সাবিত্রী দেবী: নাৎসি গুপ্তচর বাঙালি বধূ
গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে 'নিউ মার্কারি' পত্রিকা সম্পাদনা করতেন অসিতকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। সেটি ছিল সারা ভারতবর্ষের একমাত্র নাৎসি পত্রিকা। অসিতকৃষ্ণ ছিলেন নাৎসি জার্মানির উগ্র সমর্থক।
নাৎসি জার্মানি ও আর্য বর্ণবাদকে প্রকাশ্যে সমর্থন করার পাশাপাশি তিনি হিটলারেরও অন্ধ সমর্থক হয়ে ওঠেন। এ ১৯৩৮ সালে অসিতকৃষ্ণের পরিচয় হলো সাবিত্রী দেবী নামে এক নারীর সঙ্গে। নাৎসিবাদ সম্পর্কে সাবিত্রীর জ্ঞান ও মোহ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন অসিতকৃষ্ণ। সেই থেকে প্রণয়। প্রণয় থেকে ১৯৪০ সালের ৯ জুন কলকাতায় পরিণয়বন্ধনে আবদ্ধ হলেন দুজনে।
সাবিত্রী ও অসিতকৃষ্ণ অক্ষশক্তির আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। সে সময়ে কলকাতাতে বেশ কিছুদিন থেকে এই দম্পতি। কে ছিলেন এই সাবিত্রী দেবী?
সাবিত্রী দেবীর আসল নাম ম্যাক্সিমিয়ানি পোর্টাস। জন্ম ১৯০৫ সালে, ফ্রান্সে লিয়োঁ শহরে। গ্রিক-ইটালিয়ান, মা ইংরেজ।
শৈশব থেকেই সাম্যবাদকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন ম্যাক্সিমিয়ানি। তার চোখে 'একটি কুৎসিত চেহারার মেয়ে কোনো দিক থেকেই একটি সুন্দরী মেয়ের সমান হতে পারে না।'
ম্যাক্সিমিয়ানির পড়াশোনা লিয়োঁ বিশ্ববিদ্যালয়ে, দর্শনশাস্ত্রে। গ্রিক জাতীয়তাবাদে আকৃষ্ট হয়ে ১৯২৩ সালে তিনি গ্রিসে ঘুরতে যান। সে সমই এথেন্সে এসে পৌঁছে হাজার হাজার শরণার্থী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে এশিয়া মাইনরে গ্রিসের সর্বনাশা সামরিক ব্যর্থতার পরে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল এই শরণার্থীরা।
গ্রিসের অবমাননার জন্য ম্যাক্সিমিয়ানি পশ্চিমা মিত্রদের দোষী ভাবতেন। জার্মানির ওপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া ভার্সাই চুক্তিকেও তিনি ভালোভাবে নেননি। সাবিত্রীর চোখে গ্রিস ও জার্মানি উভয়ই অন্যায়ের শিকার।
এমন সময় ম্যাক্সিমিয়ানির সঙ্গে দেখা হয় জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ হাইনরিখ শ্লিম্যানের। শ্লিম্যান প্রাচীন ট্রয়ের ধ্বংসাবশেষের ১৮০০টি জায়গায় স্বস্তিকা চিহ্ন আবিষ্কার করেছিলেন।
তার সঙ্গে আলাপ হবার পরেই ম্যাক্সিমিয়ানি স্বস্তিকা চিহ্নের সঙ্গে পরিচিত হন এবং তার ধারণা হয়, প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার জন্ম আসলে আর্য সভ্যতা থেকেই।
১৯২৯-এ তিনি ফিলিস্তিন ভ্রমণে যান। যিশু খ্রিষ্টের স্মৃতিবিজড়িত জেরুজালেম সফরকালে সময়ে তার মনে ইহুদি বিদ্বেষ দানা বাঁধে। স্বস্তিকার প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ আর এই মনোভাবই তাকে নাৎসিবাদের অন্ধ সমর্থকে পরিণত করে। ম্যাক্সিমিয়ানির দাবি ছিল, এই ধ্যান-ধারণা তিনি বাইবেল থেকে পেয়েছেন। নিজেকে 'ধর্মচ্যুত আর্য' মনে করতেন
