এশীয় কিছু দেশে টিকাদানে বিলম্বের কারণ কী?
সর্বশেষ পরিসংখ্যানে চলমান জাতীয় টিকা কর্মসূচির মাধ্যমে পৃথিবী জুড়ে দেওয়া হয়েছে কোভিড-১৯ প্রতিষেধকের ১৬ কোটি ডোজ। বৈশ্বিক জনসংখ্যার তুলনায় এ সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। তারমধ্যে আবার অধিকাংশ ডোজই দেওয়া হয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে।
এশীয় অঞ্চলে ভারতের মতো কিছু দেশে স্থিরগতিতে চলছে টিকাদানের কার্যক্রম। জানুয়ারি থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ ডোজ দেওয়ার কথা জানিয়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। ১৩০ কোটির বেশি জনসংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যাও আশাব্যঞ্জক নয়।
এই অঞ্চলের অনান্য কিছু দেশের অবস্থা অবশ্য আরও নিরাশজনক। কোথাও টিকাদান এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে, কোথাও বা কেবল যাত্রা শুরু করছে। দেরির পেছনে কারণও বহুবিধ- যেমন ইতিহাসের দ্রুততম সময়ে আবিষ্কৃত প্রতিষেধক নিয়ে জাতীয় নিয়ামক সংস্থার অতি-সতর্কতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে কার্যকরী প্রভাব ঘিরে জনমনে বিরাজমান অবিশ্বাস ও সন্দেহ।
এসব কারণে প্রভাবিত এই অঞ্চলের নানা দেশ এবং তার পিছনে বিবিধ কারণ তুলে ধরা হলো এখানে:
ভীতি এবং মিথ্যে তথ্যের বিস্তার
ফিলিপাইন: ২০১৬ সালে ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে ডেঙ্গভ্যাক্সিয়া নামের প্রতিষেধক দেওয়ার অনুমতি দেয় ফিলিপিনো কর্তৃপক্ষ। দুই বছর পর ২০১৮ সালেই বন্ধ হয় টিকাদানের কার্যক্রম। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শিশু মৃত্যুর খবর রটনার পরই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ঘিরে সেই একইরকম প্রচারের স্রোতে ভাসছে নাগরিক আলোচনার মাধ্যমগুলো।
ফিলিপিনো কর্মকর্তারাও কম যান না। দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার বক্তব্যের মাধ্যমে কোভিড টিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেওয়ার পর তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় সরকার। জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ ঘটনায় জনমনের অবিশ্বাস নতুন মাত্রা পেয়েছে, যার ফলে টিকাদানের মাধ্যমে মহামারির লাগাম টেনে ধরার দেশটির পরিকল্পনা জিম্মি হয়ে পড়েছে অপপ্রচারের কাছে।
সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রতি পাঁচজনে একজন বা মাত্র ১৯ শতাংশ টিকাগ্রহণের উপযুক্ত ফিলিপিনো টিকা নিতে ইচ্ছুক। তার বাইরেও আরেকটি বড় সমস্যা হলো; জাতীয় পর্যায়ে কর্মসূচি শুরুর মতো পর্যাপ্ত টিকার ডোজ এখনও দেশটিতে আসেনি।
বলতে গেলে এই সেদিন- গত ২৮ ফেব্রুয়ারি চীনা সংস্থা সিনোভ্যাকের প্রথম ডোজের চালান পায় ফিলিপাইন। চালান আসার মাত্র কয়েকদিন আগে এটির জরুরি প্রয়োগের অনুমোদন দেয় ফিলিপিনো নিয়ামক সংস্থা।
চালানের এই সমস্যা সত্যিকার অর্থেই বড় বাধা হয়ে উঠেছে দেশটিতে। রাজধানী ম্যানিলা থেকে বিবিসি'র প্রতিবেদক ভিরমা সিমোনেত্তে জানান, এর আগে জরুরি অনুমোদন পায় ফাইজার- বায়োএনটেক এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এ দুটি টিকার চালান পৌছানোর কথাও ছিল। কিন্তু, সময়মতো এসব চালান আসেনি। শেষমেশ কেবল গত ৪ মার্চ আসে অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার চালান।
