ইটভাটায় বিপন্ন জনজীবন
নারায়ণগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, বালু, শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র। এ জেলার চারপাশ দিয়ে নিরবধি বয়ে চলেছে নদীগুলো। কিন্তু নদীমাতৃক এ শহর ও শহরতলী আজ বিপন্ন। গত কয়েক বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের আশপাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক অবৈধ ইটভাটা। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই কয়লা ও কাঠ পুড়িয়ে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা চলছে ইট তৈরির কার্যক্রম। ইটভাটার চিমনি দিয়ে বের হওয়া কালো ধোঁয়ার কারণে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষের জীবনে নেমে এসেছে নানা সংকট। কালো ধোঁয়ার প্রভাব পড়ছে জনজীবনসহ গাছ ও কৃষিতে।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বক্তাবলী এলাকার রোমান মিয়া বলেন, ‘‘কিছুদিন আগেও গাছে প্রচুর নারিকেল ধরতো। ফলনও ছিল ভাল। কিন্তু এখন গাছের মধ্যেই নারিকেল শুকিয়ে যাচ্ছে। অন্য গাছেও ফল ধরছে না।’’
পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, ইটভাটার কালো ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন, সালফার ও নাইট্রোজেন নির্গত হয়। যা বাতাসের সঙ্গে মিশে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে সালফার-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করে। রাসায়নিক ওই যৌগগুলোর কারণে ইটভাটা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষ সর্দি, কাশি, হাঁপানি, শ্বাসকষ্টসহ নানা চর্মরোগে রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
ইটভাটার কালো ধোঁয়ার সঙ্গে বিভিন্ন যৌগ বাতাসের সঙ্গে মিশে তা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। যা দেখতে কালো পাউডারের মতো। এই পাউডার মূলত নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে ঢুকে ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। এছাড়া ওই পাউডার ফসলি জমির উপর পড়লে জমির উর্বরতা কমে যায়। টিনের চালেও পড়ে আস্তে আস্তে টিন ফুটো করে দেয়।
বক্তাবলী এলাকার রোমান মিয়া জানান, তার পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে শিশুদের জ্বর, ঠাণ্ডা, কাশি লেগেই থাকে। প্রতি বছরই ঘরের টিনের চালা ও বেড়া পরিবর্তন করতে হয়। কালো ধোঁয়ার পাউডারের কারণে টিনের চালা, বেড়া ফুটো হয়ে যায়।
এছাড়া ভাটাগুলোতে ফসলি জমির মাটি বেশি ব্যবহার করা হয়। জমির উপরের অংশের মাটি কাটার কারণে মাটির আরপিএইচর (মাটির অম্ল) মাত্রা কমে যায়। ফলে ওই সব জমিতে ফসল উৎপাদন অনেক কমে আসে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বক্তাবলী এলাকায় ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা নদীর দুই পাশে প্রায় শতাধিক ইটভাটা গড়ে উঠেছে। ফতুল্লার পাগলা, আলীগঞ্জ রয়েছে বেশ কিছু ইটভাটা। এছাড়া শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রূপগঞ্জের দাউদপুর, বরাপা, কর্ণোগোপ, ভুলতা এবং বন্দরের কেওঢালা, গকুলদাশের বাগ, ফরাজিকান্দা, সোনারগাঁয়ের ললটি ও আড়াইহাজারে বেশ কিছু আবাসিক এলাকায় এসব ইটভাটা গড়ে উঠেছে।
এসব ইটভাটায় নীয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই দেদারসে পোড়ানো হচ্ছে কয়লা। আবার কোনো কোনো ইটভাটায় পোড়ানো হচ্ছে কাঠের গুঁড়ি, টায়ারসহ বিভিন্ন জ্বালানি। বিশেষ করে আড়াইহাজার মদনপুর সড়কের বেশ কয়েটি ইটভাটা রয়েছে যেগুলো চিমনি ৪০ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত উঁচু। এসব ইটভাটা থেকে নিয়মিত নির্গত হচ্ছে কালোধোঁয়া।
ললাটি এলাকার বাসিন্দা রবিউল হোসেন বলেন, ইটভাটার মালিকরা সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে ভাটার কার্যক্রম অব্যাহত রাখায় ওই এলাকার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘‘আগে এই অঞ্চলের প্রতিটি গাছে প্রচুর ফল ও কৃষি জমিতে শাক সবজি উৎপাদন হতো। কিন্তু এই রোডের পাশে চার-পাচঁটি ইটভাটা গড়ে ওঠার পর থেকে সজিব ও ফলের উৎপাদন কমতে থাকে।’’
তিনি আরও বলেন, শীত মৌসুম ইট পোড়ানোর মৌসুম। এ সময় এই অঞ্চলের বাতাসের সঙ্গে এক ধরনে গন্ধ ভেসে আসে। কাশি দিলে কফের সঙ্গে কালো কফ বেরিয়ে আসে।