সাবিত্রী।
এদিকে ইউরোপ থেকে ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন করে 'আর্য জাতি'র শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যের কারণে হিটলার ম্যাক্সিমিয়ানির আদর্শ পুরুষ হয়ে ওঠেন। তার মতে, হিটলার ছিলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর অবতার।
১৯৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে ভারতযাত্রা করেন ম্যাক্সিমিয়ানি। উদ্দেশ্য এখানকার 'প্যাগান' সভ্যতা সম্পর্কে জানা। সে সময় রেলের চতুর্থ শ্রেণির কামরায় একজন ইউরোপীয় নারীর ভ্রমণ এত অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল যে ব্রিটিশ উপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ তার ওপর নজর রাখতে শুরু করে।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত ভারতে ব্রিটিশদের সঙ্গে ম্যাক্সিমিয়ানির কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর তিনি জাপানিদের কাছে ব্রিটিশদের তথ্য পাচার করতে শুরু করেন। বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা শেখেন তিনি। এর মধ্যেই পরিচয় ও বিয়ে হয় অসিতকৃষ্ণের সঙ্গে।
১৯৩০-এর দশকে ম্যাক্সিমিয়ানি কলকাতায় হিন্দু মিশনে যোগ দেন। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দুধর্মের প্রতি অনুগত হয়ে তিনি সাবিত্রী দেবী নাম গ্রহণ করেন। হিন্দু মিশনে যোগ দিয়ে খ্রিস্টান ও ইসলাম প্রচারের বিরোধী হিসাবে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ শুরু করেন। হিন্দু মিশনের দাবি ছিল, হিন্দুরাই আর্যদের প্রকৃত উত্তরাধিকারী এবং ভারত আসলে হিন্দু দেশ।
হিন্দু মিশনের পরিচালক স্বামী সত্যানন্দ সাবিত্রীকে নানা জায়গায় প্রচারের জন্যে পাঠাতে শুরু করেন। সাবিত্রী ঘুরে ঘুরে নানা জায়গায় হিন্দি ও বাংলায় হিন্দু ধর্মের আলোচনার সাথে নাৎসি প্রোপাগান্ডা ও 'মাইন ক্যাম্ফ' থেকে উদ্ধৃতি দিতে শুরু করেন। হিন্দুরা তার বক্তৃতা পছন্দই করত। কারণ সাবিত্রীর বক্তব্যে ইংরেজ-বিরোধিতা থাকত।
অসিতকৃষ্ণের সঙ্গে বিয়ে হবার আগে 'নিউ মার্কারি' পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার পর ১৯৩৮ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত অসিতকৃষ্ণ জাপানি লিগেশনের সহায়তায় 'দ্য ইস্টার্ন ইকোনমিস্ট' প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। এই জাপান-সম্পৃক্ততা পরে গুপ্তচরবৃত্তিতে পরিণত হয়।
সাবিত্রী ও অসিতকৃষ্ণ অক্ষশক্তির জন্যে ব্রিটিশদের তথ্য সংগ্রহ করে জাপানি গোয়েন্দাদের কাছে পাচার করতেন। এ সময়ে সাবিত্রীর সঙ্গে তার মায়ের বিরোধ দেখা দেয়। কারণ সাবিত্রীর মা ফ্রান্সে জার্মান দখলের সময় ফরাসি প্রতিরোধ বাহিনীর হয়ে কাজ করেছিলেন।
