এলডিসি-পরবর্তী বড় চ্যালেঞ্জ পোশাক খাতের নিম্ন-উৎপাদনশীলতা
দেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের কারখানা শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে দীর্ঘদিন ধরে অনেক আলোচনা আর উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই।
কিছু সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করলেও তা পর্যাপ্ত নয়। শিল্প মালিকদের নিজ উদ্যোগে প্রশিক্ষণের চেষ্টাও উল্লেখযোগ্য নয়।
এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনেও প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে আসছে।
এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন (এপিও) এর ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকের গড় উৎপাদনশীলতা এক কম্বোডিয়া ছাড়া অন্য সকল প্রতিযোগী দেশের চেয়ে কম।
সংস্থাটির তথ্যমতে, বাংলাদেশি শ্রমিকের মাথাপিছু বার্ষিক উৎপাদনশীলতার মাত্রা ১০ হাজার ৪০০ মার্কিন ডলার। যেখানে ভিয়েতনামের ১২ হাজার ৭০০ ডলার, ভারতের ১৫ হাজার ৮০০ ডলার এবং চীনের ২৩ হাজার ৮০০ ডলার। অর্থাৎ, পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগী দেশগুলোর সবাই বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব, অস্বাস্থ্যকর বসবাসের পরিবেশ এবং নারীর জন্য নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ নিশ্চিত না হওয়াই বাংলাদেশি শ্রমিকের কম উৎপাদনশীলতার মূল কারণ।
বিশ্লেষকগণ বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পোশাক পণ্যের কাঙ্ক্ষিত দর মিলছে না। তার ওপর ২০২৬ সাল নাগাদ স্বল্প আয়ের দেশ (এলডিসি) থেকে মধ্য আয়ের দেশের কাতারে উত্তরণ ঘটলে অনেক দেশে রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানোর আশঙ্কা তো রয়েছেই।
তাছাড়া, উৎপাদন পদ্বতি ও প্রযুক্তিতে স্বয়ংক্রিয়করণ এবং তথ্য আদান-প্রদানের প্রচলনের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে গতানুগতিক কাজের ধারাও পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। উৎপাদনে ব্যবহার বাড়ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটের, যা শিল্পটিকে স্বয়ংক্রিয়করণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা দেশের পোশাক শিল্পের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে খাতটির দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে পণ্যসম্ভার বৈচিত্র্যকরণের পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বিকল্প নেই, বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান এনিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, 'স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে শ্রম ও পুঁজির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে না পারলে, এই খাতকে নতুন চাপে পড়তে হবে। সেক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হতে পারে।'
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হওয়ার পরও বাংলাদেশ উৎপাদনশীলতার বিচারে তলানিতেই রয়ে যাওয়া একটি নির্মম বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে, এ পরিস্থিতির উন্নয়নে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা নিতান্তই অপ্রতুল।
সরকারি ও বেসরকারি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে কথা যত হয়েছে, কাজ সে হারে এগোয়নি।
এব্যাপারে শ্রমিক নেতা ও আওয়াজ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার টিবিএস'কে বলেন, 'শ্রমিকরা সহকারী হিসেবে যোগদানের করার পর কর্মরত অবস্থায় যা শেখে, এর বাইরে সরকারিভাবে বা দাতাদের মাধ্যমে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়– তা যথেষ্ট নয়।'
তাছাড়া কম মজুরির কারণে শ্রমিকরা পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণের সুযোগ পান না, যা কম উৎপাদনশীলতার একটি বড় কারণ বলেও জানান তিনি।
এব্যাপারে সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার দক্ষতা বৃদ্ধিতে যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকার পাশাপাশি, কম মজুরিকে উৎপাদনশীলতায় পিছিয়ে থাকার জন্য দায়ী করেন।
এছাড়া, উচ্চ মানের পোশাক প্রস্তুতের উপযোগী প্রশিক্ষণ না থাকা, কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশের অনুপস্থিতি, চাহিদা ভিত্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ না থাকাসহ আরো কিছু কারণ তুলে ধরেন তিনি।
প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শ্রমিকের মানসিক স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির ঘাটতি, পারিবারিক সমস্যা কিংবা জীবনযাপনের মান শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়- বলে মনে করেন ফতুল্লাহ ফ্যাশন- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)- এর সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান।
তিনি নিজেও স্বীকার করেন যে, গত চার দশকে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয় কাজটি কর্তৃপক্ষ করেনি।
সরকারি কার্যক্রম এখনও কাগজে-কলমে:
সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ন্যাশনাল প্রোডাকটিভিটি অর্গানাইজেশন (এনপিও) কারখানাগুলোর মধ্য পর্যায়ের ব্যবস্থাপক পর্যায়ে দুই থেকে তিন দিনের প্রশিক্ষণ দিলেও- তা প্রয়োজনীয় মাত্রায় উৎপাদনশীলতা হার উন্নয়নে যথেষ্ট নয়।
জাতীয়ভাবে উৎপাদনশীলতার হিসাব করলেও, এখনও খাতভিত্তিক পরিমাপ নেই সরকারি প্রতিষ্ঠানটির।
এর বাইরে সরকারের অর্থমন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয় 'কর্মসংস্থান বিনিয়োগ কর্মসূচির জন্য দক্ষতা (এসইআইপি)' শীর্ষক প্রকল্প, যাতে বেশিরভাগ অর্থায়ন বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীদের। এর মাধ্যমে পোশাক ও বস্ত্র খাতের সংগঠনগুলোর মাধ্যমে শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত দেড় লাখ শ্রমিককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। যদিও এ কার্যক্রমের প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ ও বাস্তবায়নের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
এর বাইরে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কার্যক্রম পরিচালিত হলেও- সেগুলিও যথেষ্ট নয়।
দেশের সব খাতের শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়নে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কাজ করার উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালে গঠিত হয়- জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ)।
এই প্রতিষ্ঠান ১২টি খাত নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে, যার মধ্যে পোশাক ও টেক্সটাইল খাতও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে চাহিদা ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কারিকুলাম ঠিক করে দেবে আর বাস্তবায়ন করবে অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ প্রতিষ্ঠানের কারিকুলামের আওতায় এখনো পোশাক খাতে দক্ষতা উন্নয়নের কার্যক্রম শুরু হয়নি।
এনিয়ে এনএসডিএ পরিচালক মো. কামরুজ্জামান টিবিএস'কে বলেন, 'আমাদের কারিকুলামের আওতায় এখনো কারখানা পর্যায়ে কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়নি। কারখানাগুলোতে কী রকমের প্রশিক্ষণের চাহিদা এবং সেখানে দক্ষতা ঘাটতি কী – তা অধ্যয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
শ্রমিক নেতারা বলছেন, সরকারি কিংবা বেসরকারি পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়ন কিংবা উৎপাদনশীলতায় কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে না। সমন্বিতভাবে কারিকুলাম ঠিক করে, তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
এজন্য পুরো কাজটি সরকারের উদ্যোগে হওয়া যৌক্তিক বলে মনে করেন নাজমা আক্তার।
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি শহীদউল্লাহ আজিম বলেন, 'ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াসহ অনেক দেশেই শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণসহ সার্বিক কার্যক্রম সরকারই করে। এখানেও সরকারের যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া দরকার।'
শিল্প মালিকদের উদ্যোগও অপ্রতুল:
শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে চার দশক বয়সী এই শিল্পের উদ্যোক্তাদের ভূমিকাও উল্লেখ করার মত নয়। বিজিএমইএ'র উদ্যোগে একটি ইউনিভার্সিটি চলছে, যাতে ফ্যাশন ডিজাইনে শিক্ষার সুযোগ থাকলেও, শ্রমিকদের শেখার সুযোগ নেই।
নতুন করে সংগঠনটি মধ্য পর্যায়ের ব্যবস্থাপনাসহ অপেক্ষাকৃত অগ্রগামী অংশের জন্য ইনোভেশন সেন্টার করার ঘোষণা দিয়েছে, যা এখনো চালু হয়নি।
এর বাইরে এসইআইপি প্রকল্প ছাড়াও আরো দু-একটি প্রকল্পের মাধ্যমে শ্রমিকের দক্ষতা উন্নয়নে কিছু কাজ চলমান রয়েছে। আরও রয়েছে শ্রমিকদের পুষ্টির অভাব পূরণের বেশকিছু কর্মসূচি। এসব কর্মসূচির অর্থায়নের বড় অংশই আসছে দাতাদের কাছ থেকে। তবে প্রাপ্ত অর্থও প্রকৃত চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়।
তবে গার্মেন্টস মালিকরা বলছেন, বহু অদক্ষ শ্রমিক ইন-হাউজ ট্রেনিং ও কাজ করতে করতে শিখছেন।
বিজিএমইএ- এর একজন পরিচালক আব্দুল্লাহ হিল রাকিব টিবিএস'কে বলেন, 'কিছু কারখানায় নিজেদের ইন-হাউজ ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে পরবর্তীতে শ্রমিকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া যে কারখানাগুলোতে আধুনিক ও অটোমেটেড মেশিন আসছে, দিনে দিনে শ্রমিকরা তা চালানো শিখে নিচ্ছেন।'
কিন্তু, অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, 'এক সময় স্বল্প মূল্যের পোশাক তৈরি করা হতো, যাতে খুব বেশি দক্ষতার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু বর্তমানে উচ্চ প্রযুক্তির মেশিনারি আর উচ্চমানের পণ্য তৈরি ছাড়া বিশ্ববাজারে টিকে থাকা কঠিন হবে। সেজন্য প্রচলিত চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।'
চার দশক আগে দেশে গার্মেন্টসের উদ্যোগ যখন প্রথম যাত্রা শুরু করে, তখন রপ্তানিমুখী হওয়ার আগেই শতাধিক শ্রমিক ও মধ্যস্তরের ব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মীদের দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছিল, যাদের অনেকেই পরবর্তীতে কারখানার মালিকও হয়েছিলেন।
কিন্তু এরপর চার দশকে বাংলাদেশ থেকে এভাবে বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার উদাহরণ খুবই কম।
এ প্রসঙ্গে শহীদউল্লাহ আজিম বলেন, 'শুরুর সময়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ছিল না বলে বিদেশ থেকে ট্রেনিং নিতে হয়েছে। পরবর্তীতে আমাদের আর প্রয়োজন হয়নি।'
'তবে উচ্চ প্রযুক্তির মেশিন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে, সংশ্লিষ্ট বিদেশী কোম্পানির পক্ষ থেকে বাংলাদেশে এসে কারখানায় শ্রমিকদের ট্রেনিং দেওয়া হয়'- বলেন তিনি।
আর নিজ কারখানার উদাহরণ দিয়ে আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, 'আমার কারখানায় ১৭ হাজার কর্মীশক্তি যুক্ত। নিজ স্বার্থেই শ্রমিকদের উন্নততর প্রযুক্তি আর মেশিনের সঙ্গে পরিচিত বাড়াতে প্রশিক্ষিত করছি।'
'পোশাক রপ্তানির ৭০ শতাংশের মতো আসে ৪৫০ গ্রুপের কারখানা থেকে। তারা প্রশিক্ষণেরক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। বাদবাকী ৩০ শতাংশ রপ্তানিকারক কারখানা এজন্য ব্যাপক কাজ করতে হবে'- বলেও মন্তব্য করেন তিনি।