‘অর্থনীতির স্বার্থেই অপরিহার্য পরিবেশ, সময় এসেছে জিডিপি ভিত্তিক উন্নয়ন মাপকাঠি বর্জনের’
গেল ৭০ বছরে পৃথিবীর চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)। এই মাপকাঠিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন মাপছে সকল দেশ। কিন্তু, জিডিপি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের আর্থিক মূল্যের ধারক। তার পেছনে ছুটতে গিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ, সীমিত সম্পদ ও মানব কল্যাণের যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, তা কিন্তু উঠে আসে না। তাই সময় এসেছে আরও সঠিক উন্নয়ন সূচক নির্ধারণের।
কিন্তু কেন তা এখনই পরিবর্তন করতে হবে?
ব্যাখ্যাও সহজ। প্রকৃতি যেভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছে তা কখনো স্বীকার না করে অটেকসই সব চর্চাকে উৎসাহিত করে জিডিপি। একারণেই আজ বিশ্ব জুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল সংকট। দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ঘিরে জরুরি অবস্থা। আরো সহজ করে বললে, জিডিপি এমন হিসাবের খেরোখাতা যেখানে এই ভুলের জন্য লাল কালি টানার সুযোগ রাখা হয়নি। হিসাবরক্ষণের সুচতুর কৌশলেই এটি আমাদের চারপাশের পরিবেশ দূষণ করতে দিয়েছে মুক্তহস্তে।
হিসাব ছাড়াই আমরা বায়ুমণ্ডলে নির্গমণ করেছি কোটি কোটি টন গ্রিন হাউজ গ্যাস, ধবংস করেছি প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান। মানুষও বাদ পড়েনি। দূষণকারী শিল্পের মাধ্যমে প্রকৃতি নির্ভর প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন করে তাকে কারখানায় দাস বানিয়েছে এ ব্যবস্থা। অথবা করেছে বাস্তুচ্যূত, হতদরিদ্র। অর্থাৎ, মুষ্টিমেয়র সম্পদ অর্জনের তাড়নায় উপেক্ষিত হয়েছে মানব কল্যাণ। দূষণের কারণে আজ জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিপন্ন। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে নির্দিষ্ট শ্রেণির হাতে।
১৯৩০ এর দশকের মহামন্দা পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিবিদ সিমন কুজনেৎস প্রবৃদ্ধির এই তত্ত্ব তৈরি করেন। তখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের দিকটি তিনি হয়তো ধারণাও করেননি। জিডিপির কিছু সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে কুজনেৎস নিজেও সচেতন ছিলেন; কিন্ত তারপরও আজকের দুনিয়ায় এটিই হয়ে উঠেছে অর্থনীতির পরিমাপক। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে আজ যে সচেতনতা ও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, তা যেন হাতবাঁধা অবস্থায় করছে সরকারগুলো।
মোট বাস্তুতান্তিক পণ্য:
এ বাস্তবতায় গ্রোস ইকোসিস্টেম প্রোডাক্ট বা জিইপির মতো ভিন্ন সূচকমুখী হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। এর মাধ্যমে অর্থনীতি ও মানব কল্যাণে প্রকৃতির অবদান হিসাব করতে পারব আমরা।
মোট বাস্তুতান্তিক পণ্য সূচক তৈরির গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। এর প্রচেষ্টা বিশুদ্ধ পানি, মাটির মান, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সেবা এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব মণ্ডিত ভূ-প্রকৃতির মূল্য নির্ধারণ। এসব অবদান আমাদের যে সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যের সৃষ্টি করে তাকে আর্থিক অঙ্ক দিয়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া।
আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, জিইপি মৌমাছির চাকে মধু সংরক্ষণকে, তার দ্বারা ফুলের পরাগায়ণকে পরিসংখ্যানে যোগ করবে। যে নির্মল প্রকৃতি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রসন্ন করছে তার মূল্যায়ন করবে।