সাবিত্রী পরে দাবি করেছিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সুভাষ চন্দ্র বোসকে তিনি আর অসিতকৃষ্ণ মিলে জাপান সাম্রাজ্যের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৪৫ সালে তৃতীয় রাইখের পতনে মুষড়ে পড়েন সাবিত্রী। উদ্দেশ্য থার্ড রাইখের পুনর্গঠনের জন্য ইউরোপে ফিরে যান। স্বামীর সূত্রে তার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট ছিল। তাই তিনি ইংল্যান্ডেই আসেন।
১৯৪৮ সালে সাবিত্রী অধিকৃত জার্মানিতে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি নাৎসিপন্থী লিফলেট বিতরণ করার জন্য গ্রেপ্তার হন। যদিও স্বামীর প্রভাবে তাকে বেশিদিন কারাভোগ করতে হয়নি।
সাবিত্রীর যৌনজীবন নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা আছে। অসিত মুখার্জিকে বিয়ে করলেও তারা একই গোত্রের না হওয়ায় তাদের মধ্যে নাকি কোনো যৌনসম্পর্ক ছিল না। পরে নাৎসিদের অর্থসহায়তা দানকারী ফ্রাঁসোয়া দিওর নামে এক মহিলা দাবি করেছিলে যে তিনি সাবিত্রীর প্রেমিকা ছিলেন।
পরবর্তীতে সাবিত্রী ফ্রান্স থেকে ইংল্যান্ডের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান। কিন্তু কোথাও তেমনভাবে থিতু হতে পারেননি। শেষজীবনে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। দিল্লির এক নিরিবিলি রাস্তায় গ্যারেজের ওপরে একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে থাকতে শুরু করেন। প্রতিবেশী বিড়ালদের প্রতিদিন সকালে দুধ-রুটি খাওয়ানো ছিল তার রুটিন কাজ। তার বেশভূষাও আটপৌরে হিন্দু নারীর মতো।
ইউরোপ ও আমেরিকার নব্য নাৎসি নেতাদের সঙ্গে সাবিত্রীর নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
১৯৮২ সালে তিনি ইংল্যান্ডে, এক বন্ধুর বাড়িতে মারা যান। হিন্দু রীতি মেনে তার মরদেহ দাহ করা হয়। পরে তার চিতাভস্ম ভার্জিনিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমেরিকান নাৎসি পার্টির দপ্তরে। নব্য নাৎসি নেতা জর্জ লিঙ্কন রকওয়েলের সমাধির পাশেই সেই ভস্মকে সমাহিত করা হয়।
সাবিত্রী বেশ কিছু বইও লিখেছেন। এর মধ্যে 'দ্য লাইটনিং অ্যান্ড দ্য সান'-এ তিনি হলোকাস্টকে সম্পূর্ণ মনগড়া বলে দাবি করেন। তার প্রথম প্রকাশিত বই 'আ ওয়ার্নিং টু দ্য হিন্দুস'-এ তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার পক্ষে এবং ভারতে খ্রিষ্টান ও ইসলাম প্রচারকে প্রতিরোধের পক্ষে কলম ধরছেন।
মৃত্যুর পর এতদিন প্রায় বিস্মৃতই ছিলেন এই উগ্র নাৎসি-সমর্থক বাঙালি বধূ। কিন্তু সম্প্রতি ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপির উত্থানে ফের পরিচিত হয়ে উঠছেন সাবিত্রী দেবী ওরফে ম্যাক্সিমিয়ানি পোর্টাস। আমেরিকাতেও কট্টর ডানপন্থী দলগুলো তাকে নিয়ে চর্চা শুরু করেছে।
সাবিত্রীর ধ্যান-ধারণা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ডানপন্থীদের কাছে। ডার্ক মেটাল ব্যান্ড ও আমেরিকান ডানপন্থী রেডিও স্টেশনগুলোও কলিযুগ নিয়ে নিয়মিত চর্চা করছে। সাবিত্রী দেবীর বিশ্বাস ছিল, কলিযুগের অবসান হবে হিটলারের হাত ধরে।
- সূত্র: বিবিসি