পাকিস্তান: ভ্যাকসিন ঘিরে ভয়ের দেয়াল পাকিস্তানেও বড় সমস্যা। এই ভয় ছড়ানো হয়েছে নানা রকম অপপ্রচার এবং ভাইরাল কিছু ভিডিও'র মাধ্যমে। এই ভিডিওগুলো জনমানসে সফলভাবেই অমূলক ভয়ের বীজ বুনে দেয়।
২০২০ সালে ছড়ানো এমন এক ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া একদল স্কুল পড়ুয়া বালকদের জাগিয়ে তুলতে চিৎকার করছেন একজন শিক্ষক। তিনি এজন্য পোলিও'র টিকাকে দায়ী করে ভিডিওতে বলতে থাকেন, সরকারি কর্মকর্তারা জোর করে টিকাগ্রহণে বাধ্য করাতেই শিশুদের এই অবস্থা। তিনি কর্মকর্তাদের শাপশাপান্তও করতে থাকেন। ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষুদ্ধ হয় জনতা, এরফলে তারা একটি ক্লিনিক (টিকাকেন্দ্র) পুড়িয়ে দেয়।
এটি সহ একইরকম আরও কিছু ভিডিও'র প্রভাবে পাকিস্তানে পোলিও টিকাদানের গতি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। ভিডিওগুলি যে মিথ্যা তা দেশটির বিজ্ঞ নাগরিকদের অনেকেই প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, সামাজিক মাধ্যম থেকেও সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে- কিন্তু ততোদিনে ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই যায়। লাখ লাখ মানুষ এসব ভিডিও দেখে ফেলে এবং দরিদ্র ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ তাতে আস্থা স্থাপন করে।
পোলিও টিকাদান ঘিরে ভীতি এবার জনগণকে কোভিড টিকার আওতায় আনার লক্ষ্যেও প্রভাব ফেলা শুরু করেছে। অবস্থা এতোটাই নাজুক যে খোদ স্বাস্থ্যকর্মীরাই সন্দিহান। পাকিস্তানের অন্যতম বড় নগরী পেশোয়ারের একজন চিকিৎসক জানান, টিকাদানের প্রথম দিনে ৪০০ স্বাস্থ্যকর্মীর প্রতিষেধকের ডোজ নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু নিতে এসেছিলেন মাত্র কয়েক ডজন।
সতর্ক পদক্ষেপ
এশীয় অঞ্চলভুক্ত কিছু দেশে কেবল শুরুর পথে টিকাদানের কার্যক্রম। দেশগুলোর সরকারি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের দাবি, টিকা দিতে ইতস্তত নয়, বরং বাড়তি সতর্কতার কারণেই একটু দেরিতে শুরু হচ্ছে। ঢিমেতালে শুরু করতে চলা এসব জাতির কেউ কেউ মহামারি নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখায় এবং তারফলে ধীরেসুস্থে টিকাদান শুরু করার মতো বিলাসীতা তারা করতে পেরেছে।
পৃথিবীর একমাত্র দেশ অস্ট্রেলিয়া- যার ভৌগলিক সীমানা পুরো এক মহাদেশ জুড়ে। আলাদা মহাদেশ হলেও, প্রশান্ত মহাসাগরীয় এশীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত অস্ট্রেলিয়া। দেশটির ডিকেন ইউনিভার্সিটির প্রাদুর্ভাব বিশেষজ্ঞ ক্যাথেরিন বেনেট- এর উদ্ধৃতি দিয়ে বার্তা সংস্থা এপি জানায়, দেরি করে এসব দেশ অন্যান্য রাষ্ট্রে টিকাদানের ফলাফল সম্পর্কিত তথ্য বিশ্লেষণের সুযোগ পায়। কোভিড টিকাদান নিয়ে এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অজানা। যেমন ভুল ডোজ নিলে কী ঘটবে, গর্ভবতী নারীর উপর কেমন প্রভাব পড়বে- এমন অনেক কিছু জানা গেছে- দেরি করে অন্য দেশের উপর নজর রাখার মাধ্যমে। নিজ জনসংখ্যাকে ঝুঁকির মধ্যে না ফেলেই তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে লাভবান হয় তারা।
দক্ষিণ কোরিয়া: দেশটির প্রধানমন্ত্রী চুং সি-কিউন তার সরকারের দেরিতে টিকাদান শুরুর পদক্ষেপের প্রতি পুনঃসমর্থন ব্যক্ত করে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জানান, অন্যদেশের হালচাল দেখে, সেখানে টিকা কেমন সফলতা অর্জন করেছে- তা বাছবিচার করে আমরা নিজেদের উদ্যোগ শুরু করতে চেয়েছি।
