‘টাইটানিকের ক্যাপ্টেনের মতো আমার বাবাও সমুদ্রে তলিয়ে যাবেন’: প্রশান্ত মহাসাগরের বিলুপ্তপ্রায় দ্বীপে জীবন
ডুবে যাচ্ছে পাপুয়া নিউ গিনির পূর্বে এবং বোগেনভিলের দক্ষিণে অবস্থিত সাপোসা দ্বীপপুঞ্জের দ্বীপ তোরুয়ার। সলোমন সাগর ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে ছোট এই দ্বীপকে।
দ্বীপের বাসিন্দা ক্রিস্টোফার সেসে বলেন, "আমার বাবার অবস্থা হবে টাইটানিকের ক্যাপ্টেনের মতো, তোরুয়ার দ্বীপটি ডুবে গেলে তিনিও ডুবে যাবেন।"
তার বাবা ফ্রান্সিস টনি এই দ্বীপেই সমাহিত। তিনি যেখানে সমাহিত, সেই কবরস্থান থেকে পাঁচ মিটারেরও কম দূরত্বে থাকা একটি উপকূল ইতোমধ্যে ভেঙে গেছে। কিন্তু, তার দেহাবশেষ নতুন কবরস্থানে সরানোর পরিকল্পনা নেই পরিবারের।
এক দশক আগেই তোরুয়ার দ্বীপের কাছাকাছি কার্টারেট দ্বীপপুঞ্জ বিশ্বজুড়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেসময় অনেকেই সেখানকার বাসিন্দাদেরকে প্রথম জলবায়ু শরণার্থী হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে পাপুয়া নিউ গিনির আশেপাশে বেশ কয়েকটি দ্বীপ অঞ্চল অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে বা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
স্কুল ভবনের সামনে ঘাসযুক্ত একটি মাঠ দেখিয়ে সাপোসাসের টরোশিয়ান দ্বীপের প্যারামাউন্ট প্রধান জন ওয়েসলি জানান, তীব্র জোয়ারের সময় পুরো মাঠ পানির নিচে চলে যায়।
ওয়েসলি পেশায় একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। দ্বীপটি রক্ষার জন্য এর চারপাশে ছোট ছোট প্রকল্প তৈরিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। মৃত প্রবাল এবং খোল দিয়ে ভরা পুরাতন ১০ কেজি চালের ব্যাগ দিয়ে বাঁধ তৈরি করার কাজ করছেন তিনি। এমনকি, ভূমি সুরক্ষা পরিমাপ ঠিক রাখতে স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সমর্থন পাওয়ার জন্য প্রস্তাবনাও রাখছেন তিনি।
ওয়েসলি বলেন, "সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমাদের সন্তান, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। যদি আমরা এখন মূল ভূখণ্ডে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই, তাহলে হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ অনেক ভালো হবে।"
টরোশিয়ান দ্বীপে জন্মগ্রহণ করা এবং বেড়ে ওঠা স্থানীয় স্কুলের শিক্ষিকা অরণি কাইতভ বলেন, "আমি প্রায়ই আমার ক্লাসের বাচ্চাদেরকে বলি, সমুদ্র আমাদের মাটি কেড়ে নিচ্ছে এবং আমাদের জমি ক্রমশ ছোট হচ্ছে। এছাড়া, জনসংখ্যা বাড়তে থাকার কারণে ভবিষ্যতে আমরা মূল ভূখণ্ডে চলে যাব।"
'এখানে আমরা কিছু রোপণ করতে পারি না'
পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রের পানির স্তর বিশ্বব্যাপী অন্যান্য সমুদ্রের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ, গত ৩০ বছরে এই অংশে পানির উচ্চতা ০.৩ মিটার বৃদ্ধি পেয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সবচেয়ে সুস্পষ্ট প্রভাব হলো উপকূলীয় ক্ষয় এবং নিচু ভূমির বন্যা। কিন্তু, এসকল দ্বীপের সম্প্রদায়গুলো অনেক আগে থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছে। ভূগর্ভস্থ পানিতে সমুদ্রের লবণাক্ত জল মিশে থাকায় সেটি গৃহস্থালীর ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে যায়। ফলে, এখানকার বাসিন্দারা পানির জন্য বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল থাকে। একই কারণে, ফসলও উৎপাদন করতে পারে না তারা।
তোরুয়ারের আরেক বাসিন্দা ববি সোমা বলেন, এই দ্বীপে মানুষের স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে বেঁচে থাকার মতো কোনো আশা নেই। এমনকি দ্বীপবাসীদেরকে খাদ্যের জন্য মূল ভূখণ্ডে জন্মানো খাদ্যের উপর নির্ভর করতে হয়।
২০১৪ সালে মূল ভূখণ্ডে বসবাস শুরু করেন তিনি। তবে তিনি বলেন, "মূল ভূখণ্ডে যাওয়া আমাদের পক্ষে কঠিন। তোরুয়ারেই আমাদের মায়েরা থাকতেন এবং সেখানেই জন্মগ্রহণ করেছি আমরা।"
নিজের সম্প্রদায়ের লোকদেরকে সোমা দেখাতে চেয়েছেন, নিজের জন্মস্থান ত্যাগের মানসিক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও নতুনভাবে জীবনকে গড়ে তোলা সম্ভব।
এছাড়া, মূল ভূখণ্ডে নিজের খাদ্য উৎপাদনের সুবিধাও পাচ্ছেন সোমা। তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলোর উচিত, বুগেনভিলের মতো ছোট দ্বীপগুলোকে সমর্থনের জন্য আরও পদক্ষেপ নেওয়া। তিনি বলেন, "বড় দেশগুলো শিল্প ও প্রকল্প তৈরির মাধ্যমে নিজেদের দেশের উন্নয়ন করে চলেছে। কিন্তু, এটি আমাদের জীবনকে কঠিন করে তুলছে।"
'দ্বীপটি সমুদ্রে তলিয়ে যাবে'
বিগত ১২ বছর ধরে, তার সম্প্রদায়ের সদস্যদেরকে মূল ভূখণ্ডে স্থানান্তরিত হতে সহায়তা করে আসছেন উরসুলা রাকোভা। কার্টারেট দ্বীপপুঞ্জ থেকে বুগেনভিলের প্রায় ৮০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত এই মূল ভূখণ্ড।
রাকোভার অনুমান অনুযায়ী, দ্বীপের সর্বোচ্চ অংশটিও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১.২ মিটার উঁচু। "এটি খুবই কম। আপনি যদি পাঁচ থেকে ছয়টি দ্বীপ একত্রে রাখেন, তাহলে আপনি হেঁটে এক ঘন্টার কম সময়ে সবগুলো দ্বীপ ঘুরে দেখতে পারবেন," বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, "সম্ভবত দ্বীপগুলো এখানে থাকবে, এবং সম্ভবত এখানে গাছপালাও থাকবে। কিন্তু আমাদের জীবনকে টিকিয়ে রাখা এবং খাদ্য উৎপাদনের কোনো অবস্থা আর নেই।"
এখানকার বাসিন্দাদেরকে সাহায্যের জন্য 'টুলেলে পিসা' নামক একটি স্থানীয় এনজিও প্রতিষ্ঠা করেছেন রাকোভা। এনজিওটির নামের অনুবাদ দাঁড়ায় 'নিজের হাল নিজেই ধরা।'এর মাধ্যমেই কার্টারেট দ্বীপপুঞ্জ থেকে বাসিন্দাদেরকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করতে সাহায্য করছেন তিনি।
এখন পর্যন্ত, দশটি পরিবার সফলভাবে তিনপুট গ্রামে স্থানান্তরিত হয়েছে। এছাড়া, ক্যাথলিক মিশন কর্তৃক তাদেরকে দেওয়া নতুন জমিতে বাড়ি তৈরি করতেও সাহায্য করেছে তার এনজিও।
"পরিবারগুলোকে একটি ঘর, পানির ট্যাঙ্ক এবং এক হেক্টর জমি দেওয়া হয়েছে। সেখানে তারা কোকো, নারকেল এবং অন্যান্য ফসলও জন্মাতে পারে। এছাড়া, মিষ্টি আলু, কাসাভা, ট্যাপিওকা, কলা, সবুজ শাক সহ আরও অনেক সবজি চাষ করতে পারি আমরা," জানান রাকোভা।
দ্বীপে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে যাওয়া চ্যালেঞ্জিং হলেও তিনপুট গ্রামে বসবাসকারীদের জীবনযাত্রার মান ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সেখানে তারা উর্বর জমিতে ফসল ফলানোর পাশাপাশি কোকো উৎপাদনের মাধ্যমে আয়ও করতে পারবে। তিনপুটে স্থানান্তরের জন্য প্রথম সাইন আপ করেন মরিস কারমেন এবং তার পরিবার।
কারমেন জানান, "আমার ৩০০ টি কোকো গাছ এবং নারকেল সহ একটি জমি আছে। আমি এই গাছ থেকে প্রায় দুই ব্যাগ কোকো সংগ্রহ করে বিক্রি করি। এর থেকে যে সামান্য অর্থ আমি পাই তা দিয়ে আমার বাচ্চাদের স্কুলের ফি এবং চিকিৎসা খরচ বহন করি আমি।"
"আমি যা দেখছি তা থেকে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে দ্বীপটি থাকবে না। সমুদ্র এই দ্বীপটিকে ধ্বংস করে দেবে। প্রচুর মানুষ এখনও দ্বীপে বসবাস করছে। কোথায় থাকবে তারা?" প্রশ্ন রাখেন কারমেন।
- সূত্র- দ্য গার্ডিয়ান