‘‘মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করে বসব’’ কোভিড সঙ্কটে মানসিক বিপর্যয়ের প্রান্তসীমায় বাণিজ্যিক জাহাজের নাবিকেরা
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সমুদ্র থেকে ঘরে ফিরতে পারছেন না পণ্য পরিবাহী জাহাজে কর্মরত তিন লাখ নাবিক ও অন্যান্য কর্মী। নানা দেশের বন্দরে অবতরণ নিষেধাজ্ঞা, নতুন নাবিকদের মাধ্যমে পুরোনোদের প্রতিস্থাপনে বাঁধা; ইত্যাদি কারণে সমুদ্রেই জাহাজের মধ্যে বন্দিদশায় কাটছে তাদের জীবন। এ অবস্থায় অচিরেই মানসিক বিপর্যয়ে পড়ার শঙ্কা করছেন মালবাহী জাহাজের কর্মীরা।
একাধিক সূত্রের বরাতে মার্কিন গণমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার জানতে পেরেছে যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে নাবিকদের মানসিক অবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ার আগের স্তরে রয়েছে। এদের অনেকেই গত এক বছরের বেশি হলো স্থলভাগে নামার সুযোগ পাননি।
অনেকেই বলেছেন তাদের মনে আত্মহত্যার চিন্তা জেগে ওঠার বিষয়ে। বিষয়টিকে তারা বিপৎজনক উল্লেখ করে বলেন, যেকোনো মুহূর্তে এসব বিদ্ধংসী চিন্তা সাগরে বাস্তবে রূপ নিতে পারে। মালবাহী জাহাজের নাবিকদের সবচেয়ে বড় জোট- ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স ফেডারেশন (আইটিএফ) গত জুনে প্রকাশিত তাদের এক প্রতিবেদনে নাবিকদের মানসিক সমস্যাকে 'সক্রিয় সময় নিয়ন্ত্রিত বোমা' (টিকিং টাইম বম্ব) বলে উল্লেখ করে।
আইটিএফ নানা শ্রমিক ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত এক জোট- পৃথিবীর মোট নাবিকদের ৩০ শতাংশ এর সদস্য।
জাহাজে কাজ করার চুক্তির মেয়াদ সাধারণত ছয় মাসের হলেও- বিশ্বমারির কারণে হাজার হাজার নাবিক ও কর্মীকে সাগরে অবস্থান করতে বাধ্য করা হয়েছে। এরা পৃথিবীর ৯০ শতাংশ মালামাল পরিবহনের দায়িত্বে নিযুক্ত। মহামারির মধ্যে জরুরি পণ্যের বৈশ্বিক সরবরাহ চাহিদা মেটাচ্ছেন তারা। আবার চুক্তিপত্রে উল্লেখিত মেয়াদের চাইতেও বেশি সময় ধরে জাহাজে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। নিঃসঙ্গতা, বিরামহীন যাত্রার ধকল, পিছু ফেলে আসা পরিবার-পরিজনের দুশ্চিন্তা ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে তাদের মানসিক জগতকে।
বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞার কারণে পরিস্থিতি আরো নাজুক রূপ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই অনেক দেশ সচল হলেও, জাহাজের পুরোনো নাবিকদের নতুন নাবিক দিয়ে প্রতিস্থাপনে নিজেদের আকাশপথ ও বিমান বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি তারা। ফলে বাধ্য হয়েই জাহাজে অবস্থান করতে হচ্ছে পুরোনো চুক্তির কর্মীদের।
আইটিএফ জানায়, বর্তমানে নাবিকদের সঙ্গে বিশ্বের সরকারগুলো যে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে, তা আন্তর্জাতিক নৌ-শ্রমিক কনভেনশনের (এমএলসি) পরিপন্থী। এমএলসি অনুসারে, ডাঙ্গায় অবতরণের ছুটি বা বিরতি না দিয়ে কোনো অবস্থাতেই সমুদ্রচারী কর্মীদের ১১ মাসের বেশি সময় জাহাজে রাখা যাবে না।
আইটিএফের অব্যাহত চাপের মুখে গত জুনে এক ডজনের বেশি কিছু দেশ সমুদ্রচারী নাবিক ও মালবাহী জাহাজের ক্রুদের অতি-প্রয়োজনীয় কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। নাবিকদের ঘরে ফেরানোর লক্ষ্যে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতেই তারা এ ঘোষণা দেয়।
কিন্তু, এরপরই গত ১৬ জুলাই আইটিএফ জানায়, ঘোষণার পর থেকে অধিকাংশ দেশের সরকার এখনও প্রকৃতপক্ষে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এবং তাদের পদক্ষেপগুলি প্রয়োজন অনুসারে যথেষ্ট দ্রুতও নয়।
জাহাজ মালিকানা সংস্থার চাপ ও বেতন কর্তনের ভয়ে অনেক নাবিক বিজনেস ইনসাইডারের সঙ্গে প্রকৃত পরিস্থিতি নিয়ে সরাসরি কথা বলতে ভয় পেয়েছেন। তবে আইটিএফ এবং দ্য মিশন টু সিফেয়ারার্স- নামের একটি খ্রিস্টীয় দাতব্য সংস্থা এ ব্যাপারে মার্কিন গণমাধ্যমটিকে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে সহায়তা করে। সংগঠন দুটির সঙ্গে জাহাজে অবস্থানরত নাবিকদের সরাসরি ও নিয়মিত সংযোগ থাকায় তারা নাবিকদের বর্তমান অভিজ্ঞতার তথ্য দিয়ে সাহায্য করে। যদিও, নাবিকদের সুরক্ষার কথা আমলে নিয়ে তাদের নাম প্রকাশ করেনি তারা।
