আরমান: যখন হকার থেকে ক্যাসিনো কিং
একসময় ঢাকার গুলিস্তান আর বায়তুল মোকাররম মসজিদের কাছে পথের ওপর দোকান সাজিয়ে জিনিস বিক্রি করে যার দিন কাটত, তিনি একদিন ‘ক্যাসিনোর রাজা’ হয়ে উঠবেন ভাবা যায়?
‘রাজা’ নিজেও মনে হয় তার সবচেয়ে মধুর স্বপ্নে নিজের এমন ভাগ্যের কল্পনা করেননি।
অবশ্য সেসব ভেবেই-বা কী লাভ! ভাগ্য তো এনামুল হক আরমানকেই অনুগ্রহ করেছিল।ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল তার ‘ক্যাসিনো গুরু’ ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের প্রতিও। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের সভাপতি ও সহ-সভাপতির পদ থেকে দুজনেই যদিও সদ্য-বহিষ্কৃত, তবে একসময় সংগঠনের ভেতরে তাদের উত্থান ছিল স্বপ্নের মতো।
আরমানের কথায় ফিরে আসি। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকের কথা। তখনও আরমান জীবিকা চালাতেন হাতে বানানো নানা ধরনের জিনিস বিক্রি করে, গুলিস্তান ও বায়তুল মোকাররমের সামনে। এক কথায়, তিনি ছিলেন ঢাকার ফুটপাতের একজন হকার। ফেনী কলেজে পড়তেন একসময়। সেখান থেকে ঢাকায় এসে এ কাজেই জীবিকা চালাতে হযেছে তাকে।
ব্যবসায়ে যেটুকু লাভ হত তা দিয়ে পরে তিনি সিঙ্গাপুর ও পাকিস্তান থেকে লাগেজে ভরে বিভিন্ন জিনিস আনতে শুরু করলেন। এভাবে একসময় ‘লাগেজ-ব্যবসায়ী’ হয়ে উঠলেন আরমান। নতুন ব্যবসায়ে মুনাফার অংকটা ছিল বেশ ভালো।
তখন আরমানের ইচ্ছা হল রাজনীতিতে ঢোকার। খালেদা জিয়ার আত্মীয় ইকবাল হোসেনের সঙ্গে ইতোমধ্যে পরিচয় হয়েছে তার। তাতেই তার রাজনীতিতে ঢোকার পথ সুগম হয়ে গেল।এরপর থেকে ‘হাওয়া ভবনে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করলেন আরমান।
রাজনৈতিক কোনো পদ-পদবীর তাই আর দরকার হয়নি, এমনিতেই রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলেন আরমান।
এভাবে ধীরে ধীরে মতিঝিলের ক্লাব-পাড়ায় তার প্রতিপত্তি বাড়তে শুরু করল। আরমানের রাজনৈতিক পরিচয়ও ততদিনে রং বদলে ফেলেছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি খুব দ্রুত ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ভিড়ে গেলেন।
এ সময় তিনি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের কাছে যাবার সুযোগ পেলেন। প্রথমদিকে তার ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করতেন আরমান। কয়েক বছরের মধ্যে, ২০১৩ সালে যুবলীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে তিনি সহ-সভাপতির পদ বাগিয়ে নিলেন।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি আরমানকে। রাজধানীজুড়ে নানা ধরনের অপরাধকর্মের সঙ্গে তার নাম জুড়ে গেল। টেন্ডার বাগানোর কাজে হয়ে উঠলেন পারদর্শী। এভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আরমান।
একসময় লাগেজ-ব্যবসায়ী ছিলেন বলে আরমান সিঙ্গাপুর থেকে ক্যাসিনোর ধারণা আমদানি করেছিলেন। বলতে গেলে, এখনকার এই ক্যাসিনো-চক্রের মধ্যে সবার আগে তিনিই এই ব্যবসার কথা জেনেছিলেন। সম্রাটের সঙ্গে ক্যাসিনোর ধারণা নিয়ে আলোচনার পর দুজনে মিলে শুরু করলেন এ ব্যবসা। মতিঝিলের স্পোর্টিং ক্লাবগুলো হয়ে উঠল ক্যাসিনোর আখড়া। শুরু থেকেই সেখানে চালু হল বিভিন্ন বিষয়ে বাজি ধরা আর জুয়া খেলা।
অর্থকড়ির রমরমা বাড়ার পর আরমান ইদানিং বিভিন্ন সিনেমা প্রযোজনা করতে শুরু করেছিলেন। ‘দেশবাংলা মাল্টিমিডিয়া’র মালিক তিনি। গত ঈদে এই প্রযোজনা সংস্থা থেকে একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে। ছবির নাম “মনের মতো মানুষ পেলাম না’। ছবিতে অভিনয় করেছেন শাকিব খান ও বুবলি।
এত বিশাল সাম্রাজ্য, প্রভাব-প্রতিপত্তি— সম্রাট ও আরমান মিলে যেটা সাজিয়ে বসেছিলেন— সেই সাম্রাজ্যেরও পতন হল। রোববার ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার সীমান্তবর্তী এক গ্রামের বাড়ি থেকে যুবলীগের সদ্য-সাবেক এই দু’নেতাকে আটক করেছে র্যাব। সীমান্ত দিয়ে পালাতে চেয়েছিলেন তারা।
ভাগ্য এবার মুখ ফিরিয়ে নিল আরমানের দিক থেকে। পতন হল এক রাজার।