জিডিপি উৎপাদিত পণ্যমূল্য বা মোট উৎপাদনকে গণনা করলেও সে তুলনায় জিইপি প্রকৃতির অবদানকে মূল্যায়িত করার মাধ্যমে নীতি-নির্ধারকদের প্রকৃতিতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করবে। এ দুই সূচককে একসঙ্গে কার্যকর করাটা বেশ জটিল, কারণ অনেক খাতেই এদুটির পরিমাপ একে অপরের উপাত্ত গ্রহণ করে। তবে দুই ধরনের পদ্ধতি থাকলে তা টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের তথ্য দিয়ে সরকারগুলোকে সাহায্য করতে পারবে।
বাস্তুতান্ত্রিক সেবা:
এর মধ্যেই কিংহাই প্রদেশে জিইপি প্রচলনের পরীক্ষামূলক চেষ্টা চালাচ্ছে চীন সরকার। তিব্বতীয় মালভূমিতে দুর্গম এ অঞ্চল। এখান থেকেই উৎপত্তি এশিয়ার বৃহৎ তিন নদী- পীত, মেকং এবং ইয়াংজির।
গবেষকরা দেখেছেন, ২০০০ সালে সামস্টিক বাস্তুসংস্থানের পরিমাপ ২০২০ সালে জিডিপির চেয়ে অনেক বেশি ছিল। জিডিপির ২৬ বিলিয়ন ইউয়ানের বিপরীতে জিইপি দাঁড়ায় ৮১.৫ বিলিয়ন ইউয়ান। অর্থাৎ, মানবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে বেশি হয়েছে সুফলদায়ী বাস্তুসংস্থান ভিত্তিক কর্মকাণ্ড।
তবে ২০১৫ সাল নাগাদ জিইপি কমে জিডিপির তিন-চতুর্থাংশে নেমে আসে। জিডিপির ২৪২ বিলিয়ন ইউয়ানের তুলনায় যা ছিল ১৮৫.৪ বিলিয়ন ইউয়ান। এতে স্পষ্ট হয়, প্রচলিত মানব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রকৃতি সংরক্ষণের চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে। ফলে পরিবেশ তার আগের অগ্রগণ্য অবদান হারিয়েছে।
কিংহাই তিন নদীর উৎস হওয়ায় গবেষকরা দেখেন, সুপেয় পানি এবং উর্বরতা বৃদ্ধিকারী পলির মতো বাস্তুতান্ত্রিক সেবার মূল্য চীনের অন্যান্য প্রদেশ এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনীতিতে যোগ হয়েছে।
তাই প্রতিবেশী অঞ্চল বা দেশ আর্থিক অবদানের জন্য উৎস অঞ্চলকে কতটুকু আর্থিক প্রতিদান দিতে পারে তার একটি পরিমাপ সৃষ্টি করতে পারে কিংহাই –এ জিইপির হিসাব।
এ ধরনের ব্যবস্থা থাকলে তা উৎস অঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে উৎসাহিত করবে। আর বৈশ্বিক পরিসরে দেখলে, একবার ভাবুন আমাজনের কার্বন শোষণ অবদানের জন্য ইউরোপীয় দেশগুলো ব্রাজিলের কৃষক ও আদিবাসীদের মূল্য দিলে এ মহাবন রক্ষায় কত বড় পরিবর্তন আসবে।
আয়ারল্যান্ডের বন ও জলাশয় অঞ্চলও একইভাবে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে। এ ব্যবস্থায় গ্রামীণ অঞ্চলকে কার্বণ সংরক্ষণের মূল্য দেবে শহরাঞ্চল। ফলে রক্ষা পাবে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চল। নিশ্চিত হবে সুস্বাস্থ্য ও জনকল্যাণ। হবে সুষম উন্নয়ন।
প্রকৃতি থেকে আমরা যে সুফল পাই তাকে মূল্যায়নের আওতায় আনা হলে জিইপি আমাদের অর্থনীতি নিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে শেখাবে। কেন্দ্রীভূত অর্থনীতির বদলে আমরা যদি বন, জলাশয়, নদনদী রক্ষা করি তাহলেই হবে অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়ন।
একথাও সত্য জিইপি আর জাতিসংঘের সিস্টেম অব এনভায়রোমেন্টাল-ইকোনমিক অ্যাকাউন্টিং এখনই সর্বব্যাপী আরোপ করা সম্ভব নয়। বেশ জটিল ও সিংহভাগ ক্ষেত্রে অপ্রমাণিত এসব সূচক প্রবর্তনের আগে এত বড় পরিসরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক জরিপ চালাতে হবে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কখনো হয়নি।
তবে আমরা যদি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব প্রশমনের কথা ভাবি, তাহলেই বৈপ্লবিক নতুন পদ্ধতি বাস্তবায়নের গুরুত্ব উপলদ্ধি করব।
- লেখক: স্টিফেন ওনাকুসে আয়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজ কর্কের খাদ্য ব্যবসা ও উন্নয়ন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির টেকসই জীবিকা অধ্যয়ন কেন্দ্রের উপপরিচালক।
- সূত্র: স্ক্রোল ডটইন