এর প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য রেকর্ড পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করছে।
ইউক্রেনের কিছু কর্মকর্তা জানান, রুশ সীমান্তের নিকটবর্তী স্থানে রাশিয়ান বাহিনীর নিয়মিত গোলা হামলার কারণে সেখানে প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি করা প্রায় অসম্ভব ছিল। তবে তারা আরও বলেন, ফ্রন্টলাইন থেকে দূরে তৈরি করা শক্তিশালী প্রতিরক্ষা লাইন রাশিয়ার আক্রমণের মুখে এখন পর্যন্ত টিকে আছে।
৫৭ ব্রিগেডের একজন লেফটেন্যান্ট ডেনিস ইয়ারোস্লাভস্কি বলেন, রাশিয়ার আক্রমণ শুরুর পর তাদের ভারী গোলাবর্ষণের মাঝে ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইনের কিছু অংশের সেনারা হাল ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ছেড়ে পালিয়ে যায়।
রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিউট নামক একটি ব্রিটিশ থিংক ট্যাংকের গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বর্তমানে রাশিয়ার পাঁচ লাখ ১০ হাজার সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে রয়েছে। এ পরিমাণ সৈন্য দিয়ে রাশিয়া সহজেই ফ্রন্টলাইনের সম্পূর্ণ অংশে আক্রমণ চালাতে পারবে রাশিয়া।
বাইডেন প্রশাসনের ৬১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সহায়তা প্যাকেজের অংশ হিসেবে ইউক্রেন শীঘ্রই আরও নতুন অস্ত্র পাবে। এর মধ্যে আর্টিলারি গোলা ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মিসাইল থাকবে। এগুলো হাতে পেলে ইউক্রেনীয় বাহিনীর ওপর চাপ কিছুটা কমবে বলে মনে করা হচ্ছে।
এছাড়া সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ইউক্রেনের সরকার বর্তমানে বয়সের সীমারেখা কমিয়ে ২৫-এ নিয়ে এসেছে। এর ফলে নতুন করে সৈন্য সংগ্রহে গতি আসার প্রত্যাশা করা হচ্ছে।