ফতুল্লার বক্তাবলী এলাকার বাসিন্দা আলী হোসেন জানান, ধলেশ্বরী নদীর দুই তীরে প্রায় শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। শীতের সময় এসব ইটভাটায় কয়লা ও কাঠ পুড়িয়ে ইট পোড়ানো হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘‘ইট পোড়ানোর সময় বাতাসের সঙ্গে এক ধরনের ধুলি কণা উড়ে এসে মানুষের গায়ে পড়ে। কোনো খালি জায়গায় বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকলে নাক মুখ দিয়ে এসব ধুলিকণা প্রবেশ করে। ফলে এই অঞ্চলের প্রতিটি শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, জ্বর ও সর্দি কাশিতে আক্রান্ত হয়। রোগ থেকে বাঁচতে চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়।”
একই এলাকার বাসিন্দা সালমা বেগম বলেন, ‘‘ঘরের দরজা-জানালা দিন রাত ২৪ ঘণ্টা বন্ধ করে রাখতে হয়। মশারি, কাঁথা ধুলাবালিতে ভরে যায়।’’
তিনি আরও বলেন, ইটভাটার মালিকরা প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না। প্রশাসনের কাছে বারবার অভিযোগ দেয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
ফতুল্লা বক্তাবলী ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি ও বক্তাবলী ঘাট সংলগ্ন নুরানী ব্রিক্স ফিল্ডের সত্ত্বাধিকারি শওকত আলী জানান, উচ্চ আদালতের রায়ের কারণে ইটভাটারর মালিকরা খুব চাপের মধ্যে রয়েছে।
তিনি দাবি করেন, ধলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত বেশির ভাগ ইটভাটাই সরকারি নিয়ম মেনে জিগজ্যাগ পদ্ধতিতে ইটভাটা রূপান্তরিত করেছে। যেসব ইটভাটা এখনো জিকজ্যাক পদ্ধিতে আসতে পারেনি বা আসেনি তাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে অভিযান চালিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন বেশ কয়েকটি ইটভাটা ভেঙে দিয়েছে। অনেককে মোটা অংকের জরিমানা করেছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারি নিয়ম মেনে ইটভাটা ও চিমনি স্থাপন করতে হলে কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু ইটভাটায় কোনো ব্যাংকে লোন দিতে চায় না। অনেক ইটভাটা জিকজ্যাক পদ্ধতিতে আসতে না পারার কারণে বন্ধ রেখেছে। আর্থিক সংকটের কারণে তারা জিগজ্যাগে আসতে পারছে না।
ফতুল্লা ধর্মগঞ্জের গুদারাঘাট এলাকার আফসার ব্রিকস ফিল্ডের মালিক আফসার হোসেন বলেন, আমরাও পরিবেশ রক্ষা করে ইটভাটা চালাতে চাই। কিন্তু তার জন্য সময় প্রয়োজন। হঠাৎ করে প্রশাসন যেভাবে চাপ দিচ্ছে এভাবে আমাদের ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।
তিনি বলেন, সরকার যদি সদয় হয়ে এই বছর আমাদের সুযোগ দেয় তবে আগামীতে আমরা সরকারি নিয়ম মেনে ব্রিকস ফিল্ড পরিচালনা করবো।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী জেলায় মোট ইটভাটা রয়েছে ৩৩৪টি। এর মধ্যে সরকারি নির্দেশনা মেনে জিকজ্যাক পদ্ধতিতে গড়ে উঠেছে ২৬৮টি। জিকজ্যাক পদ্ধতির মধ্যে এখনও আসেনি এমন ৬৮টি ইটভাটা চলছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে ১২০ ফুট চিমনির ইটভাটা। এরই মধ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর ৫৩টি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। জরিমানা আদায় করা হয়েছে প্রায় এক কোটি টাকার উপরে।
নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাঈদ আনোয়ার জানান, উচ্চ আদালতের নির্দেশে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলো চিহ্নিত করে অভিযান চালানো হচ্ছে। গত ২০ থেকে ২২ দিনে ৫৩টি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে এক কোটি টাকার বেশি জরিমানা আদায় করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে ২৫টি ইটভাটার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চিমনি ও বাট্রি ভেঙে দেয়া হয়েছে। যেসব ইটভাটা এখনও অবৈধভাবে চলছে, পর্যায়ক্রমে সবগুলোতে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেয়া হবে।
নারায়ণগঞ্জে সিভিল সার্জন ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, কয়লা বা কাঠ পুড়িয়ে ইট তৈরির কারণে ইটভাটা থেকে যে ধোঁয়া বের হয় তা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এসব কালোধোঁয়া মানবদেহে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, জ্বর, ঠাণ্ডা, সর্দি, ফুসফুসে নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন বলেন, যেসব ইটভাটা পরিবেশের ক্ষতির জন্য দায়ী সেসব ইটভাটা চিহ্নিত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে এসব ভাটা পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেবে।