পরিবারের আপত্তির মুখে ইয়ামিনের মরদেহ উত্তোলন করেনি কর্তৃপক্ষ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকার সাভারে পুলিশের [ছররা] গুলিতে নিহত মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) শিক্ষার্থী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের মরদেহ পরিবারের আপত্তির মুখে উত্তোলন না করে ফিরে গেছেন জেলা প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তারা।
মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে ঢাকা জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় থানা পুলিশের কর্মকর্তারা আদালতের নির্দেশে ইয়ামিনের মরদেহ উত্তোলনের উদ্যোগ নেন। তবে পরিবারের সদস্যদের আপত্তির কারণে তারা মরদেহ উত্তোলন কার্যক্রম স্থগিত রাখেন।
এ সময় ইয়ামিনের পরিবারের পক্ষ থেকে মরদেহ উত্তোলন না করার জন্য লিখিত আবেদন দেওয়া হয়।
গত বছরের ১৮ জুলাই সাভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন এমআইএসটির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ইয়ামিন। এ ঘটনায় তার মামা মো. আব্দুল্লাহ আল মুনকাদির আদালতে ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৃথক দুটি মামলা করেন।
সকালে ঢাকা জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলী হাসানের নেতৃত্বে স্থানীয় থানা পুলিশের একটি দল সাভারের ব্যাংক টাউন এলাকায় যায়। তারা ইয়ামিনের মামা ও মামলার বাদী মো. আব্দুল্লাহ আল মুনকাদিরকে সঙ্গে নিয়ে কবর শনাক্ত করেন।
পরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা মরদেহ উত্তোলনে আপত্তি জানান।
ঢাকা জেলা প্রশাসনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলী হাসান বলেন, 'আদালতের নির্দেশে আজ ইয়ামিনের মরদেহ তুলে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা মরদেহ উত্তোলনে অনিচ্ছুক। তারা ইয়ামিনের শহিদের মর্যাদা পাওয়ার কথা জানিয়ে লিখিতভাবে আপত্তি জানিয়েছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'মরদেহ উত্তোলন আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। পরিবারের লিখিত আবেদনের বিষয়টি আদালতকে জানানো হবে। এরপর আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।'
মামলার বাদী মো. আব্দুল্লাহ আল মুনকাদির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ইয়ামিনের বাবা-মা কেউ চান না কবর থেকে মরদেহ উত্তোলন করা হোক। তাকে শহিদের মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে।'
'হত্যার ভিডিও ফুটেজ, ছবিসহ প্রয়োজনীয় সব প্রমাণ রয়েছে। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে আমরা প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন দিয়েছি,' তিনি আরও বলেন।
ইয়ামিনকে যেভাবে হত্যা করেছিল পুলিশ
১৮ জুলাই পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলাকালীন দুপুর ২টা বা তার কিছুসময় পর আন্দোলনকারীদের দমনে ঢাকা–আরিচা মহাসড়কের মূল সড়কের নবীনগরমুখী লেনে পুলিশের একটি নেভি ব্লু রংয়ের এপিসি [আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার] উপস্থিত হয়।
এপিসিটির ভেতরে তখন পুলিশের মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন সদস্য ছিলেন। সোয়া ২টার দিকে আন্দোলনকারী ইয়ামিন এক ফাঁকে পুলিশের এপিসিটির ওপরে উঠে যান।
ওই সময় এপিসিটি অবস্থান করছিল সাভার বাস স্ট্যান্ডের পুরাতন ওভারব্রিজের কাছাকাছি। এপিসির ওপরে ওঠার পরপরই বুকের বাম পাশে [ছররা] গুলিবিদ্ধ হয়ে এপিসির ছাদেই লুটিয়ে পড়েন তিনি।
ইয়ামিন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই বন্ধ করে দেওয়া হয় এপিসির ওপরের প্রবেশপথের ঢাকনাটি [হ্যাচ]। এর কিছুক্ষণ পর এক পর্যায়ে এপিসির ভেতর থেকে এক পুলিশ সদস্য বামদিকের একটি দরজা খুলে এবং আরেকজন এপিসির হ্যাচ খুলে ওপরে বেরিয়ে টেনে ইয়ামিনকে নির্মম ও অমানবিকভাবে সড়কে ফেলে দেন।
বিস্তারিত পড়ুন: সাভার, ১৮ জুলাই: ইয়ামিনকে যেভাবে হত্যা করেছিল পুলিশ
তখনও জীবিত ছিলেন ইয়ামিন। সড়কে পড়ে থাকা এ শিক্ষার্থীকে জোরে জোরে শ্বাস নিতে দেখা যায়। তার দুহাত দুদিকে ছড়ানো ছিল। পা দুটি ভাঁজ হয়ে পড়ে। একটি পা গিয়ে ঠেকে এপিসির বাম দিকের পেছনের চাকার গায়ে।
এ সময় এপিসির বামদিকের দরজা দিয়ে পুলিশের প্রথম সদস্য নেমে ইয়ামিনের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তাকে এপিসির চাকার পাশ থেকে সরিয়ে মহাসড়কের মাঝের দিকে টেনে নিয়ে আসেন।
এর কয়েক মিনিট পর এপিসিতে থাকা দুজন পুলিশ সদস্য আবারও ইয়ামিনকে ধরে মূল সড়কের বিভাজকের ওপর থেকে সার্ভিস লেনে অমানবিকভাবে ফেলে দেন।
ইয়ামিনকে সার্ভিস লেনে ফেলে দেওয়ার পরপরই তার অবস্থানের কাছেই আরেকটি টিয়ারশেল পড়ে। শেলের ঝাঁঝালো গ্যাসের কারণে সবাই তখন ইয়ামিনকে সড়কে সেভাবেই ফেলে রেখে ওই স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
প্রায় একঘণ্টা পর কয়েকজন আন্দোলনকারী ইয়ামিনকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ সময় দেখা যায়, শাইখ আসহাবুল ইয়ামিনের বুকের বাম পাশ ও গলায় অসংখ্য ছররা গুলির চিহ্ন।
কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দলোন এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।