মাস্ক কি একটি দুর্বল টিকার সমান সুরক্ষা দিতে পারবে?
বাজারে একটি নিরাপদ ও কার্যকর কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন আসার দিন গুনছে বিশ্ব। এ অবস্থায় একদল বিজ্ঞানী আশ্চর্য এক তত্ত্ব উত্থাপন করেছেন। তারা বলছেন; মাস্ক প্রাথমিকভাবে হলেও মানুষকে জীবাণু প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।
মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে উঠতেও এটি ভূমিকা রাখতে পারে, এমন ইঙ্গিত দেন তারা।
তত্ত্বটি এখনও অপ্রমাণিত। গত মঙ্গলবার এ প্রস্তাবনা করা হয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিখ্যাত সাময়িকী- নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে লেখা এক মত বিনিময়মূলক নিবন্ধে। বিজ্ঞানীরা অবশ্য যুগান্তকারী কিছু বলছেন না। বরং অত্যন্ত পুরোনো একটি ধারণাকেই নতুনভাবে চলমান মহামারির বাস্তবতায় সামনে এনেছেন।
ভেরিওলেশন- বা সীমিত মাত্রায় জীবাণুর সংস্পর্শে আসতে আসতে এক সময় দেহে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হওয়ার এ ধারণা অনেক প্রাচীন। সর্বপ্রথম গুটিবসন্ত জীবাণুর মোকাবিলায় এ তত্ত্বটি উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু, অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই এর চর্চা বাতিল করে দেন। আধুনিক টিকা পদ্ধতি আবিষ্কারের পেছনে অবশ্য এ তত্ত্ব সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু, বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে আর এতদিন নজর দেননি বিজ্ঞানীরা।
মাস্ক পড়ে ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকির মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে ওঠা- কোনোভাবেই ফলপ্রসূ টিকার সমান সুরক্ষা দিতে পারে না। কিন্তু, গবেষণাগারে করোনাভাইরাস সংক্রমিত করা প্রাণিদেহের তথ্য এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের পূর্বাপর গবেষণা এ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে; মাস্ক পড়লে বায়ুবাহিত জীবাণুর শ্বাসযন্ত্রে প্রবেশ অনেকাংশে হ্রাস পায়। পরিধানকারী ওই ব্যক্তি যদি সকল প্রকার সাবধানতা অবলম্বন করতে থাকেন, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখেন, অর্থাৎ জীবাণু সংক্রমণের অন্যান্য উপায়গুলো এড়িয়ে চলতে থাকেন- তাহলে তার শ্বাসযন্ত্রে সীমিত সংখ্যায় প্রবেশ করা ভাইরাস মোকাবিলায়- রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা উদ্দীপ্ত হবে। এবং এক সময় লড়াকু কোষের স্থায়ী সুরক্ষা ব্যূহও গড়ে তুলবে- এমন সংস্পর্শ।
এর অর্থ হলো; দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অনেক কম মাত্রায় ভাইরাসের নিয়মিত সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি কৌশল তৈরি করে ফেলবে। নির্দিষ্ট ওই জীবাণু পরবর্তীতে সংক্রমণ ঝুঁকি তৈরি করতেও পারবে না- এমনটাই প্রস্তাব করছেন বিজ্ঞানীরা।
নিবন্ধের অন্যতম লেখক এবং ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ডা. মনিকা গান্ধি বলেন, 'এই তথ্যের আলোকে আমরা প্রস্তাব করেছি যে, নিয়মিত মাস্ক ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে যদি উপসর্গহীন সংক্রমিতের হার বাড়ানো যায়, তাহলে সম্ভবত বিপুল সংখ্যক মানুষের দেহে প্রাকৃতিক সুরক্ষা কবচ তৈরি হবে।'
অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, মাস্ক পড়ে মানুষকে ইচ্ছে করে সংক্রমিত হওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে চলাচল করতে হবে। ডা. গান্ধি বলেন, 'এমনটা আমরা মোটেও করার পরামর্শ দিচ্ছি না। গুটিবসন্ত মোকাবিলায় যারা এ তত্ত্বটি প্রথম উপস্থাপন করেছিলেন, তারাও একথা বলেননি।' এর মধ্য দিয়ে তিনি সামাজিক অনুষ্ঠান বা একসঙ্গে অনেকের মেলামেশার সম্ভাবনা তৈরি করে; এমন ঘটনা থেকে সবাইকে যথাসম্ভব দূরে থাকার পরামর্শ দেন।