তিনি রাজধানী সিউলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিবিসির প্রতিবেদক লরা বিকারকে বলেন "আপনারা জানেন, কোরীয়রা দ্রুতগতিতে কাজ করতে পারে।" এর মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত দেন যে দেরি হলেও সবাইকে দ্রুত ফলপ্রসু টিকার আওতায় আনতে তৎপর হচ্ছে তার প্রশাসন।
এশিয়ার সিঙ্গাপুর, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোও টিকদানের 'দেরি'র গুরুত্ব তুলে ধরে একইরকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
দেরির পরও অধিকাংশ দেশ শিগগির শুরুর ব্যাপারে আশাবাদী। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার কথা, টিকাদানের মাধ্যমে আগামী বসন্ত নাগাদ গোষ্ঠীবদ্ধ প্রতিরোধ সক্ষমতা অর্জন করতে চায় দেশটি।
থাইল্যান্ড: চলতি মার্চ থেকে টিকাদান শুরু করছে থাইল্যান্ড, তবে কেবল শুরু করলেও বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে অর্ধেক জনসংখ্যাকে টিকা দেওয়ার আশা করছেন স্থানীয় কর্মকর্তারা।
সিঙ্গাপুর: সম্পূর্ণ জনসংখ্যার জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ টিকার ডোজ সংগ্রহ করার পরও এপর্যন্ত মাত্র আড়াই লাখ নাগরিককে প্রতিষেধক দিয়েছে দেশটি। এপ্রিলের শেষ নাগাদ কর্মসূচির পরিধি ও গতি বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে দেশটি।
ভ্যাকসিন নিতে দ্বিধা
জাপান: আগামী জুলাইয়ে জাপানে অনুষ্ঠিত হবে ২০২১ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আসর। আয়োজনটি সফল করা জন্যে টিকাদানের সফলতাকে অত্যাবশ্যক বলে ধারনা করা হচ্ছে। কিন্তু, তারপরও ভ্যাকসিন নিয়ে জনমানসের দ্বিধা বা সংকোচ সেদেশে বড় সমস্যা।
ভ্যাকসিনে আস্থার দিক থেকে বিশ্বের সর্বনিম্ন অবস্থানে জাপানিরা। ১৯৯০ এর দশকে শুরুতে হাম, মাম্পস এবং রুবেলার টিকাদানের ফলে দেশটিতে মেনিনজাইটিস রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল- এমন সন্দেহ করেন অনেকেই। রোগটির বিস্তারের সঙ্গে টিকাদানের কোনো যোগসূত্র না মিললেও- তারপর থেকেই বন্ধ করা হয় ওই টিকাদানের উদ্যোগ।
কিয়েটো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের গবেষক ড. রিকো মুরাঙ্কা মনে করেন, ভ্যাকসিনের গুরুত্ব জনগণের কাছে তুলে ধরতে সরকারের পক্ষ থেকে কৌশলগত পরিকল্পনার অভাব এবং তার পাশপাশি ভ্যাকসিন ব্যর্থতার ঘটনা নিয়ে অতীতে গণমাধ্যমের তথাকথিত 'চাঞ্চল্যকর' সংবাদ শিরোনাম জাপানিদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। অনলাইনে ভ্যাকসিন বিরোধী গোষ্ঠীর প্রচারণার মতোই এসব সংবাদ মানুষকে 'টিকাবিমুখ' করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। এজন্য তিনি সরকারের প্রতি নাগরিক আস্থা অর্জনকে গুরুত্ব দেন।
এই আস্থা অর্জনের গুরুত্ব বুঝেই ফাইজারের মতো কোম্পানির আবিষ্কৃত কার্যকর টিকাটির অনুমোদনে দেরি করে জাপান। কেবলমাত্র ১৭ ফেব্রুয়ারি জাপানের নিয়ামক সংস্থা জরুরি অনুমোদন দেয়।
ড. মুরাঙ্কা বলেন, মহামারি অনেক উন্নত দেশের মতো জাপানে তেমন প্রভাব ফেলেনি, মানুষের মধ্যে আগ্রহ না থাকার সেটাও আরেক কারণ। তবে তিনি মনে করেন, আশার কথা হলো; ধীরে ধীরে সেই মানসিকতায় পরিবর্তন আসছে।
- সূত্র: বিবিসি