আদর কেড়ে নিতে জানে ইস্কাটন গার্ডেনের আদুরী
সাদার মধ্যে বাদামী ছাপ, সবসময় হাসিখুশি, বিনীত আহ্লাদি চেহারার কুকুরটাকে দেখলে প্রথমেই যে নামটা মনে আসে, তার সেই নামই দিলেন সেলিম স্যার। আদুরী। সে বুঝুক না বুঝুক, আমরা তাকে 'আদুরী'ই ডাকি।
ইস্কাটন গার্ডেনে আমাদের অফিসের গলিতে তার নিবাস ও বিচরণ। মুসার মনোহরী দোকান, ফুটপাতে রানার চায়ের টং দোকান, তারপরে হায়দারের চায়ের দোকানের যারা খদ্দের— আদুরীকে তাদের চোখে পড়বেই। সে নীরবে তাকাবে, কারো দৃষ্টিতে একটু প্রশ্রয় দেখলে, কেউ একটু ইশারা-ইঙ্গিতে ডাকলে সে হাসিমুখে এগিয়ে আসবে। তবে তাকে আপ্যায়ন করা একটু কঠিন। কেউ একটা বিস্কুট দিলেই যে নেবে, তা নয়। তার পছন্দ আছে, দোকানী জানে সে 'ড্রাই কেক' ছাড়া অন্য বিস্কুট খায় না। আবার তার আত্মসম্মান বোধও প্রখর। ছুঁড়ে দিলে বা নীচে ফেলে দিলে সাথে সাথে মুখে নেয়না। নিরাসক্তভাবে সরে যায়। তাকে নিয়ে এতো আদিখ্যেতা নেই দোকানীর। সে জানায়— এটা ঢং, একটু পরে এসে ঠিকই খাবে।
টং দোকানের খদ্দেররা প্রতিদিনের চেনামুখ, আশেপাশের অফিসের লোকজন, রিকশা বা সিএনজিচালক। এদের অনেককেই আদুরী চেনে, কাছে এসে অভিবাদন জানায়, আনুগত্য প্রকাশ করে। খদ্দেরদের কেউ কেউ একটু বেশি আপন আদুরীর। তাদের কাছে তার আবদারও বেশি।
আমাদের অফিসের তরীকে দেখি হাতে তুলে বিস্কুট খাইয়ে দেয় ভেঙ্গে ভেঙ্গে। না খেতে চাইলে বকাও দেয়। এসব দোকানে আর কিই বা পাওয়া যায়। ওই এক ড্রাই কেক, মাঝে মাঝে বড় জোর এক পিস কেক। মানুষের মুখরোচক এসব স্ন্যাকস কাঁহাতক ভালো লাগে! এগুলো কি তার খাবার? তবু তার কাছে তো বিকল্প নেই। অরুচি হলেও একসময় খেয়ে নেয়, ক্ষুধা মেটায়। অফিস বন্ধ থাকলে, বা দোকান বন্ধ থাকলে তো এও জোটে না।
কিন্তু আদুরী যে তার খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, তা মনে হয় না। চোখে মুখে তার হাসি লেগেই থাকে। তার সুখী তৃপ্ত চেহারা দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। তার 'ফ্যান -ফলোয়ার'ও নেহাত কম নয়। তাদের উপস্থিতি নিমেষেই টের পায় সে। দুপুরে বা রাতে ফুটপাতে বা পাশের ভবনের গ্যারেজের মুখে ঘুমিয়ে আছে, পাশ দিয়ে তার 'আপন' কেউ হেঁটে গেলে জেগে উঠে সে, গা ঝাড়া দিয়ে দৌঁড়ে আসে আনুগত্য জানাতে। তার এই ছুটে আসা যে শুধুই খাবারের আশায় তা নয়। মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলেই সে সরে যায়। মানুষের ব্যস্ততা হয়তো সে বুঝতে পারে, কখনো কখনো 'আপন' জনের 'মুড' ও হয়তো বুঝে নেয়। তখন আর পিছু নেয় না।
শুধু পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই নয়, হঠাৎ মোটরসাইকেলের পেছনেও ছুটতে শুরু করে সে। পেছনের সিটে বসা নারীটি হাত বাড়িয়ে একটু ছুঁয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো অথবা হাত নাড়ালো। আদুরীও থেমে যায়, নিজের মতো করে বুঝে নেয় শুভেচ্ছা বিনিময়ের ভাষা। হয়তো মাঝে মাঝে বিস্কুট খেতে দেয়, একটু আদর করে— আদুরী তাকে চিনে রেখেছে, মোটরসাইকেলের পেছনে তাই ছুটে গিয়েছে।
সে গাড়ির পেছনেও ছুটে আসে। সে কি গাড়ির রং চিনতে পারে? একই রংয়ের তো আরো গাড়ি আছে। সব গাড়ির পেছনে তো সে যায় না। তাহলে কি সে নেম-প্লেট দেখে চিনতে পারে? নাকি চেনা মানুষদের গাড়িরও গন্ধ আলাদা করতে পারে সে?
আদুরীকে আদর করতে কুকুরপ্রেমী হতে হয় না। ও নিজেই আদর কেড়ে নেয়। তার চাউনি, তার সুখী চেহারা, তার শিষ্টাচার সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আদুরীরা তো বেশি কিছু চায় না। একটু খাবার, একটু ভালোবাসা, অন্তত একটু নিরাপত্তা। তাও মেলে কই।
এই যে নিরীহ, নির্বিবাদী আদুরী– কখনো কাউকে ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসে না, দূরে দাঁড়িয়ে নীরব সম্ভাষণ জানায়, সেই আদুরীরও লেজটা কাটা। তার আনন্দ আর আনুগত্য প্রকাশের এই অঙ্গটি নেই; তার জন্য তার কি দুঃখ হয় না? হয়তো হয়।
কুকুররা হাজার হাজার বছর ধরেই মানুষের সাথে বসবাস করছে। অনাহুত হলেও তারা মানুষকে ছেড়ে যায় না। সে তো নিজের খাবার নিজে তৈরি করতে পারে না। উচ্ছিষ্টাংশ খেয়ে বেঁচে থাকে অনাদরে, অবহেলায়, রাস্তায়, বাজারে, গলিতে। সহস্র বছরের বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে একটু নিরাপত্তা আদুরীরা আশা করতেই পারে।