এলএনজি আমদানির জন্য বাংলাদেশকে কম সুদে ৩৫ কোটি ডলার ঋণ গ্যারান্টির প্রস্তাব বিশ্বব্যাংকের
তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য বাংলাদেশকে ৩৫ কোটি ডলারের ঋণ গ্যারান্টির প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বর্তমান বৈদেশিক অর্থায়নগুলোর চেয়ে এই ঋণের শর্ত অনেকটাই সহজ হবে। এতে ২০২৫ সালজুড়ে দেশের দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানির প্রয়োজন মেটাতে নতুন একটি দ্বার উন্মোচন হবে।
'রিভলভিং লেটার অব ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি' নামে এই ঋণ গ্যারান্টির প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের একটি সংস্থা- মাল্টিলেটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি (মিগা)। সংস্থাটি পেট্রোবাংলার পক্ষে দেশি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর জারি করা এলসি বা ঋণপত্রে ১০০ শতাংশ গ্যারান্টি দেবে, যার সুবাদে নিরাপদ ও কার্যকরভাবে এলএনজি সরবরাহ নিশ্চিত হবে।
এই প্রস্তাব সম্বলিত একটি নথি সরকারকে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক, যা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে এসেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, এলএনজি আমদানির জন্য বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) যে হারে সুদ নেয়—এই ঋণ গ্যারান্টি তার চেয়েও এক শতাংশীয় পয়েন্ট কম হবে।
প্রস্তাবে ঋণ গ্যারান্টি ৩৫ কোটি ডলারের চেয়েও বেশি করার সুযোগ রয়েছে, তবে সেক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের কাভারেজ কম থাকবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান এ বিষয়ে টিবিএসকে বলেন, "মিগার প্রস্তাবটি আমরা ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছি। কারণ সুদহার কম ও ঋণ পরিশোধের মেয়াদও বেশি। এতে সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধ সহজ হবে।"
তিনি আরও বলেন, চুক্তি বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) কাজ করছে। গ্যারান্টির পরিমাণ ও কবে নাগাদ এই প্রস্তাবটি চুক্তিতে কার্যকর করা যায়— সেটি ইআরডি ঠিক করবে।
ইআরডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাখ্যা করেন, রিভলভিং লেটার অব ক্রেডিট হচ্ছে এক ধরনের ব্যাংক গ্যারান্টি— যা কোনো ক্রেতাকে প্রতিবার নতুন গ্যারান্টির প্রয়োজন ছাড়াই পণ্য বা পরিষেবার জন্য একাধিক পেমেন্ট করতে দেয়। একবার তহবিলের ব্যবহার সম্পন্ন হলে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্যারান্টি নবায়ন হয়ে যাবে— যাতে ক্রেতা অর্থ পরিশোধ অব্যাহত রাখতে পারে।
তিনি আরও বলেন, 'বর্তমান বাস্তবতায় মিগা'র প্রস্তাবটি ইতিবাচক। এতে বাংলাদেশের এলএনজি আমদানির অর্থায়ন প্রক্রিয়ায় নতুন একটি দ্বার উন্মোচন হবে। তবে বিশ্বব্যাংক যাতে তাদের আপফ্রন্ট ফি এবং গ্যারান্টি ফি আরও কমায় এ বিষয়ে ইআরডির পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হবে।
প্রস্তাবে যা রয়েছে
এই গ্যারান্টির আওতায়, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) এইচএসবিসি, স্ট্যান্ডার্ড চার্ডার্টসহ বিদেশি কয়েকটি ব্যাংকে এলসি খুলতে পারবে। তবে কোন কোন ব্যাংকে এলসি খোলা হবে— তা চুড়ান্ত হবে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ সম্মতিতে।
পাশাপাশি এসব এলসির বিপরীতে পেট্রোবাংলা ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিতে পারবে। এলসির মেয়াদ থাকবে ৩ মাস, আর ব্যাংকের ঋণের অর্থ পরিশোধের মেয়াদ হবে ৯ মাস।
মিগার এই প্রস্তাবের পরে জ্বালানি বিভাগ গ্যারান্টির পরিমাণ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করার যায় কিনা— সে বিষয়ে ইআরডির সাথে আলোচনা করেছে। পাশাপাশি দেশীয় ব্যাংক থেকে এলসি করা সুযোগও চায় জ্বালানি বিভাগ।
প্রাথমিকভাবে এলএনজি আমদানির জন্য এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তবে ভবিষ্যতে এই গ্যারান্টি জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হতে পারে বলে জানিয়েছে সূত্রগুলো।
এলএনজি আমদানিতে আইটিএফসি থেকে নেওয়া ঋণ
বর্তমানেআন্তর্জাতিক বাজার থেকে এলএনজি, জ্বালানি তেল ও রাসায়নিক সার আমদানিতে একমাত্র ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সহযোগী সংস্থা— আইটিএফসি থেকে ঋণ নেয় বাংলাদেশ। ১৯৭৭ সাল থেকে এই সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে জ্বালানি তেল আমদানি করে আসছে বাংলাদেশ। ২০২৩ সালে এলএনজি আমদানিতেও আইটিএফসি থেকে একই ধরনের ঋণ নেওয়া হয়। এরপর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সার আমদানিতেও — আইটিএফসি থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়ে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ।
২০২৫-২৬ অর্থবছরে জ্বালানি তেল, এলএনজি ও সার আমদানির জন্য আইটিএফসি থেকে সরকার ২৪৫ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেবে। এই ঋণের সুদহার ছয় মাসের সোফর রেটের সাথে আরও ১.৮০ শতাংশ যোগ হবে, আর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ফি হিসেবে যুক্ত হবে আরও শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।
বাংলাদেশে দৈনিক ৩৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। পেট্রোবাংলা সরবরাহ করতে পারছে ২৫০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত। এরমধ্যে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।
পেট্রোবাংলা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৮৩ কার্গো এলএনজি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করছে। এরমধ্যে স্পট মার্কেট থেকে ২৬ কার্গো এবং বাকি ৫৭ কার্গো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে আমদানি করা হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। আর স্পট মার্কেট থেকে আমদানি করা হচ্ছে ২০২০ সাল থেকে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের সুবিধা
বিশ্বব্যাংকের পাঠানো ধারণাপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশেএলএনজি আমদানিতে মিগার গ্যারান্টি সুবিধা নিলে – বর্তমানে আইটিএফসি থেকে ঋণ নিয়ে যে আমদানি করা হচ্ছে, তার তুলনায় আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, তাদের এই গ্যারান্টি ব্যবস্থায় ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের সব ধরনের খরচ বা সুদ হবে সোফর এর সাথে ০.৮৪ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ১.০১ শতাংশ। আপফ্রন্ট ফি হবে .০.৯০ শতাংশ ও গ্যারান্টি ফি ০.৩০ শতাংশ। এই ঋণ ৯ মাস মেয়াদে সরকার পরিশোধ করতে পারবে।
সে তুলনায়, আইটিএফসির ঋণের সুদ সোফর এর সাথে অন্যান্য ফি ও চার্জ মিলিয়ে আরও ২ শতাংশ। আর এই ঋণ পরিশোধ করতে হয় ৬ মাস মেয়াদে।
ফলে বিশ্বব্যাংকের গ্যারান্টিতে সুদহার ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কম লাগবে, আবার ঋণ পরিশোধের মেয়াদও ৩ মাস বেশি পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে দাতাসংস্থাটি।
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এই ঋণ বা গ্যারান্টি সুবিধা পেট্রোবাংলার দীর্ঘমেয়াদি চলতি মূলধন বাড়াবে। পাশাপাশি আগামী ৭ বছর পেট্রোবাংলার দীর্ঘমেয়াদি আমদানিতে চলতি মূলধন নিয়ে সমস্যা হবে না।
ধারণাপত্রে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রতিদিন ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাচ্ছে। কিন্তু সংস্থাটির জন্য বরাদ্দ বা প্রয়োজন দৈনিক ১৪০ কোটি ঘনফুট। চাহিদা অনুযায়ী, গ্যাস না পাওয়ায়— তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অথচ, গ্যাসের তুলনায় তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে কমপক্ষে ৩থেকে সর্বোচ্চ ৬ গুণ খরচ বেশি হয়।
ফলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পেলে, বা গ্যাসভিত্তিক সকল বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে রাখতে পারলে— বছরে ২৫০ কোটি ডলার সাশ্রয় হবে। এমনকি গ্যাসের দাম বেড়ে গেলেও ১৯০ কোটি ডলার সাশ্রয় সম্ভব। পাশাপাশি বিদ্যুতের গড় উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ কমে আসবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম টিবিএসকে বলেন, জ্বালানি যেহেতু আমদানি করতেই হচ্ছে, সেক্ষেত্রে কম খরচে অর্থায়ন সুবিধা পাওয়া গেলে– সরকারের সেটা নেওয়া উচিত। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবটি সরকার ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করতে পারে।
মিগার আগের দেওয়া গ্যারান্টি
মিগা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রকল্প ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে গ্যারান্টি দিয়েছে। বিশেষ করে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল আমদানি ও অন্যান্য কার্যক্রমে গ্যারান্টি রয়েছে।
মিগার গ্যারান্টি দেওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ভোলার ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই প্রকল্পে ৪০৭ মিলিয়ন ডলারের গ্যারান্টি দিয়েছে সংস্থাটি। ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া সার কারখানার জন্য ৩৫৭ মিলিয়ন ডলার গ্যারান্টি দিয়েছে।
মিগা সমর্থিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, সিরাজগঞ্জ ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬৯ মিলিয়ন ডলার, নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানিকে ১৩২ মিলিয়ন ডলার, ঘোড়াশাল রিপাওয়ারিং প্রকল্প (তৃতীয় পর্যায়) ৯৭ মিলিয়ন ডলার এবং সিরাজগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৬৯ মিলিয়ন ডলার।
এছাড়া, আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেডে ২৫১ মিলিয়ন ডলার, এবং সেবা টেলিকম লিমিটেডে ৭৮ মিলিয়ন ডলার গ্যারান্টি দিয়েছে।
জ্বালানি আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের প্রভাব
প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করা জ্বালানি তেল ও এলএনজির মূল্য সময়মত পরিশোধ করতে অনেক সময় সমস্যায় পড়ছে সরকার বা সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো। ফলে আন্তর্জাতিক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের পাওনা সময়মত পরিশোধ হচ্ছে না। যে কারণে সরবরাহকারীরা বাংলাদেশের ওপর আস্থা হারাচ্ছে। আবার পণ্য আমদানিতে বেশি খরচও করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। কখনও কখনও জরিমানার মুখেও পড়ছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, জ্বালানি তেল আমদানি বাবদ সংস্থাটির বৈদেশিক সরবরাহকারীদের কাছে দেনা রয়েছে ৬০ মিলিয়ন ডলার। একইভাবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৈদেশিক সরবরাহকারীদের কাছে পেট্রোবাংলার বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৭০ মিলিয়ন ডলার।
এসব বকেয়া পরিশোধের জন্য জ্বালানি বিভাগ গত বছরের ২৪ নভেম্বর এক চিঠিতে অর্থমন্ত্রণালয়কে এলএনজি আমদানির ভর্তুকি বাবদ কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার অনুরোধ করেছে।
জ্বালানি বিভাগ চিঠিতে বলেছে, নির্ধারিত সময়ে বকেয়া পরিশোধ করা না হলে— দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতার সরবরাহকারীদের এলএনজি সরবরাহ বন্ধ করার আশংকা রয়েছে। অন্যদিকে, স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির দরপত্রে সরবরাহকারীদের অংশগ্রহণ কমতে পারে। পাশাপাশি বকেয়া দেরিতে পরিশোধের কারণে জরিমানা সুদ আরোপ হতে পারে।