এদিকে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিজ্ঞানীদের দেওয়া মাস্ক বিষয়ক তত্ত্বটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়া প্রমাণের উপায় নেই। মানবদেহে করা এমন পরীক্ষায়; দেখতে হবে যে- মাস্ক পরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতিতে মানবদেহে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এবং মাস্ক না পরাদের মধ্যেই বা কীভাবে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে। অর্থাৎ, জেনেশুনে স্বেচ্ছাসেবীদের ভাইরাসের সম্মুখীন করা হবে- চিকিৎসা বিজ্ঞানে যা সম্পূর্ণ এক নিন্দিত ও নিষিদ্ধ এক চর্চা।
অবশ্য, করোনা মোকাবিলায় দেওয়া এ তত্ত্ব ইতোমধ্যেই বাইরে অন্য বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। কিন্তু, আরও তথ্য এবং সতর্ক বিশ্লেষণ ছাড়া তারা এটি সম্পূর্ণ গ্রহণ করবেন না।
'একধাপে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া মনে হচ্ছে একে' বলছিলেন মহামারি সৃষ্টিকারী রোগ বিশেষজ্ঞ সাস্কিয়া পপেস্কু। তিনি বলেন, 'এই মুহূর্তে আমাদের কাছে এটি সমর্থন করার যথেষ্ট উপায় নেই, তবে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি যে এর আছে- তা অস্বীকার করাও যায় না।'
তবে তত্ত্বটির ভুল অনুবাদের ঝুঁকিও কম নয়। মানুষ যদি ধরেই নেয় যে, মাস্ক পড়ার মাধ্যমে তারা স্থায়ী সুরক্ষার দিকে এগিয়ে যাবেন- তাহলে তা হবে মারাত্মক। এরফলে তারা আগের চাইতেও বড় বিপজ্জনক পথে হাঁটবেন। কিছুদিন ব্যবহারের পর প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে ভেবে- মাস্ক ব্যবহারই পরিত্যাগ করতে পারেন অনেকে।
ডা. পপেস্কু বলেন, 'মানুষ সকল প্রকার স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলুক ও সতর্কতার কৌশল অবলম্বন ধরে রাখুক- আমরা সেটাই চাই।' এর মানে হচ্ছে; ভিড় এড়িয়ে চলা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, পরিচ্ছন্ন থাকার স্বভাব থেকে সরে আসা যাবে না। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা প্রাকৃতিক মাধ্যম থেকে তৈরি হওয়াটা একটি দীর্ঘ ও অনিশ্চিত প্রক্রিয়া। এসময় মোটেই অসাবধান হওয়ার সুযোগ নেই, বলেও জানান এ বিশেষজ্ঞ।
তাছাড়া, করোনাভাইরাস ভাইরোলেশনের সাম্প্রতিক তত্ত্বের অনুমান নির্ভর করছে দুটি বিষয়ের উপর, যা প্রমাণ করাও বেশ কঠিন। যেমন এখানে অনুমান করা হয়েছে; নিম্ন মাত্রায় ভাইরাসের সংস্পর্শে দুর্বল ধরনের কোভিড-১৯ সংক্রমণ দেখা দেবে। আর অনুমান করা হয়; মৃদু সংক্রমিত হলে পরবর্তীতে জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। অন্য কিছু রোগের জীবাণুর ক্ষেত্রে এমন ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেলেও, এপর্যন্ত করোনাভাইরাস সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য-প্রমাণ মেলেনি।
প্রাণঘাতি একটি জীবাণুর জীবন এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনেক জানতে সময় প্রয়োজন। সে তুলনায় বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন আট মাসের মতো সময়, যা সবকিছু জেনে ফেলার মতো যথেষ্ট নয়। একারণেই, সার্স কোভ-২ জীবাণুর ব্যাপারে এখনও অনেক কিছু অজানা রয়ে গেছে। তাই বিজ্ঞানীরা আরও নতুন তথ্য পাওয়ার আগ পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ তত্ত্বটি নিয়ে খুব বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছেন না।