যেভাবে বিবর্তনের ফলে বিলুপ্ত হওয়া থেকে ফিরে এল উড়তে অক্ষম এক পাখি
প্রায় ১ লাখ ৩৬ হাজার বছর আগে ভারত মহাসাগরের আলদাবরা অ্যাটল (প্রবাল দ্বীপপুঞ্জ) এক ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। এই বন্যায় সব স্থল প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়। এর মধ্যে ছিল উড়তে অক্ষম একটি পাখি, যার নাম আলদাবরা রেল।
তবে হাজার হাজার বছর পর, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা কমলে আবার প্রাণ ফিরে আসে এই অ্যাটলে। এক নতুন গবেষণায় দেখা যায়, বিলুপ্ত সেই আলদাবরা রেল আবার ফিরে এসেছে।
'জুলজিক্যাল জার্নাল অব দ্য লিনিয়ান সোসাইটি'-তে প্রকাশিত এই গবেষণায় যুক্তরাজ্যের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের জুলিয়ান হিউম এবং ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথের ডেভিড মার্টিল ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এই পুনরুত্থান সম্ভব হয়েছে এক বিরল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, যার নাম "ইটারেটিভ ইভল্যুশন"।
এই প্রক্রিয়ায় একই পূর্বপুরুষের কাছ থেকে ভিন্ন সময়ে একই ধরনের বৈশিষ্ট্য বা গঠন পুনরায় বিকশিত হয়। সিবিএস নিউজের সোফি লুইসের মতে, ইটারেটিভ ইভল্যুশন মানে হলো, "কোনো প্রজাতির আগের রূপ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, সেটি বারবার ফিরে আসতে পারে।"
আলদাবরা রেল মূলত শ্বেতকণ্ঠী রেলের (Dryolimnas cuvieri) একটি উপপ্রজাতি। ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দ্বীপপুঞ্জে এই পাখির দেখা পাওয়া যায়। পোর্টসমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতে, এই পাখিগুলোকে বলা হয় "অবিচল বসতি স্থাপনকারী"। পাখিগুলো বড় ভূখণ্ডে সংখ্যায় বেড়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে খাদ্যের অভাব ও অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে দলবদ্ধভাবে নতুন জায়গায় পাড়ি জমায়।
ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের জোশ ডেভিসকে জুলিয়ান হিউম জানান, "কিছু একটা তাদের উদ্বুদ্ধ করে, আর তারা চারদিকে উড়ে চলে যায়। এটি পঞ্চাশ বা একশ বছরে একবার ঘটতে পারে। মানুষ এখনও বুঝতে পারেনি, কীভাবে এটি ঘটে। তবে ভাগ্য ভালো হলে কিছু পাখি কোনো দ্বীপে গিয়ে নামে।"
কোনো এক অতীতে রেল পাখি আলদাবরায় এসে পৌঁছায়। অ্যাটলে কোনো শিকারি প্রাণী না থাকায় তাদের উড়ার ক্ষমতার প্রয়োজন হয়নি। ফলে ধীরে ধীরে পাখিগুলো উড়তে পারার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ভয়াবহ বন্যার পর, একই প্রক্রিয়া আবার ঘটে। রেল পাখিরা পুনরায় আলদাবরায় আসে এবং শিকারির অভাবে আবার উড়ার ক্ষমতা হারায়।
'গিজমোডো'র রায়ান এফ. ম্যান্ডেলবাউমকে গবেষক জুলিয়ান হিউম বলেন, "২০ হাজার বছরের মধ্যেই রেল পাখিরা আবার উড়ার ক্ষমতা হারাতে শুরু করে। যদি পরিবেশ ঠিক থাকে, তাহলে বিবর্তন অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ঘটতে পারে।"
এই বিবর্তনের রহস্য উদঘাটনে গবেষকরা বন্যার আগে ও পরে পাওয়া ফসিল বিশ্লেষণ করেন। বিশেষভাবে, অন্তত ১ লাখ ৩৬ হাজার বছর আগের দুটি হিউমেরাস (ডানা) এবং ১ লাখ বছর পুরোনো আরেকটি পায়ের হাড় তুলনা করা হয়। এছাড়া, তারা আধুনিক রেল পাখির নমুনাও পরীক্ষা করেন। এর মধ্যে কিছু পাখি উড়তে সক্ষম ছিল এবং কিছু পাখি আলদাবরার উড়তে অক্ষম পাখি ছিল।
গবেষকরা দেখতে পান, বন্যার আগের রেল পাখির হাড়ের সঙ্গে আজকের আলদাবরার উড়তে অক্ষম রেল পাখির হাড়ের অত্যন্ত মিল রয়েছে। বন্যার পরপর পাওয়া রেল পাখির একটি পায়ের হাড় থেকে জানা যায়, পাখিটি তখন উড়ার ক্ষমতা হারানোর প্রক্রিয়ায় ছিল। অর্থাৎ, একই প্রজাতি আলদাবরায় দ্বিতীয়বার বিবর্তিত হচ্ছিল।
গবেষক জুলিয়ান হিউম বলেন, "ওই একটিমাত্র হাড় থেকে বোঝা যায়, এটি আগের উড়ন্ত রেলের তুলনায় বেশি শক্তপোক্ত হচ্ছিল, অর্থাৎ পাখিটি ভারী হয়ে উঠছিল এবং উড়ার ক্ষমতা হারাচ্ছিল।"
গবেষণার লেখকদের মতে, এই ফলাফল স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে ড্রাইওলিমনাস প্রজাতি বন্যার পর আবার আলদাবরায় ফিরে আসে এবং দ্বিতীয়বার উড়ার ক্ষমতা হারায়। পাখির জীবাশ্ম রেকর্ডে এমন পুনরায় বিবর্তনের উদাহরণ অত্যন্ত বিরল এবং রেল পাখির ক্ষেত্রে এটি আগে কখনো শোনা যায়নি।
আজকের দিনে বিভিন্ন দ্বীপে থাকা উড়তে অক্ষম রেল পাখিরা বিড়াল ও ইঁদুরের মতো শিকারি প্রাণীর কারণে হুমকির মুখে। তবে আলদাবরা রেল ভারত মহাসাগরে টিকে থাকা একমাত্র উড়তে অক্ষম রেল পাখি। এই গবেষণায় স্পষ্ট হয়েছে, সঠিক পরিবেশ থাকলে রেল পাখিরা দ্রুত উড়ার ক্ষমতা হারাতে পারে।