বন্যায় ব্যাহত চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ চেইন; স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্য ও পণ্য পরিবহন
চলমান বন্যায় গত চারদিন ধরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ায় রাজধানী ও বন্দরনগরীর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে।
চাল, পেঁয়াজ, তেল, আটা, রসুন, মশলা এবং মসুর ডালের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য বিভিন্ন জেলায় না যেতে পারায় চট্টগ্রামে দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ চেইন প্রায় ভেঙে পড়েছে।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আগে থেকেই বিলম্বের মুখে পড়া চট্টগ্রাম বন্দর এখন বন্যার কারণে আরও ভয়াবহ আমদানি-রপ্তানি সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
পোশাক রপ্তানিকারকেরা পণ্য পৌঁছানোর সময়সীমা পূরণের জন্য চাপে রয়েছেন। তারা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, দ্রুত কোনো সমাধান না পাওয়া গেলে সরবরাহ চেইনের পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও রেল যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গত দুদিন ধরে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বা অন্য রুটে কোনো পণ্যবাহী যান চলাচল করতে পারছে না।
২৩ আগস্ট রাত থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি যানবাহন আটকা পড়েছে। বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণবাহী ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহনও আটকে আছে।
আটকে থাকা এসব যানবাহন থেকে চুরি ও লুটপাটের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
সেনাবাহিনীর সহায়তা চান পোশাক রপ্তানিকারকেরা
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, বিশেষ করে ফেনীর কাছে লেমুয়া সেতু দিয়ে পণ্য পরিবহন নিয়ে রপ্তানিকারকেরা উদ্বিগ্ন।
তিনি বলেন, সেতুটির অবস্থা মূল্যায়নের জন্য তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের কাছে সহায়তার অনুরোধ করেছেন।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিজিএমইএর একজন পরিচালক নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং দ্রুত সমাধানের জন্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। রপ্তানি পণ্য, আমদানি ও কাঁচামালবোঝাই এক হাজারের বেশি ট্রাক বর্তমানে মহাসড়কে আটকা পড়েছে।
'আমাদের পণ্য রপ্তানির ডেডলাইন পার হয়ে যাচ্ছে,' বলেন রফিকুল ইসলাম।
লিফ গ্রেড ক্যাজুয়ালওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ এরশাদ উদ্দিন বলেন, গত দুদিন ধরে তাদের রপ্তানি পণ্যের দুটি কনটেইনার সড়কে এবং আমদানি করা কাঁচামালের ৩টি ট্রাক বন্দরে আটকে আছে।
'জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি হওয়ায় আমরা আমাদের চীনা কারখানা থেকে আমদানি করা উপকরণের ওপর নির্ভর করি। এ দেরি আমাদের চালানের সময়সীমায় প্রভাব ফেলতে পারে,' বলেন তিনি। তাদের সাধারণত ডেনিম পণ্যের জন্য ন্যূনতম ৪৫ দিনের লিড টাইম প্রয়োজন বলে জানান তিনি।
মাসকো গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক এটিএম মাহবুবুল আলম মিল্টন জানান, তাদের ৭০টিরও বেশি ট্রাক বিভিন্ন স্থানে আটকা পড়েছে — এর মধ্যে বন্দরে ১৭টি, মহাসড়কে ৪টি এবং তাদের কারখানায় ৪৯টি ট্রাক আটকে আছে।
মহাসড়কে আটকে থাকা রপ্তানিবোঝাই ট্রাকের নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিজিএমইএর কয়েকজন সদস্য।
এদিকে কুমিল্লা ইপিজেড কর্তৃপক্ষ শনিবার থেকে তিনদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে বলে শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
আকস্মিক বন্যায় ইপিজেডের সমস্ত সড়ক যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়েছে এবং পানি শোধনাগার উপচে পড়ে পানির সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানান তারা।
বিটোপি গ্রুপের প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম আজাদ বলেন, এ বন্ধের ফলে ইপিজেডে তাদের কারখানার অন্তত তিন কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে।
বন্দর থেকে ডেলিভারিতে ভোগান্তি
কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রতিদিন গড়ে প্রায় চার হাজার টিইইউস কনটেইনার ডেলিভারি হয়। তবে ২১-২২ আগস্ট ডেলিভারি ৩,৯০০ টিইইউ-এ নেমে এসেছে। তারপর থেকে এ সংখ্যা ১,০০০ টিইইউ-এর নিচে নেমে গেছে।