লকডাউনের সময় স্থলভাগে অবস্থানকারীদের কাছে মনে হয়েছে; সবকিছু যেন থেমে গেছে। হারিয়ে গেছে জনপদের কর্মচাঞ্চল্য আর প্রাণস্পন্দন।
সমুদ্রে কিন্তু ছিল এর বিপরীত চিত্র। শক্তি উৎপাদনের জন্য জ্বালানি তেল, সুপারমার্কেটের তাকগুলো ভরাতে প্রয়োজনীয় রসদ, হাসপাতালগুলোয় দরকারি চিকিৎসা সামগ্রী আসা অব্যাহত ছিল; সমুদ্রপথে বাণিজ্যের কল্যাণে। আর ঠিক একারণেই বিশ্ব চাহিদা পূরণে বাধ্য হয়েই কাজ করে গেছেন জাহাজের কর্মীরা।
মিশন টু সিফেয়ারার্স জানায়, লকডাউনের প্রাথমিক পর্যায়ে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের বেশি বেশি পণ্য কিনে, সুপারমার্কেটগুলো খালি করার সংবাদ পড়ে নাবিকেরাও চিন্তাগ্রস্ত হতেন। তবে তারা এই ভেবে সান্তনা পেতেন যে, তাদের ত্যাগের বিনিময়ে পণ্যের অভাবে পড়তে হচ্ছে না বিশ্ববাসীকে। নিজেদের সাধ্যের সবটুকু দিয়েই তারা চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এটাই ছিল তাদের কাছে গৌরবের।
গত মার্চে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক শেষে সংস্থাটির প্রস্তুতকৃত সিফেয়ারার্স হ্যাপিনেস ইনডেক্স সূচক প্রতিবেদন সূচনায় একথা উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু মহামারি পরিক্রমার সঙ্গে সঙ্গে পণ্য সরবরাহের ধারবাহিক কাজের চাপ মানবিক দিক থেকে গভীরতর সঙ্কট সূচনা করেছে বলে জানায় আইটিএফ। সংস্থাটির জুন প্রতিবেদনে একে মানবিক সঙ্কট হিসেবেই উল্লেখ করা হয়।
''মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি আর বাঁচব না''
গত মে'র শেষ নাগাদ মোট ৮৬৭ জন নাবিক ও বাণিজ্যিক জাহাজের কর্মীর মধ্যে এক জরিপ পরিচালনা করে আইটিএফ। অংশগ্রহণকারীদের সকলেই ছিলেন জোর করে চুক্তিপত্রে নির্ধারিত সময় বৃদ্ধি করার ফলে জাহাজে কাজ করতে বাধ্য হওয়া সমুদ্রচারী। এদের মধ্যে আবার ৫ শতাংশ জানান, অতিরিক্ত সময় সাগরে কাজ করতে হলেও, সেজন্য তাদের মজুরি দেওয়া হচ্ছে না।
বেশিরভাগ নাবিকই উল্লেখ করেছেন মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি, পরিবার-পরিজনের অভাব অনুভব করার মতো বিষয়কে। অনেকে নিজেদের অবস্থাকে কারাবাস বা দাসত্বের সঙ্গে তুলনা করেন।
সাগরে চারমাস আটকে পড়া সুইডেনের এক নাবিক বলেন, ''কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়িয়েছে এমন একটি কারখানার দরজায় তালা লাগিয়ে আপনি কি সেখানকার সব কর্মীকে আটকে রাখবেন? সেটা কি আইসোলেশনের জন্য সঠিক উপায় হবে? আপনি যদি কোনো নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক না হন, তাহলে নিজের বিবেচনাতেও একে ঠাঁই দেবেন না।''
জাহাজে সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার সুবিধা আরেক সমস্যা। এমা মায়েরস্ক' নামের এক জাহাজের ক্যাপ্টেন চিকিৎসক নন, তবু বাধ্য হয়েই আর্থারাইটিস বা হাড়ের ব্যথায় আক্রান্তদের চিকিৎসা করছেন। আবার দন্ত চিকিৎসার পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা স্বত্বেও একজন ক্রু'র দুইটি ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত টেনে তুলে ফেলতে হয় তাকে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক কার্গোবাহী জাহাজ বহরের মালিকানা প্রতিষ্ঠান মায়েরস্ক জানায়, জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন হলে আগে নাবিকদের হেলিকপ্টারে করে নিকটবর্তী হাসপাতালে স্থানান্তর করা হতো। তবে তাদের সকল জাহাজের ক্যাপ্টেনরাই বর্তমানের মতো জরুরি পরিস্থিতিতে কাজ চালানোর মতো প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেওয়ার প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন।
শেষ মুহূর্তে প্রিয়জনদের কাছে না থাকাটাও ভয়ঙ্কর কষ্টের। দুজন নাবিকের অভিজ্ঞতা এমনই। দায়িত্বপালনের সময় তাদের দুজনরেই নিকটজন মারা যান সুদূর স্থলভাগে।
এদের মধ্যে একজন ইন্দোনেশীয় নাবিক বলেন ''যে কষ্টের মধ্যে দিয়ে গেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। গত নয়মাসে অসংখ্যবার মনে হয়েছে, আমি নিজেও বুঝি আর বাঁচব না।''
একবছর ধরে জাহাজে অবস্থানকারী মিশরীয় এক নাবিক বলেন, ''দীর্ঘচুক্তির কারণে যে অবসাদ দেখা দিয়েছে, আমার ধারণা একারণে যেকোনো মুহূর্তে আত্মহত্যা করে বসতে পারি। এভাবে বন্দি হয়ে- জীবনের কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছি না আমি।''
- সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার