সামাজিক নিরাপত্তার ভাতা বাড়েনি, দরিদ্রদের সামনে কী অপেক্ষা করছে?
দেশে মূল্যস্ফীতির আঁচ চড়া, হু হু করে বাড়ছে জিনিসপত্রের দামও। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত অতি-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাতা বাড়বে না আগামী অর্থবছরে।
গতকাল ঘোষিত আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অবশ্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় নতুন করে প্রায় ১০ লাখ উপকারভোগী যুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে। এরমধ্যে অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ৩ লাখ ৩৪ হাজার; ২ লাখ বয়স্ক ও ২ লাখ বিধবা ভাতার আওতায় আসবেন।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শুধু উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মাসিক উপবৃত্তির পরিমাণ ৯০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১,০৫০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর বাইরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সুবিধাভোগী কারও ভাতা বাড়ছে না।
এ ছাড়া ভর্তুকি মূল্যে খোলা বাজারে পণ্য বিক্রির (ওএমএস) কার্যক্রমে বরাদ্দ, চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ৫ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার চেয়ে কমিয়ে ২,০০৪ কোটি টাকা করা হয়েছে।
সম্প্রতি বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু টিসিবির আওতায় ভর্তুকি মূল্যে আরও বেশি পণ্য বিক্রির পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন, তবে বাজেট বক্তব্যে এবিষয়ে তেমন কিছু বলেননি অর্থমন্ত্রী।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, মূল্যস্ফীতির বিদ্যমান বাস্তবতায়– প্রতিবন্ধী, বয়স্ক নাগরিক, বিধবা, দুঃস্থ চা শ্রমিক ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মতো– অস্বচ্ছল শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আগামী অর্থবছরে আরো বাড়বে। বাড়বে অভাব-অনটন।
এর জাতীয় নির্বাচনের আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকার বয়স্ক ও বিধবাদের ভাতা ৫০ থেকে ১০০ টাকা বাড়িয়েছিল। ফলে বর্তমানে তাঁরা প্রতি মাসে যথাক্রমে ৬০০ ও ৫৫০ টাকা করে পাচ্ছেন।
ওই সময়ের পর থেকে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ, অর্থমন্ত্রণালয়ও নতুন অর্থবছরে সাড়ে ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলন করেছে, কিন্তু তবুও তাঁদের ভাতা অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-র বর্তমান মূল্যতালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একটি ডিম এবং তিন-চার কেজি মোটা চাল কিনতেই শেষ হয়ে যায় ভাতার টাকা।
সামগ্রিকভাবে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ ৯ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা বাড়িয়ে এক লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা করা হচ্ছে আগামী অর্থবছরে। তবে এর বেশিরভাগই যাবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশনে, যার ব্যয় ৯ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা বেড়ে ৩৬ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা হবে।
অর্থবিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "গত বছর ভাতা বাড়ানোর পর থেকে দেশে ব্যাপকভাবে মূল্যস্ফীতি হয়েছে। আগামী অর্থবছরও মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নামিয়ে আনা যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। তাই সামাজিক নিরাপত্তার উপকারভোগীদের ভাতার পরিমাণ না বাড়ালে– অতি-দরিদ্রদের জন্য দিনাতিপাত করা কষ্টকর হবে।"
তিনি আরো বলেন, "শিক্ষা ও চিকিৎসা খরচ বাড়লে তা দরিদ্রদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। "এতে দরিদ্র পরিবারগুলোর সন্তানরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়ে এবং অনেকে গুরুতর অসুস্থ না হলে চিকিৎসা সেবাও নেন না। খাদ্য ব্যয় জোগাড় করতে গিয়ে তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয় কাঁটছাঁট করে।"
স্বাস্থ্য ব্যয়েও দরিদ্রের জন্য বোঝা
রেফারেল হাসপাতালগুলো এতোদিন ১ শতাংশ শুল্কে যন্ত্রপাতি আমদানি করার সুযোগ পেলেও– আগামী অর্থবছর থেকে তাদের ১০ শতাংশ হারে শুল্ককর পরিশোধ করতে হবে। দেশের এ ধরণের হাসপাতালগুলোতে সাধারণত দরিদ্র জনগোষ্ঠী, নিম্নবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা চিকিৎসা সেবা নিয়ে থাকেন। ফলে তাদের চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির ৫ শতাংশ ব্যয় করার সুপারিশ থাকলেও– উন্নত দেশগুলো এখাতে জিডিপির ৮ শতাংশের মতো ব্যয় করে থাকে।
প্রতিবছর স্বাস্থ্যখাতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হলেও বাংলাদেশে এখাতে ব্যয় ১ শতাংশেরও কম। এবছরও স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ মাত্র ৩ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা বাড়ানো হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যয়ের বড় একটি অংশ সেবাগ্রহীতার পকেট থেকে যায়। সরকার থেকে খরচের পরও সেবাগ্রহীতা নিজ পকেট থেকে যে অর্থ ব্যয় করেন, তাকে আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার বা বাড়তি খরচ বলা হয়। বাংলাদেশে এটি প্রায় ৬৭ শতাংশ, যদিও ২০৩২ সাল নাগাদ এটি ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
এদিকে, আগামী অর্থবছর এমপিওভূক্ত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আমানতের সুদের ওপর করহার দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এর প্রভাবে শিক্ষার্থীর শিক্ষা খরচও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সামগ্রিকভাবে শিক্ষাখাতে মাত্র ৫ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ছে।