চট্টগ্রাম সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের বন্দর বিষয়ক সম্পাদক লিয়াকত আলী বলেন, সড়কে যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে, হাজার হাজার যানবাহন আটকা পড়েছে। পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রাকের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।
'এমন পরিস্থিতিতে আমরা যানবাহন পাচ্ছি না,' তিনি বলেন। 'আমদানিকৃত পণ্য সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরেও ট্রাকের অভাবে এসব পণ্য বন্দরে আটকে আছে।'
এছাড়া যানবাহনের স্বল্পতার কারণে পণ্য পরিবহনের খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে বলেও জানান তিনি।
রপ্তানি পণ্যের ট্রাক কমছে
তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি পণ্যগুলো সাধারণত বন্দরে নিয়ে যাওয়ার আগে চট্টগ্রামের বেসরকারি ডিপোতে কনটেইনারে লোড করা হয়। চট্টগ্রামের ১৯টি ডিপোতে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন হাজার ট্রাক এসব পণ্য পৌঁছে দেয়।
তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, শনিবার (২৪ আগস্ট) সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় মাত্র ৯৮৫ ট্রাক পণ্য এসেছে, যা আগের দিনের তুলনায় ৭২ শতাংশ কম।
কম পণ্য আসা সত্ত্বেও বন্দরে কনটেইনার পাঠানোয় এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি এবং রপ্তানি কনটেইনার-জট হ্রাস পেয়েছে।
ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব রুহুল আমিন সিকদার বলেন, সাধারণত ১৯টি ডিপোতে প্রায় ৮ হাজার রপ্তানি কনটেইনার থাকে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় এ সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ১৬ আগস্ট কন্টেইনারের সংখ্যা ১৫ হাজার ৭৫ টিইইউতে পৌঁছায়। ২৪ আগস্টের হিসেব পর্যান্ত ডিপোগুলোতে ১১ হাজার ৩৫টি রপ্তানি কন্টেইনার রয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় তিন হাজার টিইইউ বেশি।
খাতুনগঞ্জে ব্যবসা কমেছে ৭০ শতাংশ
ব্যবসায়ীদের মতে, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে লেনদেন অন্তত ৭০ শতাংশ কমেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বিভিন্ন স্থানের পণ্য আটকে থাকায় পাইকারদের পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক জামাল হোসেন বলেন, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার দোকান, গুদাম ও ডিপোতে প্রায় এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়।
তবে গত চারদিনে লেনদেন অন্তত তিন হাজার কোটি টাকা কমেছে বলে জানান তিনি।
চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ গুদাম ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি সোলায়মান বাদশা বলেন, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ ও আসাদগঞ্জে সাধারণত প্রতিদিন ২৫০-৩০০ ট্রাক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করে।
তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকায় পার্বত্যাঞ্চল ও কক্সবাজার ছাড়া সব জেলার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে।
'যদিও ত্রাণের শুকনা খাবারের বিক্রি বেড়েছে, বাজারের সামগ্রিক কার্যক্রম ৬০-৭০ শতাংশ কমে গেছে,' বলেন তিনি।
শুকনা খাবারের দাম বেড়েছে
খাতুনগঞ্জে বন্যার ত্রাণ সামগ্রী যেমন চিড়া, মুড়ি, গুড়, বিস্কুট, মোমবাতি, ম্যাচ, ওরস্যালাইন, বোতলজাত পানি, লাইফ জ্যাকেটের চাহিদা বেড়েছে।
ফলে চিড়ার পাইকারি দাম প্রতি ২৫ কেজি বস্তায় ১,০০০ টাকা থেকে বেড়ে দ্বিগুণ ২,১০০ টাকা পর্যন্ত হয়েছে এবং মুড়ি প্রতি কেজিতে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী আজিজুল হক বলেন, 'শুকনা খাবার বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় অসাধু বিক্রেতারা অন্যায্যভাবে দাম বাড়িয়েছেন। অতিরিক্ত দাম নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী গতকাল বেশ কয়েকজন বিক্রেতাকে চার লাখ টাকা জরিমানা করেছে। কিন্তু এরপর আজ আবার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।'
এ ছাড়া আরেক ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জানান, গত তিনদিনে ৫০ কেজির বস্তা চালের দাম ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।